টাটা গোষ্ঠী কারও ব্যক্তিগত জমিদারি নয়।
টাটাদের ছ’টি সংস্থার শেয়ারহোল্ডারদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে কার্যত রতন টাটার বিরুদ্ধে সোমবার ফের এ ভাবেই পরোক্ষে তোপ দেগেছেন সাইরাস মিস্ত্রি। তিনি বলেছেন, ‘‘গোষ্ঠী টাটা ট্রাস্টস-এর ট্টাস্টিদের মালিকানাধীনও নয়। তাঁদের মধ্যে একজন ব্যক্তি বা কোনও ‘হাই কমান্ড’-এর উপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হলে তা অনৈতিক, অন্যায্য সিদ্ধান্ত এবং বিশ্বাস ভাঙারই সামিল।’’ উল্লেখ্য টাটা ট্রাস্টস-এর আওতায় থাকা বিভিন্ন ট্রাস্টের আজীবন চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন রতন টাটা, তাঁর সঙ্গে রয়েছেন ২০ জন অছি। টাটা গোষ্ঠীর মূল হোল্ডিং সংস্থা টাটা সন্সের ৬৬ শতাংশ শেয়ারের মালিকানাই রয়েছে টাটা ট্রাস্টস-এর হাতে। আর, তার পরেই ১৮.৪ শতাংশ মালিকানা নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মিস্ত্রির সংস্থা শাপুরজি-পালোনজি।
গোষ্ঠীর পরিচালন ব্যবস্থা যাতে পুরোপুরি ভেঙে না-পড়ে, তার জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন তিনি। তাঁর দাবি, গোষ্ঠী পরিচালনার হাল ফেরাতে এগিয়ে আসাটা এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘নিজস্ব দায়’ হিসেবেই ধরতে হবে। মিস্ত্রির চিঠির জবাবে রাতে তাঁর দিকেই অভিযোগের পাল্টা তির ছোড়ে টাটা সন্স। তাদের অভিযোগ, ‘‘মিস্ত্রিই টাটা গোষ্ঠীতে নিজের জমিদারি কায়েম করেন।’’
টাটা সন্স তার চেয়ারম্যান পদ থেকে গত ২৪ অক্টোবর সাইরাস মিস্ত্রিকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকেই চলছে টাটা-মিস্ত্রি চাপান-উতোর। সেই দ্বন্দ্বে নতুন মাত্রা যোগ করেই ২০ লক্ষেরও বেশি ছোট শেয়ারহোল্ডারের কাছে পাঠানো চিঠিতে মিস্ত্রি আরও লিখেছেন, ‘‘টাটা গোষ্ঠী টাটা সন্স-এর ডিরেক্টরদের বা শাখা সংস্থাগুলির ডিরেক্টরদের এক্তিয়ারে নয়। তা সব শেয়ারহোল্ডারের, আপনাদের মতো প্রত্যেকের।’’
চেয়ারম্যান পদ খারিজের পরে গোষ্ঠীর যে-সব সংস্থার পর্ষদ থেকেও ডিরেক্টর হিসেবে তাঁকে সরাতে শেয়ারহোল্ডারদের বিশেষ সাধারণ সভা বা ইজিএম ডাকা হয়েছে চলতি মাসেই, সেখানকার শেয়ারহোল্ডারদেরই এই চিঠি পাঠিয়েছেন সাইরাস মিস্ত্রি। সংস্থাগুলি হল: টাটা স্টিল, টাটা মোটরস, টাটা কেমিক্যালস, টাটা পাওয়ার, টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস (টিসিএস) এবং ইন্ডিয়ান হোটেল্স লিমিটেড।
এর মধ্যে প্রথমেই ইজিএম ডাকা হয়েছে টিসিএসের। আগামী ১৩ ডিসেম্বরের ওই সভার আগে এ দিনের চিঠিতে মিস্ত্রি প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁকে সরানোর আগে কেন কারণ দর্শানো হল না। রতন টাটার প্রতি ইঙ্গিত করে তাঁর অভিযোগ, ‘‘তাঁর আচরণের কারণ বোঝা দায়। কোনও যুক্তিরও তিনি ধার ধারেন না। এর সঙ্কেত একটাই, যা খুশি তাই করার মতো ক্ষমতা রতন টাটার আছে। তাঁর কাউকে কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজনও নেই।’’
এই পরিস্থিতিতে টাটা গোষ্ঠীর পরিচালন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন মিস্ত্রি। তিনি লিখেছেন, ‘‘টাটা গোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখতে হলে পরিচালনার খোলনলচে বদলাতে হবে। যার অর্থ, সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে, টাটা ট্রাস্টস-এর কাজকর্মে যথেষ্ট স্বচ্ছতা বজায় রয়েছে। কারণ, টাটা ট্রাস্টস-এর আওতায় রয়েছে বিভিন্ন দাতব্য ট্রাস্ট, যা সাধারণ ভারতবাসীর টাকায় তৈরি। ট্রাস্টিদের সিদ্ধান্তের উপর নজরদারি প্রয়োজন। বিশেষ করে সেগুলি যদি কারও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির পথ করে দেয়, তা হলে বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।’’
মিস্ত্রি প্রসঙ্গত উল্লেখ করেন, তিনি এই সংস্কারের লক্ষ্যেই এগোতে চেয়েছিলেন। আচমকা চেয়ারম্যান পদ থেকে সরতে বাধ্য হওয়ায় তাঁর সে কাজ সম্পূর্ণ হল না। টাটা মোটরস-এর উদাহরণ টেনে তিনি বলেছেন, উৎপাদন ভিত্তিক উৎসাহ ভাতা চালুর ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন রতন টাটা। তিনি এ ব্যাপারে সংস্থার কর্মী ইউনিয়নের মত চেয়েছিলেন, যার জেরে ওই প্রস্তাব ভেস্তে যায়।
চেয়ারম্যান পদ থেকে তাঁকে সরাতে যাঁরা ভোট দেন, তাঁদের মধ্যে টাটা ট্রাস্টস-এর তিন জন মনোনীত ডিরেক্টর ছিলেন। আর ছিলেন তিন জন নতুন ডিরেক্টর, যাঁদের মধ্যে দু’জনকেই আনা হয়েছিল রতন টাটার সুপারিশে। তিন জনেরই এর আগে মাত্র একবার এ ধরনের বৈঠকে থাকার অভিজ্ঞতা রয়েছে। পাশাপাশি, মিস্ত্রির অভিযোগ, মনোনীত ডিরেক্টরদের কার্যত হাত করেছিলেন ট্রাস্টিরা।
এ দিকে, টাটা সন্স সোমবার পাল্টা বিবৃতিতে মিস্ত্রির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, ‘‘টাটা গোষ্ঠী সত্যিই কারও জমিদারি নয়। বরং মিস্ত্রিই তাঁর বেশ কিছু একতরফা সিদ্ধান্তের জেরে নিজের জমিদারি কায়েম করেন। নষ্ট করে দেন প্রতিষ্ঠান হিসেবে টাটা সন্সের ঐতিহ্য।’’ টাটাদের আরও দাবি, চেয়ারম্যান হওয়ার পরে মিস্ত্রি একটু একটু করে সব শাখা সংস্থার কর্তৃত্বের রাশ নিজের হাতে নেন। মিস্ত্রি অবশ্য শেয়ারহোল্ডারদের কাছে অভিযোগ এনেছেন, ‘‘রতন টাটা নিজের পরম্পরা ধরে রাখার ব্যাপারে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সেই কারণেই তিনি বোঝাতে চাইছেন, যা ইচ্ছে তাই করার একচ্ছত্র ক্ষমতা তাঁর আছে। একজন অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এমন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।’’
মিস্ত্রির পক্ষে আর্জি উপদেষ্টা সংস্থার শেয়ারহোল্ডারদের ভোট দেওয়ার ব্যাপারে উপদেশ দেওয়ার দায়িত্বে থাকা সংস্থা আইএসএস এ দিন টিসিএস শেয়ারহোল্ডারদের মিস্ত্রিকে সমর্থনের আর্জি জানিয়েছে। এই আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা সংস্থার মতে তাঁকে সরালেই যে সংস্থার ভাল হবে, এমন কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই। আবার মিস্ত্রি থাকলেই যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তার কোনও মানে নেই।