বাঁ দিক থেকে মিতালি, তমাল, তিমির, সুজাতা। নিজস্ব চিত্র।
এ রাজ্যে কিছুই হবে না বলে যখন অনেকেই কপাল চাপড়াচ্ছেন, তখন কলকাতায় বসেই শিশুদের অনলাইন শিক্ষায় পথিকৃৎ হিসাবে নাম কিনে ফেলেছেন দুই যমজ ভাই, তমাল আর তিমির মুখোপাধ্যায়। তিন থেকে ছয় বছরের শিশুদের শিক্ষার জন্য তাঁরা তৈরি করে ফেলেছেন অনলাইন প্লাটফর্ম। বাজারে যদিও গোটা পাঁচেক সংস্থা ইতিমধ্যেই এই বাজারটি ধরতে চাইছে, কিন্তু ভাবনার জায়গা থেকে তমালরাই প্রথম হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন। এক বছরের কম সময়েই তাঁদের ছাত্র সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩,২০০। ব্যবসা বাড়াতে তাঁরা আগামী অক্টোবরে সহায়ক বিনিয়োগকারীদের দ্বারস্থ হবেন ২২৩ কোটি টাকা (৩ কোটি ডলার) তুলতে। ভারতে শিশুদের জন্য অনলাইন স্কুলের ক্ষেত্রেও যা প্রথম বলে সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি।
ক্রিসিলের হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ভারতে স্কুল পড়ুয়াদের এডুটেক বা নেট ভিত্তিক শিক্ষার বাজার বেড়ে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো দাঁড়াবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত প্রায় কেউই তিন থেকে ছয় বছরের শিশুদের অনলাইন শিক্ষার বাজার ধরতে তমালদের ভাবনার জায়গাটায় এগিয়ে আসেননি। তমাল আর তিমিরের গল্পটা তাই এখন শিরোনামে।
কোভিড যেমন কেড়েছে অনেক কিছু, তেমনই তৈরি করেছে নতুন ভাবনার জায়গাও। তমাল ও তিমিরের এই ভাবনা ও তার দ্রুত রূপায়ণের মূলেও এই কোভিড। প্রথম লকডাউনে তাঁদের ৪০০০-এর উপর ছাত্রছাত্রী নিয়ে চলা ৮৩টি স্কুল যখন বন্ধ হওযার মুখে, তখন এক ব্রিটিশ অনুদানের উপর নির্ভর করে ঝাঁপিয়ে পড়েন গোটা স্কুলকেই নেট নির্ভর করতে তুলতে।
তমাল-তিমিরের গোটা ফ্যাকাল্টি। নিজস্ব চিত্র।
জন্মেসূত্রে যমজ এই দুই ভাই কিন্তু পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন আর্থিক সংস্থায়। মজা হল তাঁরা কাজও করতেন এক সংস্থায়। তমাল ছিলেন ইউটিআই-এর আঞ্চলিক প্রধান আর তিমির ছিলেন ইউটিআই-এর কলকাতা দফতরের প্রধান। তাঁরা যখন সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ সামলাতে ব্যস্ত, তখন তাঁদের স্ত্রীরা শুরু করেন শিশুদের স্কুল। কলকাতায় নয়। রিষড়ায়।
তমালের স্ত্রী মিতালি এবং তিমিরের স্ত্রী সুজাতা হাতে হাত ধরে শুরু করেন এই ব্যবসা। শহর কলকাতায় শিশুদের জন্য অনেক রকম ব্যবস্থা আছে। কিন্তু কলকাতার বাইরে কম। এই স্কুল দাঁড়িয়ে যেতেই, দুই ভাই-ও চাকরি ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন ব্যবসা বিস্তারে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল মফস্সলের শিশুশিক্ষার বাজার। ২০১২ সাল থেকে ২০২১-এর মধ্যে নিজেদের তৈরি শিক্ষার উপরকরণ নিয়ে অন্য ভাবে ভেবে ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে ৪০০০ ছাত্রছাত্রী নিয়ে তৈরি করে ফেলেন ৮৩টি স্কুল।
“সবাই যখন বড় স্কুলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাবর্ষ তৈরি করে, আমরা তখন ভাবি অন্য কথা।” তমালের যুক্তি, বড় স্কুলে ভর্তি শুরু হয়ে যায় শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়ার অনেক আগেই। তাই ডিসেম্বরের মধ্যে শিক্ষাবর্ষ শেষ করলে শিশুরা বড় স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যায়। আর সেটাই তাঁর প্রথাগত স্কুলের সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল বলে তাঁর দাবি। “প্রতিযোগিতার বাজারে অভিভাবকরা ছোটদের স্কুলে আসেন যাতে বড় স্কুলে ভর্তি করতে সুবিধা হয়। আর আমরা এই লক্ষ্যকে মাথায় রেখেই বদলে দিই শিশুদের জন্য প্রচলিত শিক্ষাবর্ষের ধারণাটাই।”
২০১৯ সালে যখন কোভিডের আক্রমণে সব বড়দের স্কুল নেটভিত্তিক শিক্ষার রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে, তখন এই দুই ভাই ভাবতে শুরু করেন শিশুদের নেট ভিত্তিক স্কুল তৈরি করার কথা। ব্রিটিশ অনুদান জুটিয়ে, কলকাতার মেধার উপর নির্ভর করেই তৈরি করেন নেটের স্কুল। নিজেদের শিক্ষার উপকরণ দিয়ে তৈরি করেন অ্যানিমেশন আর নিজেদের শিক্ষিকাদের নিয়েই নেমে পড়েন বাজারে। দেশ জুড়ে এক বছরেরও কম সময়ে তাঁর স্কুলের ছাত্র সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়েছে।
কিন্তু অন্য রাজ্যের শিশুদের পড়াতে অসুবিধা হয় না? তমালের অকপট উত্তর, “হ্যাঁ, তা হয়।” তমালরা তাই খুঁজছেন বিভিন্ন রাজ্যে সহযোগী ব্যবসায়ী। কিনে নিতে চাইছেন অন্য রাজ্যের শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যবসা। আর এই কারণেই তাঁরা আবার বাজার থেকে নালন্দা লার্নিং-এর জন্য তুলতে চলেছেন অন্তত ৩ কোটি ডলার। ইতিমধ্যেই তাঁরা ‘আবিষ্কার’কে পেয়েছেন প্রাথমিক সহায়ক বিনিয়োগকারী হিসাবে। এ বার বাকিদের জোটানোর পালা।