প্রায় সপ্তাহ ঘুরতে চলল সংসদে বাজেট পেশ হয়েছে। তার মোটা দাগের প্রস্তাবগুলি প্রায় সকলেরই জানা। এখন চলছে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ। বস্তুত দেখতে গেলে চাকুরিজীবী, মধ্যবিত্ত
ও প্রবীণদের জন্য কিছু নেই বাজেটে। ৮০সি ধারা এবং স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন ইত্যাদি বাবদ কর ছাড় বাড়ানো হতে পারে, এই মর্মে বাজেটের আগে জোর আলোচনা চলছিল। কিন্তু, ভাবলে বোঝা যাবে এ বাবদ কর ছাড় বাড়ানোর কারণ অর্থমন্ত্রীর কাছে ছিল না। সব ছাড় তোলার লক্ষ্যেই তিনি ২০২০-২১ অর্থবর্ষ থেকে চালু করেছেন বিকল্প আয়কর ব্যবস্থা। তাই পুরনো বিকল্পে ছাড় বাড়ানো হলে, মানুষ তার দিকেই হাঁটবেন ধরে নিতে হবে।
তা ছাড়া, নতুন বিকল্পে তো করের স্তর বাড়ানোই রয়েছে। তাই মানুষের আশা থাকলেও বাড়ানো হয়নি করমুক্ত আয়ের সীমা। অন্যান্য ক্ষেত্রেও করের স্তর বা হারে বদল করা হয়নি। অর্থাৎ, এই বাজেট থেকে মোটামুটি এটা স্পষ্ট যে, পুরনো বিকল্পের জন্য নতুন করে আর কিছু করা হবে না। তার উপরে চলতি অর্থবর্ষের প্রথম ১০ মাসের কর সংগ্রহের পরিমাণ বেশ সন্তোষজনক। রাজকোষে যখন চওড়া ঘাটতি, তখন নতুন করে কর বাবদ কোনও সুবিধা দেওয়ার কথা ভাবেনি অর্থ মন্ত্রক। দু’বছরের মধ্যে সংশোধিত রিটার্ন জমা ছাড়া সে ভাবে সুরাহা মেলেনি।
তবে, ছাড়ের আশার পাশাপাশি আশঙ্কা ছিল নতুন কোনও কর (যেমন সম্পদ কর, উত্তরাধিকার কর ইত্যাদি) বসানো হতে পারে। সেই সিদ্ধান্ত নেননি অর্থমন্ত্রী। যাকে সদর্থক হিসেবে দেখতে বলেছেন। কিন্তু কম সুদের জমানায় প্রবীণদের আশা মেটানোর পথে তাঁর না-হাঁটাও আলোচনায় উঠে এসেছে ভালমতোই।
বরং এ বারের বাজেটে সব চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে পরিকাঠামো ও মূলধনী পণ্য উৎপাদন খাতে। এতে উপকৃত হবে বিভিন্ন শিল্প। তুলনায় কৃষি ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য বরাদ্দ কমেছে। একশো দিনের কাজের মনরেগা প্রকল্পে চলতি অর্থবর্ষের সংশোধিত বরাদ্দের থেকে পরের বছরে তা কমেছে ২৫.৫১%। করোনায় কাজ হারানো বহু মানুষ এই প্রকল্পের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাই এই সিদ্ধান্ত তাঁদের কাছে বড় আঘাত।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এতে গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যে অসাম্য বাড়তে পারে। পাশাপাশি কেন্দ্র ডিজিটালে জোর দিলেও গ্রামে তার পরিকাঠামো ঠিক মতো না-থাকা বৈষম্য বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা। অনেকেই বলছেন, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তৈরি না-থাকা এবং কম্পিউটার, ইন্টারনেটের খরচের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ না-থাকায় পিছিয়ে পড়তে হতে পারে গ্রামাঞ্চলের মানুষকে।
তবে বাজেট শুনে যে বাজার খুশি, তাতে সন্দেহ নেই। চাহিদা দেখা গিয়েছে
ইস্পাত, সিমেন্ট এবং মূলধনী পণ্য সংস্থাগুলির শেয়ারের। সপ্তাহ শেষে অবশ্য বাজার নামে অশোধিত তেল ব্যারেলে ৯৩ ডলার ছাড়ানোয় ও সুদ বৃদ্ধির আশঙ্কায়। চলতি সপ্তাহে রয়েছে ঋণনীতি কমিটির বৈঠক। সেখানে কী সিদ্ধান্ত হয়, সেটাই এখন দেখার। রেপো রেট (বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে যে সুদে ধার দেয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক) যদি না-ও বাড়ে, রিভার্স রেপো (যে সুদে শীর্ষ ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি থেকে ধার নেয়) ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হতে পারে বলে ধারণা। আগামী ক’দিন যা প্রভাব ফেলতে পারে সূচকে।
যদিও বাজেট দেখে মুষড়ে পড়েছে বন্ড বাজার। ২০২২-২৩ সালে কেন্দ্র প্রায় ১৪.৯৫ লক্ষ কোটি টাকা ধার নিতে পারে, এই ঘোষণায় পড়ছে বন্ডের দাম। চড়ছে ইল্ড বা প্রকৃত আয়। সপ্তাহ শেষে হয়েছে ৬.৮৭%। আশঙ্কা কিছু দিনের মধ্যেই তা ছাড়িয়ে যেতে পারে ৭ শতাংশের সীমা। এতে যেমন সরকারের সুদ বাবদ খরচ বাড়বে, তেমনই বেসরকারি লগ্নি ধাক্কা খাবে। সুদের বোঝা কমাতে কেন্দ্র নির্ভর করছে স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পগুলির উপরে। সে ক্ষেত্রে তাতে আকর্ষণ বাড়াতে হলে সুদ বৃদ্ধির পথে হাঁটতে হবে। সে ক্ষেত্রে সামান্য সুরাহা হতে পারে মানুষের।
(মতামত ব্যক্তিগত)