ফাইল চিত্র
ব্যবসা করা সরকারের কাজ নয়। যুক্তিযুক্ত নয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সম্পদের অদক্ষ ব্যবহারও। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এক সময় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলগ্নিকরণের কথা ভাবতে শুরু করেছিল ভারত। কিন্তু বুধবার যে ভাবে পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্ত মোদী সরকার নিয়েছে, তাতে সেই মূল নীতির অভাব দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও শিল্প মহলের অনেকে। তাঁদের একাংশের প্রশ্ন, শ্লথ অর্থনীতির জেরে যখন বেসরকারি সংস্থাগুলি নতুন লগ্নি থেকে হাত গুটিয়ে রেখেছে, তখন সম্পত্তি বিক্রির জন্য বাজারে আনলে কি ভাল দাম মেলার নিশ্চয়তা থাকে? নাকি সেগুলি দ্রুত বেচে রাজকোষ ভরার ব্যবস্থা করাই
কেন্দ্রের কাছে পাখির চোখ? যাতে এই মুহূর্তে অর্থের অভাবে সরকার যে সঙ্কটে পড়েছে, যে করে হোক, তা থেকে বেরিয়ে আসার পথে মেলে? অথচ মাত্রা না-ছাড়ায় ঘাটতি।
ভারত পেট্রোলিয়াম-সহ পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ফিকি, অ্যাসোচ্যামের মতো বণিকসভা। নীতিগত দিক থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের ভাবনার বিরোধী নন সিআইআইয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রাক্তন চেয়ারম্যান দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, ভারত চেম্বারের প্রেসিডেন্ট সীতারাম শর্মা বা আইএসআইয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অভিরূপ সরকার, কেউই। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের সময় ও যৌক্তিকতা বিলগ্নিকরণের মূল নীতির সঙ্গে মেলাতে পারছেন না তাঁরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সময়টা বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বছরখানেক ধরে অর্থনীতি ঝিমিয়ে। চাহিদা তলানিতে। ছ’বছরে সর্বনিম্ন বৃদ্ধি। ধাক্কা খাচ্ছে শিল্পোৎপাদন। হচ্ছে ছাঁটাই। এই অবস্থায় চাহিদা বাড়াতে ও বেসরকারি সংস্থাগুলিকে লগ্নিতে উৎসাহ দিতে কর্পোরেট কর কমানো-সহ নানা পদক্ষেপ করেছে কেন্দ্র। কিন্তু এখনও তারা সে ভাবে হাত খোলেনি। ফলে চাহিদা বাড়াতে ভরসা সরকারি ব্যয়। কিন্তু কোষাগারের ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’ অবস্থা। ব্যয় বাড়ালে ঝুঁকি রয়েছে রাজকোষ ঘাটতি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়ানোর। তার উপরে জিএসটি আদায় কমছে। আর্থিক সঙ্কট মেটাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতো ভিন্ন সূত্র থেকে টাকা জোগাড় করতে হয়েছে।
অভিরূপবাবুর প্রশ্ন, ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ পাঁচ সংস্থার বিলগ্নির সিদ্ধান্ত কি কাকতালীয়? নাকি অর্থের প্রয়োজন মেটাতেই এই সিদ্ধান্ত? তাঁর প্রশ্ন, বাজারের অবস্থা ভীষণ খারাপ। সবাই সম্পত্তি ধরে রাখতে চাইছেন। এই শ্লথগতির সময়ে কেউ সম্পত্তি বিক্রি করলে কি ভাল দাম মিলবে? দীপঙ্করবাবুর মতে, বাজেটের খাতার হিসেব মেলাতেই এই পদক্ষেপ। যা কাঙ্খিত নয় বলে মত সীতারামের। তাঁর সতর্কতা, তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত না-নিয়ে যাতে ভাল দাম মেলে তা খেয়াল রাখতে হবে।
তেলমন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানের অবশ্য দাবি, ২০১৪ সাল থেকেই মোদী সরকারের স্পষ্ট নীতি, কেন্দ্রের কাজ ব্যবসা করা নয়। আগামী দিনে আরও কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পেশাদারিত্ব বাড়াতে তাদের শেয়ার বেচবে কেন্দ্র। তবে বিপিসিএল কিনতে ইন্ডিয়ান অয়েল বা অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা উদ্যোগী হবে না বলে তাঁর ইঙ্গিত।
কেন্দ্র যা-ই বলুক, বিলগ্নি কার্যকর করার পরিকল্পনার বাস্তবতা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে শিল্পের একাংশের। দীপঙ্করবাবু দাবি, বিলগ্নিকরণের মাস্টার প্ল্যান থাকা উচিত। এ ক্ষেত্রে তা স্পষ্ট নয়। তাঁর মতে, লাভজনক সংস্থার আগে যে সংস্থা টানা লোকসানে চলায় কোষাগারে চাপ পড়ছে, সরকারি সম্পদ অদক্ষ ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলি আগে বেচা উচিত। কারণ, দক্ষতার সঙ্গে সম্পদ ব্যবহার না-করলে বৃদ্ধি বা কর্মসংস্থান, কিছুই বাড়বে না। কিন্তু দেশের সুরক্ষার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলি কেন্দ্রের হাতেই থাকা উচিত বলে তাঁর মত। সীতারামের বক্তব্য, বিলগ্নিকরণের অর্থ যাতে পরিকাঠামো নির্মাণ বা মূলধনী লগ্নিতেই ব্যবহার করা হয় তা নিশ্চিত করা জরুরি।
এখন কোন পথে বিলগ্নির চাকা গড়ায়, সে দিকেই তাকিয়ে সকলে।