ছবি: সংগৃহীত।
করোনার দাপট সয়েও গত অক্টোবর, নভেম্বরে ১ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছিল জিএসটি সংগ্রহের পরিমাণ। আর ডিসেম্বরে তা পেরিয়ে গেল ২০১৭ সালের জুলাইয়ে অভিন্ন পরোক্ষ কর ব্যবস্থাটি চালু হওয়া ইস্তক আদায়ের সমস্ত হিসেবকে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, গত মাসে পণ্য-পরিষেবা কর খাতে ১.১৫ লক্ষ কোটি টাকার বেশি জমা পড়েছে রাজকোষে। যা দেখিয়ে উচ্ছ্বসিত অর্থ মন্ত্রকের দাবি, এটা রেকর্ড তো বটেই, অতিমারির মধ্যে কার্যত অভূতপূর্ব এক সাফল্যও। যা প্রমাণ করে আর্থিক কর্মকাণ্ডে গতি এসেছে এবং অতিমারির পরে অতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি। ডিসেম্বরে পশ্চিমবঙ্গে জিএসটি আদায়ও ১০% বেড়ে হয়েছে ৪,১১৪ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদেরা অবশ্য বলছেন, প্রথম কথা করোনা এখনও চলে যায়নি। বরং হালে গোটা বিশ্ব তার নতুন ‘স্ট্রেন’ নিয়ে ভয়ে কাঁটা। এই অবস্থায় জিএসটি আদায় বাড়লেও, অর্থনীতি যাবতীয় সঙ্কট ঝেড়ে ফেলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলার সময় আসেনি। কারণ, উৎসবের মরসুমে তৈরি হওয়া চাহিদার কারণেই মূলত গত বছরের শেষ তিন মাসে আর্থিক কর্মকাণ্ড, বিক্রিবাটা বেড়েছে। তার উপরে অতিমারিকে রুখতে দীর্ঘ লকডাউনের জেরে যে পুরনো চাহিদাগুলি চাপা পড়েছিল, বিধিনিষেধ শিথিল হতেই তা বেরিয়ে এসেছে স্রোতের মতো। ফলে চাহিদা যদি আগামী দিনেও বহাল থাকে এবং জিএসটি সংগ্রহ এমন করেই বাড়ে, একমাত্র তখনই অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে বলা যেতে পারে। বিশেষ করে গত ন’মাসের কর সংগ্রহ যেখানে এখনও ১৪% নীচে।
অর্থ মন্ত্রকও বিবৃতিতে বলেছে, কর আদায় রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছনোর অন্যতম কারণ কর ফাঁকি ও ভুয়ো বিল দেখিয়ে আগে মেটানো করের টাকা ফেরত পাওয়ার মতো ঘটনায় আগল দেওয়াও। অসাধু ব্যবসায়ীদের এই ধরনের প্রতারণা রুখে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে যে ব্যবস্থাগুলি চালু করেছে তারা, কাজে দিয়েছে।
রাজকোষ ঘাটতি বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা ছিঁড়ে দৌড়চ্ছে। নভেম্বরের শেষে তা ১০.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা। পুরো ২০২০-২১ সালের লক্ষ্যে ১৩৫%। লকডাউনে ব্যবসা-বাণিজ্য দীর্ঘ দিন স্তব্ধ থাকায় কর বাবদ কেন্দ্রের আয় কমাই যার মূল কারণ। এই অবস্থায় ডিসেম্বরের জিএসটি আদায়ের হিসেব যেন মোদী সরকারের কাছে স্বস্তির বাতাস। যা আগের বছরের ডিসেম্বরের থেকে ১২% বেশি। নভেম্বরের থেকে ১০% উপরে।
অর্থ মন্ত্রকের দাবি
• ২০১৭ সালের জুলাইয়ে জিএসটি চালুর পরে গত মাসেই আদায় হয়েছে সব থেকে বেশি। অর্থনীতি যে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, সেটা আরও স্পষ্ট এই হিসেবেই। তার উপরে গত তিন মাস ধরেই যেখানে সংগ্রহ ছাড়াচ্ছে ১ লক্ষ কোটি টাকা।
• কাজে দিয়েছে জিএসটি ফাঁকি রুখতে কেন্দ্রের উদ্যোগ।
• ভুয়ো বিল আনতে সাম্প্রতিক কালে গোটা ব্যবস্থায় একাধিক বদল এনেছে সরকার। কর আদায় বেড়েছে এই সব বিধি মেনে চলতে বাধ্য হওয়াতেও।
তবুও সংশয়
• জমে থাকা চাহিদার বহিঃপ্রকাশ বিক্রি বাড়ার অন্যতম কারণ। তার উপরে উৎসবের মরসুম চলেছে ডিসেম্বর পর্যন্ত। ফলে জিএসটি আদায় বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু এই চাহিদা বৃদ্ধি স্থায়ী হবে তো?
• জানুয়ারিতে জিএসটি সংগ্রহের হিসেব হাতে আসার আগে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলা কি ঠিক?
• এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর, এই ন’মাসে জিএসটি সংগ্রহ কিন্তু এখনও আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪% কম। সে বার করোনা না-থাকলেও অর্থনীতির ঝিমুনির জেরে কর আদায় কমতে শুরু করে তখনই।
দেশে উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য অবশ্য অতিমারির আগের অবস্থায় ফেরেনি। তবে শুক্রবার অর্থ মন্ত্রকের হিসেব, আমদানি পণ্য থেকে ডিসেম্বরে সরকারের রাজস্ব বেড়েছে ২৭%। দেশীয় লেনদেনের সূত্রে (পরিষেবা আমদানি ধরে) তা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮% বেশি।
বণিকসভা সিআইআইয়ের ডিরেক্টর চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘জিএসটি থেকে রাজস্ব যে ভাবে বাড়ছে তাতে স্পষ্ট শিল্প ছন্দে ফিরছে। আমদানি পণ্য থেকে রাজস্ব বৃদ্ধি প্রমাণ করে লকডাউনের ক্ষত সারিয়ে বৃদ্ধির কক্ষপক্ষে পা রাখছে অর্থনীতি।’’ তবুও এখনই অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রমাণ হিসেবে জিএসটিকে এগিয়ে দিতে রাজি নন অনেকে। তাঁরা বলছেন, আশা করা ভাল। কিন্তু সেটা আত্মতুষ্টিতে পরিণত হলে মুশকিল। বরং ঘুরে দাঁড়ানোর জমি তৈরিতে মন দেওয়া বেশি জরুরি।