ছবি: পিটিআই।
একটি, দু’টি নয়। একের পরে গুনে গুনে চোদ্দোটি শূন্য! কথায় লিখলে ১০০ লক্ষ কোটি।
স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছিলেন, আগামী পাঁচ বছরে পরিকাঠামোয় ১০০ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করবে তাঁর সরকার। আজ মোদী সরকারের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন পাঁচ বছরের জন্য ১০২ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্পের রূপরেখা ঘোষণা করলেন। প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতির স্বপ্ন পূরণ করতে এই প্রকল্প প্রধান চাবিকাঠি হয়ে উঠবে বলে অর্থমন্ত্রীর দাবি।
কিন্তু এই ঘোষণা ঘিরেই তৈরি হয়েছে গুচ্ছ সংশয়। প্রশ্ন উঠছে, এতে কি আদৌ ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি চাঙ্গা হবে? নাকি এ-সব আসলে নতুন বোতলে পুরনো মদ?
নির্মলা-নিদানে প্রশ্ন
• পাঁচ বছরে পরিকাঠামোয় ১০২ লক্ষ কোটি টাকা। কেন্দ্র খরচ করবে ৩৯% (বছরে ৮ লক্ষ কোটি টাকা)
• কেন্দ্র চলতি বছরেই পরিকাঠামোয় ৭.৮৮ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করছে। তা হলে বাড়তি কী হল?
• ১০২ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্পের মধ্যে ৪২.৭ লক্ষ কোটি টাকার কাজ শুরু। আরও ৫১ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প কাগজে-কলমে। নতুন বোতলে কি পুরনো মদ!
• কেন্দ্র বলছে, বাকি টাকা দেবে রাজ্য ও বেসরকারি লগ্নি। কিন্তু আর্থিক বৃদ্ধির হার ৪.৫%। নভেম্বরে আটটি প্রধান পরিকাঠামো ক্ষেত্রের উৎপাদন ১.৫% কমেছে। চাহিদা নেই। টাকা দেবে কে?
অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন, ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে মোদী সরকার সত্যিই কি পরিকাঠামোয় বাড়তি টাকা ঢালছে? নাকি সরকারি খাত থেকে এত দিন যেমন খরচ হচ্ছিল, তেমনই হবে? যে-সব প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো কি আদৌ নতুন? নাকি যে-সব প্রকল্পের পরিকল্পনা চলছিল, সেগুলোই বড় করে দেখাতে একই ছাতার তলায় আনা হল?
আরও পড়ুন: বৃদ্ধিতে গতি ফিরবে কী ভাবে, উঠছে প্রশ্ন
আজ অর্থমন্ত্রী ১০২ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। দু’সপ্তাহের মধ্যে আরও তিন লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প চূড়ান্ত হবে। সব মিলিয়ে আগামী পাঁচ বছরে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ১০৫ লক্ষ কোটি টাকা পরিকাঠামো ক্ষেত্রে খরচ হবে। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৩৯ শতাংশ অর্থ দেবে কেন্দ্র। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে কেন্দ্র খরচ করবে ৪০ লক্ষ কোটি টাকা। বছরে গড়ে আট লক্ষ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রকের একটি সূত্রের বক্তব্য, ‘‘মোটামুটি একই পরিমাণ অর্থ এখন সরকারি খাত থেকে পরিকাঠামো খাতে খরচ হচ্ছে। চলতি বছরেই বাজেট থেকে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ঘর থেকে পরিকাঠামোয় আনুমানিক ৭.৮৮ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। অর্থনীতিবিদ অরুণ কুমারের কথায়, ‘‘এর অর্থ, অর্থনীতির ঝিমুনি কাটাতে যা দরকার ছিল, সেই অনুযায়ী কেন্দ্র মোটেই পরিকাঠামোয় বিরাট কিছু টাকা ঢালছে না। প্রধানমন্ত্রী যে ভাবে ঘোষণা করেছিলেন, মনে হয়েছিল, কেন্দ্রই প্রতি বছর ২০ লক্ষ কোটি টাকা করে খরচ করবে।’’
কিন্তু কেন হচ্ছে না? অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তার জবাব, ‘‘রাজকোষের যা হাল, তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে। বছরে ২০ লক্ষ কোটি টাকা আসবে কোথা থেকে?’’ মন্ত্রক আজই জানিয়েছে, এপ্রিল থেকে নভেম্বরে রাজকোষ ঘাটতি ৮ লক্ষ কোটি টাকা ছাপিয়ে গিয়েছে। যা ৭ লক্ষ কোটি টাকার আশেপাশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য ছিল। অর্থনীতির ঝিমুনির ফলে রাজস্ব আয় কমছে। ফলে খরচে রাশ টানার নির্দেশিকা জারি হয়ে গিয়েছে।
তা হলে ১০৫ লক্ষ কোটি টাকা জোগাড় হবে কোথা থেকে? অর্থমন্ত্রীর জবাব, রাজ্যগুলিও ৩৯% ব্যয় বহন করবে। বাকি ২২% আসবে বেসরকারি লগ্নি থেকে। এখানেও দু’টি প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতিবিদরা। রাজ্যেরও কি এত টাকা রয়েছে? জিএসটির পরে রাজ্যের নিজস্ব আয় বাড়ানোর রাস্তা কমেছে। রাজ্যগুলি এখন কেন্দ্রীয় করে ৪২%-র বেশি ভাগ চাইছে। গত ছ’বছরে কেন্দ্র-রাজ্য মিলিয়ে পরিকাঠামোয় মাত্র ৫১ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করেছে। তার মধ্যে রাজ্যের ভাগ খুবই কম। তা হলে এখন কী হবে, কী করে হবে, সে প্রশ্ন উঠেছে।
বাকি থাকে বেসরকারি লগ্নি। সরকারি পরিসংখ্যান জানিয়েছে, নভেম্বরে ফের আটটি প্রধান পরিকাঠামো ক্ষেত্রে উৎপাদন সরাসরি ১.৫% কমেছে। যেমন প্রচুর বিদ্যুৎ প্রকল্পে উৎপাদনই হচ্ছে না, কারণ বিদ্যুতের চাহিদাই নেই। এই অবস্থায় শিল্পমহলের লগ্নি নিয়েও প্রশ্ন থাকছে।
আর্থিক বিষয়ক সচিব অতনু চক্রবর্তী জানান, লগ্নি টানতে কর্পোরেট বন্ড, পুরসভার বন্ড, পরিকাঠামো লগ্নি তহবিলের মতো সংস্কারের ভাবনাও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকাঠামো প্রকল্প লাভজনক হতে বহু বছর লেগে যায়। ফলে ব্যাঙ্কও লগ্নি করতে চায় না। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে এর আগে পরিকাঠামো তৈরির চেষ্টা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই সাফল্য মেলেনি।
অর্থমন্ত্রী আজ নিজেই জানান, ৪২% প্রকল্প রূপায়ণের স্তরে রয়েছে। ৩১% ভাবনাচিন্তার স্তরে। আর ১৯% প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি হলেও কাজ শুরু হয়নি। সরকারের ২২টি মন্ত্রক এই প্রকল্পগুলিকে চিহ্নিত করেছে। মোটামুটি ভাবে ১০০ কোটি টাকার বেশি প্রকল্প এবং যেখানে বেশি কর্মসংস্থান হবে, অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে, এমন সব প্রকল্পই বেছে নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থমন্ত্রীর ঘোষণাতেই স্পষ্ট, এই প্রকল্পগুলি ইতিমধ্যেই সরকারের পরিকল্পনার মধ্যে ছিল। সেগুলিকেই নতুন মোড়কে একত্র করে আজ ঘোষণা করা হল।