গ্রামের চিঠি / তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদক: অভ্র ঘোষ
৮০০.০০
করুণা প্রকাশনী
গত শতকের বিশের দশকে যখন ‘সত্যমূলক’ নাটক রক্তকরবী লিখে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপের পুঁজিবাদী দানবীয় চাহিদা-সৃষ্টিকারী সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার বিরোধিতা করছিলেন তখন তরুণ বাঙালি শহুরে সাহিত্যিকরা রবীন্দ্ররচনায় বাস্তবতার অভাব ‘উপলব্ধি’ করে বাংলা সাহিত্যে ‘রিয়্যালিটি’ আমদানি করতে চাইছিলেন। এই কমবয়সী সাহিত্যিকদের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব হয়নি রবীন্দ্রনাথ কতটা সত্যদৃষ্টির অধিকারী। রক্তকরবী লেখার আগেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সিটি অ্যান্ড ভিলেজ’ নামের ইংরেজি নিবন্ধে খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে শহর গ্রামসমাজকে ক্রমশ রিক্ত করছে, প্রকৃতি-পরিবেশকে বিনষ্ট করছে। রবীন্দ্র-পরবর্তী সাহিত্যিকদের মধ্যে গ্রামসমাজের অভিজ্ঞতায় যিনি ঋদ্ধতম সেই তারাশঙ্কর শহরের সাহিত্যিকদের এই রিয়্যালিটির কল্লোলে খুব একটা কল্কে পাননি। ‘কল্লোল’ ও ‘কালি-কলম’-এর রিয়্যালিটিপরায়ণ সাহিত্যিকরা তারাশঙ্করকে সগোত্রীয় হিসাবে গ্রহণ করতে চাননি, তাঁদের সাহিত্য আড্ডায় গিয়ে গ্রাম থেকে আসা তারাশঙ্করের নিজেকে কেমন বহিরাগত বলে মনে হয়েছিল। ‘শনিবারের চিঠি’র সজনীকান্ত, যাঁর অন্য নানা রকম সীমাবদ্ধতা ছিল, সাহিত্যিক তারাশঙ্করকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ‘কল্লোল’ ও ‘কল্লোল’-সমগোত্রীয়দের বাস্তব-সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের মতে নিতান্তই হট্টগোল, রিয়্যালিটির ভানই তাঁদের লেখার অবলম্বন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তারাশঙ্করের সাহিত্যে প্রকাশিত গ্রামসমাজের সত্যরূপ নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে ‘কংগ্রেসি’ তারাশঙ্করের লেখা উপন্যাসের পরিণতি মার্কসবাদী সাহিত্য সমালোচকদের আবার অপছন্দ হয়েছিল। এই স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির নানা ওঠাপড়ার মধ্যে তারাশঙ্কর অবশ্য তাঁর সাহিত্যধর্মে একটি বিষয়ে অবিচল ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে গ্রামসমাজের সাধারণ মানুষের জীবনধারাকে বুঝতে চেয়েছিলেন তিনি— শুধু বুঝতেই চাননি এই মানুষগুলির জীবনের সমস্যার নানা বাস্তব সমাধানও প্রদান করতে তৎপর হয়েছিলেন।
তারাশঙ্করের এই মনটিকে অনুসরণ করার অন্যতম প্রধান অবলম্বন তাঁর ‘গ্রামের চিঠি’। গল্প-উপন্যাসের কৃৎকৌশল চিঠিতে বজায় রাখতে হয় না। তারাশঙ্কর একরঙা কোনও চশমা পরে তাঁর এই চিঠিগুলি লেখেননি। ‘দৈনিক যুগান্তর’-এ ১৯৬৩-র ২৭ জুলাই থেকে ১৯৬৮-র ২৭ মে পর্যন্ত প্রায় ছ-বছর ধরে তারাশঙ্করের ‘গ্রামের চিঠি’ প্রকাশিত হয়েছিল। চিঠির সংখ্যা ২৩২। তপোবিজয় ঘোষের সম্পাদনায় যে গ্রামের চিঠি এর আগে প্রকাশিত হয়েছিল তা নির্বাচিত চিঠির সংকলন, সব চিঠি সেখানে ছিল না। অভ্র ঘোষের সুসম্পাদনায় তারাশঙ্করের ‘সমগ্র’ গ্রামের চিঠি বাঙালি পাঠকের সামনে এল। এই সংকলনের শেষে চিঠিগুলি প্রসঙ্গে বিস্তারিত টীকা প্রদান করা হয়েছে ।
তারাশঙ্কর তাঁর প্রথম চিঠিতেই লিখেছিলেন, ‘এককালে গ্রামই প্রধান ছিল। এখন গ্রামের প্রাধান্য গেলেও গ্রামেই দেশের প্রাণশক্তি নিহিত রহিয়াছে।’ এই বিশ্বাস থেকেই তারাশঙ্কর তাঁর চিঠিগুলি লিখেছিলেন। তবে ‘গ্রামেই দেশের প্রাণশক্তি নিহিত রহিয়াছে’ প্রমাণ করার জন্য সব পেয়েছির দেশের ছবি তিনি চিঠিতে তুলে ধরছেন না। ভাল-মন্দে মেশানো গ্রামই তাঁর চিঠিতে উঠে আসে। চিঠির বাক্য বহু ক্ষেত্রেই কাটা কাটা, সংক্ষিপ্ত। কখনও কখনও সেই কাটা কাটা বাক্যে মিশে থাকে শ্লেষ। সিদ্ধান্তে যাওয়ার সময় প্রয়োজন মতো তথ্য ব্যবহার করেছেন। ১৯৬৩ সালের ১৭ অগস্টের চিঠিতে তারাশঙ্কর স্বাধীন দেশের উপরওয়ালাদের প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘ইহারা গ্রামের লোকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না, কারণ ইহারা উপরওয়ালা। দেশের শাসক। মধ্যে মধ্যে ভাবি— আঃ, ইংরেজ কি কলই পাতিয়া গিয়াছে। যে আসে সেই রাবণের মাসতুতো ভাই হইয়া দাঁড়ায়।’ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা যেমন, রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও তেমন। বহু কষ্টে গড়ে ওঠা একটি গ্রামের স্কুল ঘিরে বামপন্থী-দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের বিবাদ। এক জনে মামলা লাগায়, অন্য জনে ফাঁসায়। কাজের কাজ কিছুই হয় না। তারাশঙ্করের মন্তব্য, ‘লাগ-ফাঁস— বাংলাদেশের বাম-দক্ষিণ-স্বাধীন-স্বতন্ত্র সব দলের মধ্যে কিলবিল করিতেছে।’ বীরভূমের একটি স্কুলের কথা লিখেছিলেন তারাশঙ্কর। শিক্ষকদের বেতনের খাতায় লেখা হয় এক বেতন, তাঁরা পান অন্য বেতন। নিয়ম অনুযায়ী প্রাপ্য তাঁদের ১৬০ টাকা হিসাবে— কিন্তু তাঁরা পান ৭০ টাকা হিসাবে। ‘ধন্য স্বদেশী গণতান্ত্রিক সরকার! ধন্য গদি!’ ১৯৬৪-র ১৩ জুনের চিঠিতে জওহরলাল নেহরুর প্রয়াণ-পরবর্তী সময়ের ছবি, ‘যখন দেশ মোটামুটি শোকপালনে ব্যস্ত তখন তেল চাল প্রভৃতি অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যগুলি বাজার থেকে অন্তর্হিত হতে শুরু করল। তেল চাল নেহেরু নিয়ে যাননি। সেগুলিকে এই ব্যবসায়ীরাই গায়েব করে দর বাড়াবার লড়াইয়ে... টাইট দিতে শুরু করেছেন।’ দেশ স্বাধীন হয়েছে বটে তবে রকম-সকম যেন একেবারে সেকেলে রাজতন্ত্রের মতো, রাজা প্রয়াত হলেই সুযোগসন্ধানীরা উঠে পড়ে লাগে। দেশের সাধারণ মানুষ অনেক দিন পর্যন্ত গণতন্ত্রকে রাজতন্ত্র বলেই ভাবতে অভ্যস্ত, ‘হামরা সরকার— জবাহরলাল নেহেরুজী’।
চিঠিতে যে কেবল ভাঙা রাজনৈতিক বৃত্তান্তই ধরা পড়েছে তা নয়, গ্রামের আনন্দ উৎসবের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। এসেছে সেকাল একালের তুলনা। ‘নবান্ন আজও আছে কিন্তু সে নবান্নে আর এ নবান্নে?’ সে নবান্নের বাটি ভরা দুধ, আধখানা কোরা নারকেল, দুচারটে মর্তমান কদলী, অঞ্জলি ভরা চিনি ‘হাতের নুলোটি ডুবিয়ে লোকে হুপ হাপ করে খেত’ প্রথম প্রহরে। দ্বিতীয় প্রহরে এক অন্ন পঞ্চাশ ব্যঞ্জন। নবান্নের সেই আহার-বাহার নেই বটে, তবে কোথাও কোথাও গ্রামসমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন চোখে পড়ে। কোনাইকুনুই সম্প্রদায়ের মানুষ শিক্ষাবিস্তারের জন্য নিজেরাই ফান্ড তুলেছেন। একটি গ্রামে ধর্মগোলা তৈরি করে সুদখোর মহাজনের হাত থেকে সকলকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করেছেন।
তারাশঙ্করের গ্রামের চিঠি যখন লেখা হচ্ছে তখন বঙ্গদেশে উদ্বাস্তু-সমস্যা প্রবল আকার ধারণ করেছে। তারাশঙ্কর বিশ্বাস করতেন বঙ্গদেশের গ্রাম এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। তারাশঙ্কর হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের অন্তত পঁচিশ হাজার গ্রাম বেছে নিয়ে সে সব গ্রামে গড়ে দশ ঘর লোকের পুনর্বাসন করা সম্ভব। নানা জেলাতেই আবাদযোগ্য পতিত জমি রয়েছে। সেই জমি ব্যবহার করা উচিত। সে জমি ব্যবহার করলে ‘পূর্ববঙ্গের হিন্দুর সমাগম সমস্যা নিয়ে এত জটিলতার সৃষ্টি হত না। ফলে খাদ্য সমস্যাও অপেক্ষাকৃত সরল হয়ে উঠত।’
যা হতে পারত তা হয়নি। তারাশঙ্কর যে গ্রামের চেহারা দেখেছিলেন সে চেহারা হয়তো এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাজনীতিও জটিলতর হয়েছে। তবে গ্রাম সম্বন্ধে মূলগত সমস্যার স্বরূপ একই। কী সেই মূলগত সমস্যা? আমরা গ্রামের উন্নয়নের কথা ভাবি কিন্তু গ্রামকে ভেতর থেকে চেনার চেষ্টা করি না। তারাশঙ্কর গ্রামকে ভেতর থেকে চিনতে ও চেনাতে চেয়েছিলেন।