২০ হাজার টন। সরকারি হিসেবে বাড়িতে, ব্যাঙ্কের লকারে বা মন্দিরে ‘অলস’ ভাবে পড়ে থাকা সোনার বহর।
কেন্দ্র বিপুল পরিমাণ আমদানিতে রাশ টানতে এই সোনার একাংশ জমা রেখে আয়ের পথ দেখাতে চায়। তবে সংশ্লিষ্ট মহলের আশঙ্কা, আপাতত সরকারি প্রচেষ্টায় জল ঢালতে পারে স্বর্ণ জমা প্রকল্পে নামমাত্র সুদ। ব্যাঙ্কিং শিল্পেরও ধারণা, ভাল রকম সুদের আকর্ষণ না-থাকলে পছন্দের গয়না কাছছাড়া করতে চাইবে না বেশির ভাগ পরিবারই। কারণ, চিরাচরিত ভাবেই সোনার গয়নাকে পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা হিসেবে মনে করেন ভারতীয়রা। সরকার চাইলেই তাঁরা সেই ধারণা ঝেড়ে ফেলবেন, তা-ও সামান্য সুদের বিনিময়ে, এমনটা আশা করছেন না ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞরা।
জমা সোনা বাজারে আনতে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার চলতি বছরেই নতুন প্রকল্প আনতে চায়। সেপ্টেম্বরেই তা আসতে পারে বলে ইঙ্গিত সরকারি সূত্রের। ওই ধরনের প্রকল্পে সাধারণ মানুষের গচ্ছিত রাখা সোনা গলিয়ে ফেলে তা গয়না প্রস্তুতকারকদের ধার দেওয়া হবে মূলত ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। লক্ষ্য গয়না শিল্পের চাহিদা মিটিয়ে সোনা আমদানি কমানো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হল, সোনা জমা রাখলে তার উপর ১ শতাংশের বেশি সুদ দিতে চায় না কোনও ব্যাঙ্ক। এমনকী দেশের বৃহত্তম ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্কের দামি ধাতু বিভাগের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার নীরজা নিগম শনিবার বলেন, ‘‘আমাদের পক্ষে স্বর্ণ জমা প্রকল্পে ০.৭৫ শতাংশের বেশি সুদ দেওয়া সম্ভব নয়।’’
গোয়ার পানাজিতে ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড কনভেনশন-এর ফাঁকে নিগম জানান, এ ধরনের প্রকল্পে জমা টানতে তাঁরা কেন্দ্রের কাছে বাড়তি আর্থিক সুবিধা দাবি করেছেন। কোটাক মহীন্দ্রা ব্যাঙ্কের এগ্জিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখর ভাণ্ডারীও একই সুরে বলেন, ‘‘অন্তত প্রথম দিকে বাড়তি সুদ খাতে সরকার অর্থ দিলে তবেই লাভজনক হবে প্রকল্প।’’ আকর্ষণীয় হারে সুদ দিতে না-পারলে যে ঘরে ঘরে পড়ে থাকা সোনাকে টাকার স্থায়ী আমানতের বিকল্প হিসেবে গচ্ছিত রাখতে রাজি হবেন না অনেকেই, সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে ব্যাঙ্কিং মহল। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই তারা সেই আশঙ্কা জানিয়েছে। ১৯৯৯ সালে এ ধরনেরই একটি স্বর্ণ জমা প্রকল্প এনেছিল কেন্দ্র। কিন্তু মূলত নামমাত্র সুদের কারণে একেবারেই তা জনপ্রিয় হয়নি। এ বারও একই ইতিহাস ফিরে আসবে বলে আগাম হুঁশিয়ারি দিয়েছে ব্যাঙ্কিং শিল্প। সোনা জমা প্রকল্পে সামিল হওয়া ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য আর্থিক সংস্থাকে কেন্দ্র তহবিল জোগালে তবেই তার থেকে বাড়তি সুদ দেওয়া সম্ভব বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট মহল। একমাত্র এই ভাবেই প্রকল্পটিকে লগ্নিকারীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব বলে তাদের ধারণা।
নিগম-সহ বেশ কিছু ব্যাঙ্কের শীর্ষস্থানীয় অফিসাররা অবশ্য মনে করছেন, তাঁরা ২% সুদ দিতে পারেন, যদি ওই গচ্ছিত রাখা সোনা নগদ জমার অনুপাত বা সিআরআর হিসেবের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। উল্লেখ্য, মোট আমানতের যে-অংশ বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ককে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে বাধ্যতামূলক ভাবে গচ্ছিত রাখতে হয়, সেটাই সিআরআর। সোনা জমা রাখলে টাকার আমানতের পাশাপাশি তা দিয়েও সিআরআরের দায় মেটানোয় সায় দিতে কেন্দ্রের কাছে ফের আর্জি জানিয়েছেন তাঁরা। প্রসঙ্গত, গত মে মাসেই এই প্রস্তাব আনে কেন্দ্র। তবে তাতে সায় দেয়নি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তাদের আশঙ্কা ছিল, এই ব্যবস্থায় ব্যাঙ্কের হাতে মজুত সোনা বেড়ে যেতে পারে।
এ যাত্রায় স্বর্ণ জমা প্রকল্প কতটা সফল হবে, সে ব্যাপারে তাই সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। একই মত বেশ কিছু গয়নার দোকানের কর্ণধারদেরও। তাঁরা জানিয়েছেন, সোনা জমা রাখার চেয়ে তা কেনার প্রবণতাই ভারতীয়দের বেশি। বিশেষ করে এই চাহিদা বাড়ে অক্টোবর থেকে ধনতেরস ও দেওয়ালি উৎসবকে কেন্দ্র করে। বিয়ের যৌতুক হিসেবে পাওয়া সোনাও হাতছাড়া করতে চায় না মেয়েরা। বিশেষ করে গ্রামের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের কাছে সোনা পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তার মাপকাঠি। ফলে তা আমানত হিসেবে রেখে গলিয়ে ফেলার অনুমতি দিতে সায় নেই অনেকেরই।
এ দিকে, দেশের চাহিদা মেটাতে বিপুল পরিমাণ সোনা আমদানির জেরেই ২০১৩ সালে ভারতের চলতি খাতে লেনদেন ঘাটতি (বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের মধ্যে ফারাক) প্রায় ১১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা বা ১৯ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছিল। তার পর থেকেই সোনায় আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করে কেন্দ্র, যা আগে কখনও এত বেশি ছিল না। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমদানিতে লাগাম পরাতে সোনা জমা প্রকল্প আনতে চায় কেন্দ্র। তবে বাস্তবে সোনার মায়া কাটিয়ে তা লগ্নিতে মানুষ কতটা উৎসাহী হবেন, তা নির্ভর করবে প্রকল্পের সুদের উপরেই।