শহরে এক সভায় অনিল স্বরূপ
কাঁচা মাল হিসাবে আকরিক লোহার অভাব ছিলই। এ বার কয়লা পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হল রাজ্যের স্পঞ্জ আয়রন এবং পেলেট তৈরির কারখানাগুলি। রাজ্যের একটিমাত্র যে-খনি থেকে ওই সব ইস্পাত সংস্থা কয়লা পেত, সেই ট্রান্স দামোদর কোল মাইনটি সম্প্রতি বিদ্যুৎ শিল্পের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়ার নির্দেশ জারি করেছে কয়লা মন্ত্রক। ফলে এ বার চূড়ান্ত সমস্যায় রাজ্যের স্পঞ্জ আয়রন এবং পেলেট তৈরির সংস্থাগুলি। কারখানা মালিকদের আশঙ্কা, এই সিদ্ধান্তের দরুন তাঁরা অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়বেন। ওই কারখানাগুলির উপর প্রায় সাড়ে চার লক্ষ লোকের রুজি-রুটি নির্ভর করছে।
শুধু স্পঞ্জ আয়রন এবং পেলেট কারখানাগুলিই নয়, রাজ্যের ছোট ছোট সিমেন্ট কারখনা, ইট ভাটা বা রোলিং মিলগুলিও কয়লার জন্য নির্ভরশীল ছিল ট্রান্স দামোদরের উপরেই। খনিটি বিদ্যুৎ শিল্পের জন্য নির্দিষ্ট করায় চূড়ান্ত সমস্যায় পড়েছে ওই সব ছোট কারখানাও।
ট্রান্স দামোদরকে বিদ্যুৎ শিল্পের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়ার ফলে যে রাজ্যের ছোট ইস্পাত কারখানাগুলি সমস্যায় পড়বে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন কেন্দ্রীয় কয়লা সচিব অনিল স্বরূপ-ও। সম্প্রতি কলকাতায় তিনি বলেন, “ওই সব ছোট কারখানার সমস্যার ব্যাপারে আমরা ওয়াকিবহাল। খনি পুনর্বণ্টনের দ্বিতীয় পর্যায়ে ১০৩টি কয়লা খনি নতুন করে বরাদ্দ হবে। সেই সময়ে আমরা দেখব, যাতে ওই ধরনের ছোট কারখানাগুলির কয়লা পেতে কোনও সমস্যা না-হয়।”
ওয়েস্ট বেঙ্গল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশনই (ডব্লিউ বি এম ডি টি সি) খনিটি চালাত। ছোট ইস্পাত সংস্থা যে সমস্যায় পড়বে, তা কবুল করে নিয়েছেন ডব্লিউ এম ডি টি সি-র চেয়ারম্যান অম্লান দত্তও। তিনি অবশ্য সমস্ত দায় কেন্দ্রীয় সরকারের উপরই চাপিয়ে দিয়ে বলেন, “এ ব্যাপারে আমাদের হাত-পা বাঁধা। সমস্ত কিছু কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রকের নির্দেশেই হয়েছে।”
রাজ্যে মোট ৬২টি স্পঞ্জ আয়রন কারখানা এবং তিনটি পেলেট তৈরির কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে কিছু কারখানা কয়লা পায় নির্দিষ্ট কিছু খনি থেকে, যাকে বলা হয় ‘লিঙ্কেজ’ ব্যবস্থা। কিন্তু ওই ব্যবস্থায় আংশিক ভাবে প্রয়োজন মেটে। বাকি কয়লার জন্য ট্রান্স দামোদরের উপরেই তাদের নির্ভর করতে হয়। এ ছাড়া সব কারখানা লিঙ্কেজ ব্যবস্থায় নেই। তারা পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল ট্রান্স দামোদরের উপর।
ট্রান্স দামোদর খনিটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য ২০০৫ সালে রাজ্য সরকারের হাতে দেয় কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রক। রাজ্যে একমাত্র ওই খনি থেকেই খুচরো কয়লা কিনতে পারত ছোট ইস্পাত সংস্থাগুলি। রাজ্যের স্পঞ্জ আয়রন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন -এর সম্পাদক শুভেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, “আমাদের পক্ষে কোল ইন্ডিয়ার বৈদ্যুতিন নিলাম বা ই-অকশন থেকে কয়লা কেনা অসম্ভব। কারণ ওই ব্যবস্থায় এক লপ্তে যে-পরিমাণ কয়লা কিনতে হয়, তা আমাদের মতো ছোট সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে আমরা কয়লার জন্য ট্রান্স দামোদরের উপরেই নির্ভর করে থাকতাম।” এমনিতেই ইস্পাত তৈরির জন্য ওই সব কারখনাকে অন্য রাজ্য থেকে আকরিক লোহার ব্যবস্থা করতে হয়। এ বার কয়লার জন্যও ভিন্ রাজ্যের দিকে তাদের তাকিয়ে থাকতে হবে। শুভেন্দুবাবুর আশঙ্কা, “এর ফলে উৎপাদন খরচ যে-হারে বাড়বে, তাতে কারখানাগুলির অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিতে পারে।” ওই সব কারখানায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মিলে প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে।
নতুন ব্যবস্থায় ট্রান্স দামোদর কয়লা খনির মালিক আর রাজ্য সরকার থাকছে না। কোনও বিদ্যুৎ সংস্থা খনিটি নিলামে কিনে নেবে। এতে রাজ্যেরও আর্থিক লোকসান হবে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা। শুভেন্দুবাবু বলেন, “আমাদের হিসাবে অনুযায়ী ওই খনি থেকে কয়লা বিক্রি করে রাজ্য সরকার বছরে ১৫০ থেকে ১৬০ কোটি টাকা মুনাফা করতে পারত। এর উপর ছিল রয়্যালটি। নতুন ব্যবস্থায় তারা রয়্যালটি পেলেও কয়লা বিক্রি করে মুনাফার সুযোগ হারাবে।”