প্রতীকী চিত্র
রকেট গতিতে প্রযুক্তির বদল, ২৪ ঘণ্টা ইন্টারনেট, বাড়ি থেকে কাজ, বিপুল টার্গেটের চাপ। সব মিলিয়ে পেশাদার জীবন পড়ে গিয়েছে পঞ্চম গিয়ারে। মানিয়ে নিয়ে ছুটতে পারলে ভাল। নইলে ব্রেকডাউন।
এই অবস্থায় নতুন বিপদ! রোজকার জীবনের নকশা আমূল বদলে দিল করোনা। তাই পেশার পাশাপাশি স্বাস্থ্যের দিকেও সমান নজর দিতে হবে। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে স্বাস্থ্য বিমা করিয়ে রাখলে আরও ভাল। নিজের জন্য তো বটেই। কাছের মানুষের মুখের দিকে তাকিয়েও। কিন্তু কাকে বলে স্বাস্থ্য বিমা? মেডিক্লেম আর হেল্থ ইনশিয়োরেন্স কি একই? এই সব কিছু নিয়েই আজকের আলোচনা।
সাঁড়াশি চাপ
পেশার স্বাভাবিক পরিবর্তন হোক, কিংবা হোক অতিমারির প্রভাব। জোড়া চাপের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে পুরো জীবনযাপনটাই গিয়েছে বদলে। এমনকি টুকরো-টাকরা সব অভ্যাসও। ফাঁকা সময়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়ে যে আনন্দ আগে পাওয়া যেত, কাজের চাপ মাথা থেকে নামাতে গিয়ে সেটাও অনেকের ক্ষেত্রে বদলে গিয়েছে উইকেন্ড পার্টিতে। পাশাপাশি, প্রযুক্তির সুবিধার ফলে প্রায় সব ধরনের পণ্য বা পরিষেবাই হাজির হচ্ছে বাড়ির দরজায়। ফলে কাজের বোঝায় মাথা ভারী হলেও, শারীরিক পরিশ্রম কমছে। এই বদলের অনেকটাই অবশ্য কাজের ক্ষেত্র, আয়ের স্তর, ভৌগলিক অঞ্চলের উপরে নির্ভরশীল।
পরিবর্তনই জীবনের একমাত্র ধ্রুবসত্য। সেটা মেনেও বলছি, এই বদলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতে না-পারলে সমূহ বিপদ। বস্তুত, গত কয়েক বছর ধরে সেই বিপদের বৃত্তে ঢুকেও পড়েছি আমরা। ফলে বদলে যাওয়া জীবনযাপনের পাল্লায় পড়ে দীর্ঘস্থায়ী ও দুরারোগ্য (ক্রনিক) ব্যাধি এখন কার্যত ঘরে ঘরে। কারণ সেই কাজের ধকল, দূষণ, শারীরিক পরিশ্রম কমা, অসময়ে অস্বাস্থ্যকর খাবার। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি চমকে দেওয়া পরিসংখ্যানে চোখ রাখা জরুরি:
• প্রতি ২০ জন ভারতীয়ের এক জন হৃদরোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার খরচ ৪-৬ লক্ষ টাকা।
• ১০ জনের মধ্যে এক জন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ ৫-১০ লক্ষ টাকা।
• লিভারের অসুখ হয় প্রতি পাঁচ জনের। লিভার প্রতিস্থাপনের খরচ ১২-১৫ লক্ষ টাকা। তার পরে প্রত্যেক মাসে খরচ ১০,০০০ টাকা করে।
এটা ঠিক যে, বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে বহু কঠিন রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাই এখন রয়েছে হাতের কাছে। কিন্তু সমস্যা হল, গড়পড়তা মানুষের পক্ষে সেই খরচে হাত ছোঁয়ানো কঠিন। তার উপরে বছরে প্রায় ১০% হারে তা বেড়ে চলেছে। যার ফলে চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়েই বহু মানুষের সারা জীবনের সঞ্চয়ের টাকা খরচ হয়ে যায়। অতিমারি সেই ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে। এই অবস্থায় পেশা বা ব্যক্তিগত জীবনের চাপের মধ্যেও স্বাস্থ্যে ঝুঁকির বিষয়ে তলিয়ে না ভাবলেই নয়!
জোড়া অস্ত্র
পেশার চাপ যতই থাকুক, জীবনকে বেঁধে ফেলুন ২৪ ঘণ্টার শৃঙ্খলাবদ্ধ ঘড়িতে। যেখানে দৈনন্দিন রুটিনে থাকবে ঠিক সময়ে স্বাস্থ্যসম্মত খাওয়া, শরীরচর্চা, বিশ্রাম। স্বাস্থ্য ঠিক রেখে পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার প্রথম ও সেরা উপায় এটাই।
কিন্তু গাড়ির সবকটি চাকা পাকাপোক্ত থাকলেও, ঝুঁকি কমানোর জন্য বাড়তি অন্তত একটা স্টেপনি যে সঙ্গে রাখতেই হয়! স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও তো সেই নিয়মে ব্যতিক্রম থাকা ঠিক নয়! হঠাৎ গুরুতর কোনও অসুখ হলে বাড়তি খরচ আসবে কোথা থেকে? চিকিৎসার খরচ তো হাসপাতালের বিলেই শেষ হয় না। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বা অস্ত্রোপচারের আগে-পরের যাবতীয় খরচও পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তাকে করে তুলতে পারে অনিশ্চিত। এই ঝুঁকিই কমাতে পারে হেল্থ ইনশিয়োরেন্স বা স্বাস্থ্য বিমা।
মেডিক্লেম বনাম স্বাস্থ্য বিমা
• হেল্থ ইনশিয়োরেন্স বা স্বাস্থ্য বিমা নিয়ে যখন কথা হয় তখন অনেকে তার
সঙ্গে মেডিক্লেমকে গুলিয়ে ফেলেন। বস্তুত, অনেক ক্ষেত্রে এর উল্টোটাও ঘটে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা পরিষ্কার জেনে রাখা ভাল। মেডিক্লেম এবং স্বাস্থ্য বিমা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা দু’টি পরিষেবা। তাদের উদ্দেশ্যও পৃথক।
• মেডিক্লেম প্রকল্প বিক্রি করে সাধারণ বিমা সংস্থাগুলি। উদ্দেশ্য, গ্রাহকের চিকিৎসার খরচ বহন করা। সে সরাসরি হাসপাতালের বিল মিটিয়েই হোক, কিংবা হোক গ্রাহকের মেটানো বিলের টাকা ফেরত দিয়ে।
• টপ-আপ পলিসি ও সুপার টপ-আপ পলিসির মাধ্যমে মেডিক্লেমে চিকিৎসা খরচের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো যায়।
• স্বাস্থ্য বিমার উদ্দেশ্য কিন্তু পুরোপুরি অন্য। এই প্রকল্প বিক্রি করে জীবন বিমা সংস্থাগুলি। বিমা পলিসিতে নথিভুক্ত রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের রিপোর্টের উপরে ভিত্তি করে গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। সেই অঙ্ক (সাম অ্যাশিয়োর্ড) ঠিক হয়ে যায় পলিসি কেনার সময়েই। এর সঙ্গে কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কিংবা চিকিৎসা খরচের কোনও সম্পর্ক নেই।
• হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগের চিকিৎসার জন্য সেই টাকা খরচ হতে পারে। এমনকি, ওই টাকা হাতে থাকলে পছন্দ মতো হাসপাতাল নির্বাচনেও বাড়তি সুবিধা হতে পারে। সবচেয়ে বড় দিক হল, আর্থিক চাপ কমানোর সুযোগ থাকে পরিবারের।
• সাম অ্যাশিয়োর্ডের পাশাপাশি, স্বাস্থ্য বিমার সঙ্গে হাসপাতালের খরচের প্যাকেজও কেনা যায়। পাওয়া যেতে পারে চিকিৎসার এমন খরচও, যেগুলি সাধারণ মেডিক্লেমে মেলে না। তা হলে যা দাঁড়াল
গোটা বিষয়টা সহজে বোঝানোর জন্য আদর্শ স্বাস্থ্য বিমা পলিসির কাল্পনিক উদাহরণের সাহায্য নেওয়া যাক।
সফল পেশাদার প্রণবের (৩৫) পরিবারে রয়েছেন স্ত্রী অর্পিতা (৩০) এবং ছেলে রাহুল (৫)। প্রণবের স্বপ্ন কলকাতায় ফ্ল্যাট কেনা এবং ছেলের পড়াশোনা। রোজগার ভাল হলেও প্রণব সতর্ক। তিনি জানেন, পরিবারের কারও কঠিন অসুখ হলে হাত পড়বে জমানো টাকায়। অনিশ্চিত হবে ফ্ল্যাট কেনা। আপস করতে হতে পারে ছেলের শিক্ষার মানের সঙ্গে। তাই অন্যান্য সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের সঙ্গে স্বাস্থ্য বিমাও কিনেছেন তিনি।
• ৪০ বছর মেয়াদি সেই বিমায় রয়েছে ২০ লক্ষ টাকার কার্ডিয়াক কভার এবং ৩০ লক্ষের ক্যানসার কভার। সেই সঙ্গে নিয়েছেন হাসপাতালের দৈনিক খরচ, প্রিমিয়াম মকুব ও রোজগারের সুবিধা।
• এখন প্রণব যদি প্রকল্পের মেয়াদের মধ্যে পলিসিতে বর্ণিত হৃদরোগে আক্রান্ত হন, তা হলে ২০ লক্ষ টাকা পাবেন। তিন বছর তাঁকে পলিসির প্রিমিয়াম দিতে হবে না। রোজগারের সুবিধা নেওয়ার ফলে পরের ১২ মাস ধরে ২০,০০০ টাকা করেও পাবেন।
• প্রণবের যদি ক্যানসার হয়, তা হলে তিনি পাবেন ৩০ লক্ষ টাকা। পরবর্তী ১২ মাসে পাবেন ৩০,০০০ টাকা করে।
• বাড়তি কিছু টাকা খরচ করে স্বাস্থ্য বিমা কেনায় প্রণবের হাতে যে শুধু মাত্র চিকিৎসার খরচ এল, তা-ই নয়। ফ্ল্যাট কেনা এবং ছেলের পড়াশোনার জন্য জমানো টাকাতেও হাত দিতে হল না।
• আয়কর আইনের ৮০ডি ধারায় প্রিমিয়ামের উপরে কর ছাড়ের সুবিধাও পাবেন প্রণব।
প্রকল্প নির্বাচন
কোন রোগের কভার নেবেন সে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকেই নিতে হবে। কিন্তু কত টাকার পলিসি কিনবেন? সঙ্গে নেবেন কোন কোন বাড়তি সুবিধা? তার অনেকটাই নির্ভর করছে আর্থিক ক্ষমতার উপরে। কারণ, প্রিমিয়াম গুনতে হবে প্রত্যেক বছর। তবে সংশ্লিষ্ট রোগের এখনকার চিকিৎসা খরচ কী রকম, সে সম্পর্কে একটু খোঁজখবর করে নেওয়া উচিত। ধরা যাক সেই খরচ ১০ লক্ষ টাকা। তা হলে মূল্যবৃদ্ধির একটা আনুমানিক হিসেব কষে ১২-১৫ লক্ষ টাকার পলিসি করানো যেতে পারে।
ক্রিটিক্যাল ইলনেস
ইদানিং টার্ম প্ল্যানের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এই ধরনের জীবন বিমায় কম প্রিমিয়ামে উঁচু অঙ্কের কভারেজ পাওয়া যায়। তবে প্রকল্পের মেয়াদের শেষে কোনও টাকা ফেরত পাওয়া যায় না। যা মেলে এনডাওমেন্ট পলিসিতে। তবে সম্ভব হলে টার্ম প্ল্যানের সঙ্গেও কম খরচে ক্রিটিক্যাল ইলনেস রাইডার নেওয়ার কথা ভাবা উচিত। এই ধরনের স্বাস্থ্য বিমায় ৩৬টি কঠিন রোগের ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। যার মধ্যে রয়েছে পক্ষাঘাত, ফুসফুসের অসুখ, অঙ্গ প্রতিস্থাপন ইত্যাদি। কিনতে পারেন ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমাও।
শেষের কথা
বিমা কেনার ক্ষেত্রে আমাদের বদভ্যাস আছে। বিশেষ করে জীবন বিমার ক্ষেত্রে। অর্থবর্ষের শেষ দিকে কর ছাড়ের সুবিধা পাওয়ার জন্য কিছু লগ্নি করতে হবে। কিনে নিলাম জীবন বিমা পলিসি। মনে রাখবেন, এটা কিন্তু বিমার লক্ষ্য নয়। রোজগেরের অবর্তমানে পরিবারের বাকিদের আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়াই এর আসল কাজ। হ্যাঁ, কর ছাড় অবশ্যই অতিরিক্ত সুবিধা। স্বাস্থ্য বিমার ক্ষেত্রেও কিন্তু ব্যাপারটা একই রকম। অর্থাৎ, ভালবাসার মানুষদের আর্থিক নিরাপত্তা।
লেখক কোটাক মহিন্দ্রা লাইফ ইনশিয়োরেন্সের এমডি ও সিইও
(মতামত ব্যক্তিগত)