মেধা এবং তা ব্যবহার করে ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে। হাতের নাগালে মজুত উদ্যোগ পুঁজির (ভেঞ্চার ক্যাপিটাল) আশ্বাসও। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই দু’য়ের মধ্যে সেতু নির্মাণের পরিবেশই তৈরি করে উঠতে পারেনি রাজ্য। ফলে শিল্পমন্ত্রীর ঘোষণা সত্ত্বেও এখানে আসা উদ্যোগ পুঁজির অঙ্ক পড়ে রয়েছে সেই তলানিতেই। যেখানে বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বইয়ের মতো শহরে তা বাড়ছে লাফিয়ে-লাফিয়ে।
যখন কোনও পরিকল্পনা (আইডিয়া) সবে একটি ব্যবসা বা সংস্থা (স্টার্ট-আপ) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে, তখন সেখানে টাকা জোগায় উদ্যোগ পুঁজি (ভেঞ্চার ক্যাপিটাল)। ভারতে সেই পুঁজির ভূমিকা গত কয়েক বছরে কী ভাবে বেড়েছে, তা স্পষ্ট হয় পরিসংখ্যানে চোখ রাখলেই।
২০১০ সালে এ দেশে উদ্যোগ পুঁজির মোট পরিমাণ ছিল ৯০ লক্ষ ডলার। ২০১৩ সালেই তা পৌঁছে গিয়েছে ২০০ কোটি ডলারে। কিন্তু কার্যত এই পুঁজির ছিটেফোঁটাও পায়নি পশ্চিমবঙ্গ। যেটুকু এসেছে, তা নেহাতই অকিঞ্চিৎকর।
এমনিতে জানুয়ারি মাসেই দেশে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির সংগঠন ন্যাসকম এবং মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি বহুজাতিক মাইক্রোসফটের সঙ্গে যৌথ ভাবে শিল্পোদ্যোগী তৈরির আতুঁড়ঘর গড়তে চুক্তি করবে রাজ্য। ওই ইনকিউবেশন সেন্টারকে জায়গা দেওয়ার কথা ওয়েবেলের বাড়িতেই। তা ছাড়া, জেলায়-জেলায় এ ধরনের সেন্টার বা কেন্দ্র তৈরির কথা আগেও ঘোষণা করেছে রাজ্য। যেমন, চলতি বছরের গোড়াতেই আন্তর্জাতিক স্তরের সম্মেলন টাইকনের মঞ্চ থেকে এই ঘোষণা করেছিলেন শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলের মতে,
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সেটা বাস্তবায়িত করার মতো কোনও সরকারি পদক্ষেপ নজরে পড়েনি। ফলে উদ্যোগ পুঁজি টানার ক্ষেত্রেও পিছনের সারিতে রয়ে যেতে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গকে।
ভাড়া করা গ্যারাজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হস্টেল রুম’। মার্কিন মুলুক-সহ উন্নত দুনিয়ায় বেশির ভাগ প্রথম সারির তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাই উঠে এসেছে এমন ‘আঁতুড় ঘর’ থেকে। গুগ্ল কিংবা ফেসবুকের মতো শাণিত মেধা আর উদ্ভাবনী পরিকল্পনার ফসলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে খুঁজে নিয়ে তাতে বিনিয়োগ করেছে বিভিন্ন উদ্যোগ পুঁজি সংস্থা। ব্যবসা শুরুর সময় তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিচার করে গোড়াতেই টাকা ঢালে যারা। যাতে পরে সেই ব্যবসা বড় হলে, নিজেদের অংশীদারি বেচে মুনাফা করা সম্ভব হয়।
কিন্তু হতাশ শিল্পমহলের একাংশ বলছেন, ফেসবুক বা গুগ্ল তো দূরস্থান। এ রাজ্যে উদ্যোগ পুঁজি আসার যা হাল, তাতে ‘মেক মাই ট্রিপ’-এর মতো একটি সংস্থা তৈরিও এখানে শক্ত। এই ছবি স্পষ্ট পরিসংখ্যানেও। দেশের প্রযুক্তি সংক্রান্ত স্টার্ট আপগুলির প্রায় ২৮ শতাংশেরই শিকড় বেঙ্গালুরুতে। দিল্লিতে ২০%, মুম্বই-পুণেতে ১৫%। সেখানে কলকাতা-সহ সারা পূর্বাঞ্চলে তা মাত্র ১০%।
শুধু তা-ই নয়। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের বাইরে গিয়ে উদ্যোগ পুঁজি পাচ্ছে স্থানীয় স্টার্ট-আপগুলি। হাতের কাছেই উদাহরণ টুকিটাকি ডট কম। তাই সংশ্লিষ্ট শিল্প মনে করছে, এ ক্ষেত্রে সেতু বন্ধনের কাজে এগিয়ে আসতে হবে রাজ্য সরকারকেই। পুঁজি পাওয়ার পথে প্রথম বাধাটুকু কাটিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব অনেক ক্ষেত্রে তাদেরই।
সিনপসিস ইন্ডিয়ার কর্তা প্রদীপ দত্তের মতে, উদ্যোগ পুঁজি ঢালার যথাযথ পরিবেশ চাই। তিনি বলেন, সেমিকন্ডাক্টর ও চিপ ডিজাইনিং-এর মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রথমে ‘ডিজাইন টুল’-এর মতো জরুরি পরিকাঠামো গড়তে মোটা বিনিয়োগ লাগে। সে ক্ষেত্রে কোনও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তা জোগাতে পারে রাজ্য সরকারই। উদাহরণ হিসেবে প্রদীপবাবুর দাবি, “আমাদের সংস্থা এ ধরনের ডিজাইন টুল নামমাত্র দামে স্টার্ট-আপগুলিকে দিতে পারে। তার জন্য সংস্থাগুলিকে চিহ্নিত করার দায়িত্বটুকু নিতে হবে রাজ্যকে।” এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ, কর্নাটক ও তেলেঙ্গানা সরকারের সঙ্গে কথা হয়েছে বলেও তাঁর দাবি।
পুঁজি কোথায় কী ভাবে পাওয়া যেতে পারে, তা নিয়েও সচেনতার অভাব রয়েছে রাজ্যে। আবার অন্য দিকে, সেই অভাবের কারণেই এ রাজ্যের স্টার্ট-আপগুলি সম্পর্কে তেমন তথ্য উদ্যোগ পুঁজি সংস্থাগুলির কাছেও নেই। ফলে চাহিদা ও জোগানের মেলবন্ধন ঘটেনি। কেপিএমজি ইন্ডিয়ার অন্যতম কর্তা অম্বরীশ দাশগুপ্ত জানান, বিপণনের যুগে এই সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। এই সেতু বাঁধার কাজে বণিকসভাগুলিকে এগিয়ে আসতেও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
সচেতনতা যে জরুরি, তা মানছে স্টার্ট-আপ সংস্থাগুলিও। ১০ জন ছাত্রের জমানো স্টাইপেন্ডের টাকায় তৈরি কলকাতার স্টার্ট-আপ বেঙ্গল স্পিচ অ্যান্ড হিয়ারিং পেয়েছে ২৫ কোটি টাকার উদ্যোগ পুঁজি। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “নতুন ব্যবসা শুরু করতে উদ্যোগ পুঁজির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা কী ভাবে পাওয়া যাবে, অনেক স্টার্ট-আপই তা জানে না। কারণ উদ্যোগ পুঁজি সংস্থার উপস্থিতি এখানে নেই বললেই চলে।”