কর্মজীবনের সঞ্চয় বা অবসরের প্রাপ্য— মাথার উপরে ছাদ জোটাতে এই দুইয়ের ভরসাতেই এত দিন চলেছেন সাধারণ রোজগেরেরা। ব্যাঙ্ক ঋণ পাওয়ার সুবিধা সেই ছবিটা বদলেছে। বদলেছে মানসিকতাও। এখন চাকরিতে থিতু হওয়ার বছর কয়েকের মধ্যেই ফ্ল্যাট কেনার পরিকল্পনা করেন অনেকে। আর প্রথম বার বাড়ির মালিক হওয়ার জন্য ‘অ্যাফোর্ডেবল’ বা কম দামি বাড়ির দিকেই পাল্লা ভারি থাকে। অথচ অনেকেই জানেন না সেই কম দামি বাড়ির ঋণে সুদে ভর্তুকির প্রকল্পের কথা। তাই যেখানে কিছুটা কম সুদ গুনেও বাড়ি-ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া যায়, সেখানেই অনেক ক্ষেত্রে বেশি টাকা পকেট থেকে বার করেন। ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখেই আজকের এই আলোচনা।
কম দামি বাড়ি
সাধারণ ভাবে যে ফ্ল্যাট বা বাড়ি নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পকেটের মাপ বুঝে তৈরি, তাকেই অ্যাফোর্ডেবল বলি আমরা। তবে এর সরকারি সংজ্ঞা রয়েছে। ২০১৯ সালের বাজেটে সেই সংজ্ঞা বদলেছে। নতুন নিয়মে—
• বড় শহরে এ ধরনের ফ্ল্যাটের সর্বোচ্চ মাপ হতে হবে ৬০ বর্গ মিটার। এর আগে তা ছিল ৩০ বর্গ মিটার।
• ছোট শহরে তা ৬০ বর্গ মিটার থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯০ মিটার।
• কম দামি বাড়ির তকমা পেতে তার দর হতে হবে ৪৫ লক্ষ টাকা বা কম।
ক্রেতার কী লাভ
সকলের মাথায় ছাদ জোগাতে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় এনেছে কেন্দ্র। যার আওতায় গৃহঋণের সুদে ভর্তুকি দেয় তারা। ফলে ক্রেতার চাপ লাঘব হয়। এই প্রকল্পে বাড়ি-ফ্ল্যাট বাছাইয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয় কম দামি আবাসন।
কারা পাবেন?
আবাস যোজনায় কম দামি আবাসনে সুদে ভর্তুকির সুবিধা দেওয়ার জন্য মূলত চারটি শ্রেণিতে ক্রেতাদের ভাগ করা হয়েছে—
• আর্থিক ভাবে দুর্বল (ইকনমিক্যালি উইকার সেকশন বা ইডব্লিউএস)।
• নিম্নবিত্ত (লো ইনকাম গ্রুপ বা এলআইজি)।
• মধ্যবিত্ত (স্তর-১): মিডল ইনকাম-গ্রুপ ওয়ান বা এমআইজি-১।
• মধ্যবিত্ত (স্তর-২): মিডল ইনকাম-গ্রুপ টু বা এমআইজি-২।
প্রত্যেক্ষ ক্ষেত্রেই পারিবারিক আয়ের উপরে ভিত্তি করে সুদে কত টাকা ভর্তুকি পাওয়া যাবে, তা নির্দিষ্ট করা হবে। (সারণি দেখুন)
এ ছাড়াও রয়েছে এই সুবিধা পান মাইনরিটি গ্রুপ (তফসিলি সম্প্রদায়, আদিবাসী বা অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণি) ও মহিলারা (সংখ্যালঘু, ইডব্লিউএস বা এলআইজি)।
শর্ত কী কী
আয়ের উপরে ভিত্তি করে ভর্তুকির অঙ্ক ঠিক করা ছাড়াও, শহরে আবাস যোজনায় বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
• ইডব্লিউএসের ক্ষেত্রে বাড়ি বা ফ্ল্যাটের কার্পেট এরিয়া হবে ৩০ বর্গ মিটার। এলআইজির ক্ষেত্রে তা ৬০ বর্গ মিটার। এমআইজি ওয়ানে ১৬০ বর্গ মিটার এবং এমআইজি টু-র ক্ষেত্রে ২০০ বর্গ মিটার।
• ভর্তুকির যোগ্য কি না, তা যাচাইয়ের জন্য আবেদনকারীর আয় দেখা হবে। কোনও ক্ষেত্রে পরিবারের আয়ও দেখা হতে পারে। যার মধ্যে থাকবে স্বামী, স্ত্রী ও অবিবাহিত সন্তানের মোট আয়।
• বাড়ি বা ফ্ল্যাট শহরাঞ্চলে হতে হবে। অর্থাৎ, সেটি থাকতে হবে কর্পোরেশন বা মিউনিসিপ্যালিটির আওতাভুক্ত।
• ঋণগ্রহীতার নামে আগে থেকে পাকা বাড়ি থাকা চলবে না। তবে বাবার বাড়ি থাকলেও, ছেলে বা মেয়ে আলাদা ভাবে নিজের বাড়ি তৈরি করতে বা কিনতে এই সুবিধা পাবেন।
• ঋণগ্রহীতার বয়স ৭০ বছর ছোঁয়া বা সর্বোচ্চ ৩০ বছর মেয়াদ— এই দু’টির মধ্যে যেটি আগে, তার মধ্যেই ধার শোধ করতে হবে।
অর্থাৎ, কেউ ৩৫ বছর বয়সে ধার নিলে তা শোধ করতে হবে ৬৫ বছর বয়স হওয়ার মধ্যে। আবার কেউ ৬৫ বছরে ঋণ নিলে, তার পাঁচ বছরের মধ্যে (৭০ বছর বয়স হওয়ার আগে) তা শোধ করে দিতে হবে।
কী ভাবে মঞ্জুর
এই প্রকল্পে বাড়ি কেনার আর্জি জানাতে ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আবেদনপত্র মেলে। নিয়ম হল—
• প্রথমে ঋণদাতা সংস্থা আবেদনপত্রটি খতিয়ে দেখবে।
• সব ঠিক থাকলে, ঋণ মঞ্জুর করে তারা তা ভর্তুকিদাতা সংস্থার (ন্যাশনাল হাউসিং ব্যাঙ্ক অথবা হাডকো) কাছে পাঠাবে।
• এ বার সেই আবেদনপত্র খতিয়ে দেখবে ভর্তুকিদাতা সংস্থা।
• ছাড়পত্রের যোগ্য মনে হলে, তারা হিসেব কষে ভর্তুকির টাকা পাঠাবে আবেদনকারীর অ্যাকাউন্টে।
• মোট ঋণ থেকে ওই ভর্তুকির টাকা শুরুতেই বাদ যাবে। পাওয়া যাবে নিট ঋণের অঙ্ক।
• সেই নিট অঙ্কের উপরই নির্ধারিত হবে মাসিক কিস্তি বা ইএমআই।
লাগে কোন নথি
সাধারণ গৃহঋণ পেতে যে নথিপত্র লাগে, এ ক্ষেত্রেও তাই লাগবে।
চাকরি করলে
• গত তিন মাসের বেতনের স্লিপ।
• তিন বছরের ফর্ম-১৬।
• ছ’মাসের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট।
• অন্যান্য লগ্নির (যেমন, দীর্ঘ মেয়াদি জীবনবিমা প্রকল্প) নথি। অনেক ক্ষেত্রে লাগে না, তবে সঙ্গে রাখা ভাল।
• পাসপোর্ট, প্যানকার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ডের মতো পরিচয়পত্র।
• বিদ্যুৎ বা টেলিফোন বিল ইত্যাদি।
ব্যবসায়ী বা স্বনিযুক্ত হলে
• তিন বছরের আয়কর রিটার্ন।
• ব্যবসার লাভ-ক্ষতির হিসেব।
• কমপক্ষে ছ’মাসের সেভিংস অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট।
• কারেন্ট অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট (লাগলে)।
• অন্যান্য লগ্নির নথি।
• পাসপোর্ট, প্যানকার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড ইত্যাদি।
• বিদ্যুৎ বা টেলিফোন বিল প্রভৃতি।
খেয়াল রাখবেন, সব নথিই যে লাগবে, তা না-ও হতে পারে। তবে হয়রানি এড়াতে সেগুলি গুছিয়ে সঙ্গে রাখা ভাল। এ ছাড়া, দু’ক্ষেত্রেই দিতে হবে যে ফ্ল্যাট বা বাড়ি কিনতে চলেছেন, সেটি ও তার জমি ইত্যাদি সংক্রান্ত কাগজ।
থাকুক বাড়ির কাগজপত্রও
ঋণের আবেদন করার জন্য পরিচয়, ঠিকানা, আয়ের কাগজ যেমন ঠিক থাকা প্রয়োজন, তেমনই জরুরি হল ফ্ল্যাট বা বাড়ির সমস্ত কাগজও গুছিয়ে রাখা। তার উপরেও কিন্তু আপনার ঋণ পাওয়া নির্ভর করবে। তাই সেই নথি দেখে নিতে হবে। এতে থাকবে—
• বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মূল দলিল।
• জমিদাতার সঙ্গে ফ্ল্যাট নির্মাতার (ডেভলপার বা প্রোমোটার) চুক্তিপত্র।
• যার অংশ থেকে ফ্ল্যাট কিনছেন, তার সঙ্গে করা চুক্তিপত্র। সাধারণত নতুন ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে জমিদাতা বা প্রোমোটার এই দু’জনের মধ্যে এক জনের অংশ থেকে কিনতে হয়।
• কর সংক্রান্ত যাবতীয় নথি। দেখতে হবে কোনও বকেয়া করের দায় আপনার উপর বর্তাচ্ছে কি না।
• মিউটেশনের প্রমাণপত্র।
• সার্চ রিপোর্ট। সহজ কথায়, জমির কমপক্ষে ২১ বছরের ইতিহাস। যাতে বোঝা যায়, ইতিমধ্যেই তা রেজিস্ট্রি করে বিক্রি করা বা বন্ধক রাখা হয়েছে কি না। অনেক সময় তা করা হয় ১০ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে। এই ধরনের চুক্তি রেজিস্ট্রি অফিসে নথিবদ্ধ থাকে না। ফলে বিষয়টি সার্চ রিপোর্টে ধরা পড়ে না। তাই বাড়তি সতর্কতা জরুরি।
• বাড়ি বা ফ্ল্যাটের চূড়ান্ত নক্শার অনুমোদন (প্ল্যান স্যাংশন)।
• দু’ ধরনের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি। এক, কাজ শুরুর জন্য জমিদাতার কাছ থেকে প্রোমোটারের নেওয়া ছাড়পত্র। দুই, ফ্ল্যাট বা বাড়ি তৈরির পরে প্রোমোটারের তা বিক্রির অধিকার।
• পুরসভার অনুমোদন।
• কমপ্লিশন সার্টিফিকেট (সিসি)। এই নথি রয়েছে কি না, তার উপরেই নির্ভর করবে আপনাকে জিএসটি বাবদ টাকা গুনতে হবে কি না। থাকলে যেমন জিএসটি লাগবে না, তেমনই না-থাকলে দিতে হবে ১৮% জিএসটি। ফ্ল্যাটের দামের উপর ভিত্তি করে যার মোট অঙ্কটা খুব একটা কম নয়।
• ফ্ল্যাটে পুরসভা কতটা জল সরবরাহ করবে, তার পরিমাণ।
দেখে নিন
বাড়ি কিনতে গিয়ে সেটি কোথায় অবস্থিত, কাছাকাছি হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক, স্কুল, বাস-মেট্রো পরিষেবা রয়েছে কি না, এ সব তো দেখেনই। সে ভাবে ফ্ল্যাট ও প্রোমোটার সম্পর্কেও বেশ কিছু বিষয় দেখে নেওয়া ভাল। এ জন্য সাহায্য নিতে পারেন রাজ্যের নতুন আবাসন আইন ওয়েস্টবেঙ্গল হাউসিং ইন্ডাস্ট্রি রেগুলেশন অথরিটির (হিরা)। মূলত নির্মাণ সংস্থা কতটা নির্ভরযোগ্য, তার আভাস পাওয়া যাবে প্রকল্প যদি হিরার অন্তর্ভুক্ত হয়। হিরায় নথিভুক্ত থাকলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি সহজে যাচাই করে নেওয়া সম্ভব—
• প্রোমোটারের নাম, ঠিকানা ও সংস্থার মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য।
• গত পাঁচ বছরে প্রোমোটারের তৈরি প্রকল্পের বিশদ বিবরণ।
• সরকারি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সায় ও প্রকল্পের কাজ শুরুর বৈধ শংসাপত্র।
• প্রকল্পের অনুমোদিত নকশা, প্রস্তাবিত সুবিধা ও অবস্থানগত তথ্য।
• অ্যালটমেন্ট লেটার ও সেল এগ্রিমেন্টের প্রোফর্মা।
• ফ্ল্যাটের সংখ্যা, কার্পেট এরিয়া, গ্যারেজের সংখ্যা ও মাপ।
• প্রোমোটারের এজেন্ট থাকলে, তাঁদের নাম, ঠিকানা। প্রকল্পে যুক্ত স্থপতি, ইঞ্জিনিয়ারের নাম ও ঠিকানা।
• প্রোমোটার বা ডেভেলপারের দেওয়া হলফনামা (এতে থাকবে প্রকল্পের জমি সংক্রান্ত বিবরণ। যেমন এই জমির উপর প্রোমোটারের আইনি অধিকার। জমি সংক্রান্ত কোনও জট রয়েছে কি না। থাকলে তার বর্তমান অবস্থা কেমন, প্রকল্প শেষ করার সময়সীমা ইত্যাদি)।