বিশ্বকাপ দেখছেন? বাড়ি, পাড়া, অফিসে দিনরাত এই নিয়ে কাটাছেঁড়াও চলছে নিশ্চয়ই! এই বাজারেও একটি বিষয় কিন্তু বিশ্বকাপের টিআরপিতে সামান্য হলেও কামড় বসিয়েছে। তা হল কেন্দ্রীয় বাজেট। ক্রিকেটের মতো এ বছর বাজেটেরও ছিল দুটো ইনিংস। প্রথম ইনিংস হয়ে গিয়েছে গত ১ ফেব্রুয়ারি। পোশাকি নাম অন্তর্বর্তী বাজেট হলেও সে দিন পূর্ণাঙ্গ বাজেটের মতোই চালিয়ে ব্যাটিং করেছিলেন পীযূষ গয়াল। সমাজের প্রায় সমস্ত অংশের হাত ভরিয়ে দিয়েছিলেন। তখন সামনেই ছিল লোকসভা ভোট।
আর গত শুক্রবার তারই দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন নতুন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। পেশ করলেন পূর্ণাঙ্গ বাজেট। ইন্দিরা গাঁধীর পরে দ্বিতীয় মহিলা হিসেবে বাজেট বক্তৃতা দিলেন নির্মলা।
প্রত্যেক বাজেটের আগেই মুখিয়ে থাকেন মধ্যবিত্ত। থাকে বাজেট থেকে অনেক কিছু পাওয়ার আশা। আয়কর তো বটেই, কোন ঘোষণার ফলে কোন খাতে কী লাভ হচ্ছে, তার চুলচেরা হিসেব বুঝে নেন তাঁরা। এ বার কিন্তু সেই আশা ততটা পূরণ হয়নি। যেমন অনেকেই মনে করেছিলেন, হয়তো পরিবর্তন করা হবে আয়করের স্তর। বাড়ানো হবে করমুক্ত আয়ের সীমা। তাতে সরাসরি ঘরে উঠবে কিছু লাভ। ৫% এবং ২০ শতাংশের মধ্যে তৈরি করা হবে ১০ শতাংশের একটি স্তর। তাতেও কিছুটা লাভ হবে চাকরিজীবী এবং মধ্যবিত্তদের একাংশের। তা ছাড়াও মনে করা হচ্ছিল, ৮০সি ধারায় সঞ্চয় ও লগ্নির উপরে করছাড় বাড়বে। নতুন কিছু ছাড় দেওয়া হতে পারে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য। না, এ সবের কিছুই বার হয়নি নির্মলার লাল মোড়ক থেকে। বড় প্রাপ্তির মধ্যে শুধুই রয়েছে গৃহঋণের সুদের উপরে করছাড়ের বর্ধিত অঙ্ক। সেখানেও অবশ্য রয়েছে কিছু শর্ত। তা ছাড়া টুকিটাকি এটা-ওটা কিছু থাকলেও তাকে মন ভরানো উপহার কোনও ভাবেই বলা যায় না।
বরং মধ্যবিত্তের কপালে ভাঁজ ফেলেছে পেট্রল ও ডিজেলের উৎপাদন শুল্ক ও সেস বৃদ্ধি। যার ফলে লিটার পিছু এই দুই জ্বালানির দাম সরাসরি বেড়েছে ২ টাকা করে। এর সামগ্রিক প্রভাব হতে পারে আরও বৃহত্তর। বাড়তে পারে পরিবহণ খরচ, পণ্যমূল্য। এর পাশাপাশি কর বাড়ায় দাম বাড়বে সোনা, সাবান-সহ বিভিন্ন পণ্যের। আবার গৃহ ঋণের সুদে করছাড়ের অঙ্ক বাড়লেও মেঝে এবং দেওয়াল তৈরির টালি ও মার্বেলের দাম বাড়ায় বাড়ি তৈরির খরচই বেড়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, মধ্যবিত্তকে আপাতত সন্তুষ্ট থাকতে হবে প্রথম দফার প্রাপ্তি এবং এ বারের টুকিটাকি পাওনা নিয়ে।
তবে আর সাত মাস পরেই তো পরের বছরের বাজেট। আপাতত এই সময়টা ধৈর্য ধরে কাটিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় কী?
এ বার এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক বাজেট প্রস্তাবগুলির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেগুলি সাধারণ মানুষের দুঃখ-সুখের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
গৃহঋণের সুদে করছাড়
গত বছর পর্যন্ত ২৪বি ধারা অনুযায়ী গৃহঋণের সুদে বছরে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত করছাড় পাওয়া যেত। এ বার তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩.৫ লক্ষ টাকা। তবে এই ছাড় পেতে গেলে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। এগুলি হল:
• নতুন ধারা ৮০ইইএ অনুযায়ী অতিরিক্ত এই ১.৫ লক্ষ টাকা ছাড় পাওয়া যাবে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে কেনা প্রথম বাড়ির ঋণের সুদের উপরে।
• বাড়ির দাম স্ট্যাম্প ডিউটি মূল্যায়ন অনুযায়ী ৪৫ লক্ষ টাকার বেশি হতে পারবে না।
এখন প্রশ্ন উঠছে, এই সুবিধার পুরোটা কি পাওয়া সম্ভব হবে? কারণ, ব্যাঙ্ক এবং গৃহঋণ সংস্থা সাধারণত বাড়ির দামের ৮০% পর্যন্ত ঋণ হিসেবে দিয়ে থাকে। অর্থাৎ, ৪৫ লক্ষ টাকা দামের একটি বাড়ির জন্য এক জন ঋণ পেতে পারেন ৩৬ লক্ষ টাকা। গৃহঋণের বর্তমান সুদের হার মোটামুটি ৮.৬৫%। অর্থাৎ, ৩৬ লক্ষ টাকা ঋণে বাৎসরিক সুদ হতে পারে ৩,১১,৪০০ টাকা। যা ৩.৫ লক্ষ টাকার কম।
ধনীদের বাড়তি করের বোঝা
অন্তর্বর্তী বাজেটে বলা হয়েছিল, যে সব করদাতার করযোগ্য আয় বছরে ৫ লক্ষ টাকার মধ্যে থাকবে, তিনি প্রযোজ্য করের পুরোটাই (১২,৫০০ টাকা পর্যন্ত) রিবেট হিসেবে পাবেন। অর্থাৎ, তাঁকে কোনও কর দিতে হবে না। এই খাতে যে রাজস্ব লোকসান হবে তার কিছুটা তোলার জন্য নতুন অর্থমন্ত্রী এ বার চড়া হারে সারচার্জ বসিয়েছেন ধনী এবং অতি ধনীদের দেয় করের উপরে। এত দিন পর্যন্ত বছরে ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকার কম আয়ের উপরে সারচার্জ ছিল ১০%। আয় তার চেয়ে বেশি হলে সারচার্জ ১৫%। এ বারের বাজেট প্রস্তাবে যা বলা হয়েছে—
• ১৫% সারচার্জ ধার্য হবে বছরে আয় ১ কোটি টাকা থেকে ২ কোটি টাকার মধ্যে হলে।
• কিন্তু আয় ২ কোটি টাকা থেকে ৫ কোটি টাকার মধ্যে হলে সারচার্জ বেড়ে হবে ২৫%।
• আয় এর বেশি হলে সারচার্জ গুনতে হবে ৩৭% হারে।
এতটা চড়া হারে সারচার্জ বসানোয় উচ্চবিত্তেরা অসন্তুষ্ট হলেও, এর জন্য আমজনতার ঘরে বাড়তি কোনও সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হয়নি।
খুচরো ব্যবসায়ীদের পেনশন
যে সমস্ত ব্যবসায়ী এবং দোকানদারের বিক্রি বাবদ বছরে ব্যবসার অঙ্ক ১.৫ কোটি টাকার কম তাঁদের জন্য পেনশনের প্রস্তাব করা হয়েছে এ বারের বাজেটে। এর জন্য তৈরি হয়েছে নতুন একটি প্রকল্প। নাম প্রধানমন্ত্রী কর্মযোগী মান ধন প্রকল্প। এর ফলে উপকৃত হবেন প্রায় ৩ কোটি ব্যবসায়ী ও দোকানদার।
অন্তর্বর্তী বাজেটে মাসে ৩,০০০ টাকা পেনশনের কথা বলা হয়েছিল অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের জন্য। এই দুই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বহু মানুষ পেনশনের আওতায় চলে আসবেন।
ইটিএফ লগ্নিতে করছাড়
বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থার শেয়ার নিয়ে তৈরি এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডে (ইটিএফ) লগ্নি করলে ইএলএসএস প্রকল্পের মতো করছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। এই ধরনের সুবিধা দিলে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ সহজ হবে বলে মনে করছে কেন্দ্র। সরকার মনে করছে, যাঁরা সরাসরি শেয়ারে লগ্নির ঝুঁকি নিতে চান না, তাঁরাও ইটিএফের মধ্যমে পরোক্ষে শেয়ারে লগ্নি করতে উৎসাহিত হতে পারেন।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)