নিষ্ফলা: বড় নোট রাতারাতি কাগজ। টাকার খোঁজে হন্যে। এটিএমে লাইন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মৃত্যুও। নোটবন্দিতে সেই কৃচ্ছ্রসাধনের ‘ফল জানাল’ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। প্রায় সব নোটই ঘরে ফিরেছে। ফিরলেন না ওই কয়েক জন। ফাইল চিত্র
অনুৎপাদক সম্পদ খাতে মোটা টাকা তুলে রাখতে গিয়ে লাভের মুখ দেখছে না বহু ব্যাঙ্ক। কিন্তু তাদের দাবি ছিল, আসলে এ ভাবে হিসেবের খাতা সাফ হচ্ছে দ্রুত। যার ফলে তৃতীয় ত্রৈমাসিক থেকেই কামড় কমবে অনুৎপাদক সম্পদের। কিন্তু বুধবার সেই আশায় কার্যত জল ঢেলে দিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২০১৭-১৮ সালের বার্ষিক রিপোর্ট। জানাল, সেই ‘অচ্ছে দিন’ দূর অস্ত্। বরং অর্থনীতির যা পরিস্থিতি, তাতে এই অর্থবর্ষে মোট অনুৎপাদক সম্পদের সমস্যা আরও ঘোরালো হওয়ার আশঙ্কা।
রিপোর্ট সামনে আসতেই তাই বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, তা হলে কি দেশের অর্থনীতি নিয়ে আশার আলো দেখা যাচ্ছে না শীর্ষ ব্যাঙ্কের দূরবিনেও? ধরা দিচ্ছে না অচ্ছে দিন? অথচ এই শীর্ষ ব্যাঙ্কই তো ৭.৪% বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহলের প্রশ্ন, তা হলে ছবিটা উল্টো হওয়া উচিত নয় কি?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনিতে বৃদ্ধির চাকায় গতি আসা মানে অর্থনীতির আয়তন বাড়া। আর্থিক কর্মকাণ্ডের মাথা তোলা। সাধারণত তাতে বিভিন্ন আটকে থাকা প্রকল্পেরও চাকা ঘোরে। ফলে ধার শোধ করতে পারে তারা। সম্ভাবনা তৈরি হয় অনাদায়ি ঋণ কমার। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এই সম্পদের বোঝা না-কমার সতর্কবার্তা তাই অর্থনীতির এগোনোর সেই প্রক্রিয়া ঘিরেই ধোঁয়াশা তৈরি করেছে। বাড়ছে উদ্বেগ। যদিও এ দিনই শীর্ষ ব্যাঙ্কের হিসেব জানিয়েছে, গত অর্থবর্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে অনুৎপাদক সম্পদ কমেছে ৬৪,১০৬ কোটি টাকা। অন্য দিকে, সেন্ট্রাল ইনফর্মেশন কমিশনার বলেছে, ৫০ কোটির বেশি স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থার কথা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করুক অর্থ মন্ত্রক ও শীর্ষ ব্যাঙ্ক।
ব্যাঙ্কিং শিল্পের খারাপ সময় কাটাতে ১১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশনের (পিসিএ) তালিকায় এনেছে শীর্ষ ব্যাঙ্ক। কোনও ব্যাঙ্ক ন্যূনতম মূলধন, অনুৎপাদক সম্পদ, ঋণ বা ঋণপত্রের মতো সম্পদ থেকে আয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়ম মানতে ব্যর্থ হয়ে সমস্যায় পড়লে, সেটিকে আনা হয় পিসিএ-র আওতায়। অনুৎপাদক সম্পদ ছাঁটতে ঋণ ঢেলে সাজানোর পুরনো কিছু প্রকল্পের বদলে এ দিন একগুচ্ছ নতুন নির্দেশিকাও জারি করেছে শীর্ষ ব্যাঙ্ক।
বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের বোঝা কমাতে মরিয়া মোদী সরকার। হামেশাই ভারতকে দ্রুততম বৃদ্ধির দেশ হিসেবে তুলে ধরে তারা। বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, এ দিনের রিপোর্ট কি তবে এটাই বলছে যে, আর্থিক কর্মকাণ্ড এমন জায়গায় পৌঁছয়নি যে অর্থনীতির পালে পুরোদস্তুর বাতাস লাগে? কারণ, তাতেই তো চাকা ঘোরে প্রকল্পের। বাড়ে ঋণ শোধ। কমে অনাদায়ি ঋণ।
সারা বিশ্বই এখন কাবু নিষ্ফলা বৃদ্ধির সমস্যায়। বিভিন্ন দেশেই স্পষ্ট হচ্ছে সেই ছবি, যেখানে লগ্নি হচ্ছে। কিন্তু তা মূলত খরচ হচ্ছে প্রযুক্তি বা পেটেন্ট খাতে। একই ভাবে বৃদ্ধি হয়তো মন্দ নয়। কিন্তু তার সঙ্গে সাযুজ্য নেই নতুন কাজের সুযোগ তৈরির। অনেকের উদ্বেগ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্টেও কি সেই ইঙ্গিতই!
অন্য দিকে অনুৎপাদক সম্পদের সমস্যা না মিটলে ব্যাঙ্কগুলি হাত খুলে ধার দিতে পারবে না। টান পড়বে পুঁজিতে। গতি রুদ্ধ হবে শিল্পের। মার খাবে কর্মসংস্থান। সব থেকে বেশি ভুগবে ছোট-মাঝারি শিল্প। সে ক্ষেত্রে ভোট বাক্সে চোখ রেখে ফের যে অচ্ছে দিনের স্বপ্ন ফেরি করতে নেমেছেন নরেন্দ্র মোদী, তা আমজনতার কাছে আদৌ বিশ্বাসযোগ্য ঠেকবে তো?
উত্তর ব্যালট বাক্সে মিলবে। কিন্তু শীর্ষ ব্যাঙ্কের রিপোর্টেও প্রশ্ন বিস্তর।
সমস্যার পাহাড়
• ২০১৫ সালের ৩১ মার্চ মোট অনুৎপাদক সম্পদের অঙ্ক ছিল ৩,২৩,৪৬৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ৩১ মার্চে তা বেড়ে হয়েছে ১০,৩৫,৫২৮ কোটি।
সিঁদুরে মেঘ
• শীর্ষ ব্যাঙ্কের মতে, অনুৎপাদক সম্পদের সমস্যা মেটা এখনও দূর অস্ত্। ২০১৮-১৯ সালে তা ঘোরালো হতে পারে।
মাথাব্যথা
• জানুয়ারি-মার্চে ২১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মধ্যে মুনাফা দু’টির। মোট লোকসান ৬২,৬৪১ কোটি। ১১টি ব্যাঙ্কই আরবিআইয়ের পিসিএ তালিকায়।
• ব্যাঙ্কগুলির দাবি ছিল, অনাদায়ি ঋণে মোটা আর্থিক সংস্থানের তেতো ওষুধ গেলার ফল মিলবে। শীঘ্রই কমবে অনুৎপাদক সম্পদ। শীর্ষ ব্যাঙ্কের রিপোর্টে সংশয়ের মেঘ তাতে।