National Credit Policy

বাজারের হাল আরও খারাপের দিকে, মানল রিজার্ভ ব্যাঙ্কও

সরকারি তথ্যই বলে দিচ্ছে— মানুষ বাজার নিয়ে সংশয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ভয় পাচ্ছেন আগামী দিন আরও খারাপ হবে এই ভেবেই।

Advertisement

সুপর্ণ পাঠক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২০ ১৯:২৯
Share:

অর্থনীতির মরা গাছে যাঁরা সবুজ প্রাণের ছোঁয়া দেখেছিলেন, তাঁদের বিমর্ষ করেই শীর্ষ ব্যাঙ্ক আশঙ্কার ডঙ্কা বাজিয়ে দিল। বাজার আরও ডুববে মেনে নিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। বৃহস্পতিবার রাতেই আমরা এটা জেনে গিয়েছি। শক্তিকান্ত দাস আরও সুদ কমানোর কথা না বলায় অবশ্য অবসরপ্রাপ্তরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। কিন্তু সত্যি কি অবসরপ্রাপ্তদের কোনও লাভ হয়েছে?

Advertisement

আপনি যদি উত্তরটা জানতে চান, তা হলে তা একটা শব্দেই চুকিয়ে দেওয়া যায়— ‘না’। উল্টে আপনার সারা জীবনের সঞ্চয়ের টাকা অবসরের পর ব্যাঙ্কের আমানত হিসাবে রেখে সুদ যদি ৬ শতাংশের একটু উপরে পেয়ে থাকেন, তা হলে জানবেন— আপনি ব্যাঙ্ককেই টাকা দিচ্ছেন আপনার সঞ্চয় রাখার জন্য। কারণ প্রকৃত সুদ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখন শূন্যের তলায়!

কিন্তু তবুও আমরা ব্যাঙ্কেই টাকা রাখছি! দাবি যাই হোক না কেন, সরকারি তথ্যই বলে দিচ্ছে— মানুষ বাজার নিয়ে সংশয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ভয় পাচ্ছেন আগামী দিন আরও খারাপ হবে এই ভেবেই।

Advertisement

তত্ত্ব বলে— সুদের হার থেকে মূল্যবৃদ্ধির হার বাদ দিলে যা থাকে তা হল প্রকৃত সুদের হার। কারণ? এই ভাবে বুঝুন ব্যাপারটা— যদি জিনিসপত্রের দাম না বাড়ত তা হলে আজকে সুদের হার আসলে কী হত? মূল্যবৃদ্ধির হার, সুদের হার থেকে বাদ দিলে আমরা যেটা পাই সেটা হল সেই সুদ যেটা জিনিসপত্রের দাম এক থাকলে আমরা হাতে পেতাম। তাই আজ যদি ৬ শতাংশ সুদের হার হয়, আর জিনিসপত্রের দাম বাড়ে ওই ৬ শতাংশ হারেই— তা হলে কিন্তু আপনার প্রকৃত সুদের হার গিয়ে দাঁড়ায় ওই শূন্যতে! আর দাম বাড়ার হার আরও চড়লে তো সুদের হার শূন্যের তলায়!

অনেকেরই হয়ত মনে আছে, লকডাউন ২.০ চলাকালীন প্রকাশিত একটা খবরের কথা। আঙুর চাষিরা তাদের আঙুর বিলিয়ে দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়। অনেকেই আবার সেই আঙুর নিয়ে যাওয়ার জন্য পয়সাও নাকি দিয়েছেন! তার মানে দাঁড়াল— চাষিরা আঙুর বিক্রি করছেন শূন্যের তলার দামে!

সুদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা কিন্তু এখন তাই দাঁড়িয়েছে। আপনি ব্যাঙ্ককে আপনার টাকা রাখার জন্য উল্টে সুদ দিচ্ছেন প্রকৃত সুদের হার শূন্যের তলায় নেমে যাওয়ায়! পশ্চিমি দুনিয়ায়, বাজারে ধার নেওয়া বাড়াতে সুদের হার তলানিতে ঠেলার কৌশল বেশ পুরনো। কারণ এতে সঞ্চয়ের থেকে ঋণে লাভ বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে শীর্ষ ব্যাঙ্ক এই রাস্তায় আগে হাঁটেনি। তার অনেক কারণের মধ্যে একটা হল সাধারণ মানুষের স্বার্থ।

সুদের হার শূন্যের তলায় গেলে সঞ্চয়ের থেকে ঋণ নেওয়াটাই লাভের। কারণ প্রকৃত সুদের হার শূন্যের তলায় গেলে আপনি যাকে টাকা দিচ্ছেন তাঁকে টাকা নেওয়ার জন্য আপনি আবার নিজের পকেট থেকে আরও কিছু দিচ্ছেন। নীতি নির্ধারকরা ভেবেছিলেন এ ভাবেই ঘুরিয়ে দেবেন অর্থনীতিকে। কিন্তু মাথায় রাখেননি একটা প্রয়োজনীয় কথা। বাজার ঘোরে বিনিয়োগে। সত্যি। বিনিয়োগ খরচ কম হলে, লোকে বেশি করে বিনিয়োগ করতে চাইতে পারে। সত্যি। কিন্তু তারও আগে দরকার বাজারের উপর আস্থা। আর সেই আস্থা তৈরি করতেই ব্যর্থ হয়েছেন নীতি নির্ধারকরা। বলছে সরকারি তথ্যই। আর তার সমর্থন করছে শীর্ষ ব্যাঙ্কেও।

ফিরি সেই কেন-র উত্তরে। আপনি যদি অবসরপ্রাপ্ত হন, তা হলে আপনার আয় শুধু প্রত্যক্ষ সুদের হারের জন্যই কমছে না। আপনি যা আয় করতেন তা দিয়ে আপনার প্রয়োজন মেটানোর টাকাতেও এখন টান পড়েছে। এটার জন্য তথ্য বা তত্ত্বের প্রয়োজন নেই। মাসের হিসাবই বলে দিচ্ছে আপনার বাড়তে থাকা দুরবস্থার কথা।

কিন্তু সেটা তো আপনার ব্যক্তিগত জায়গা। তা নিয়ে সরকার খুব একটা চিন্তিত নন। তবে আপনার চিন্তার জায়গা আরও তৈরি হচ্ছে আগামীতে তা কিন্তু সঞ্চয়ের চলই বলে দিচ্ছে। কারণ, এই যুক্তিতে চললে— সঞ্চয় কমে, ঋণের বহর বাড়া উচিত। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে— তা তো হয়ইনি, উল্টে মানুষ ঋণ থেকে দুরে থেকে, যে কটি টাকা বাঁচাতে পারছেন তা অন্য কোথাও না রেখে ব্যাঙ্কেই সরিয়ে রাখছেন। তার মানে বাজার নিয়ে মানুষের মনে শঙ্কা বাড়ছে। আর যেটা আমার আপনার আয়ের পক্ষে আদৌ ভাল ইঙ্গিত নয়।

শীর্ষ ব্যাঙ্কের ঋণ ঝপ করে সুদ কমানোর পিছনে যুক্তি ছিল একটাই। সঞ্চয়ের বদলে আমার আপনার টাকাকে বিনিয়োগে ঠেলা। সোজা যুক্তি হল— বিনিয়োগের খরচ কমলে বিনিয়োগ বাড়বে। আর টাকার জোগান আসবে আমার আপনার সঞ্চয় থেকে। কিন্তু বিনিয়োগ যে করবে, বাজার থেকে সে তো আস্থা খুঁজবে! বিনিয়োগকারী যদি বাজারে আস্থা না পান, তা হলে বিনিয়োগ করে নিজেকে বিপদে কেন ফেলবেন?

চলতি বছরের জুন মাসে প্রকাশিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সমীক্ষা দেখাচ্ছে— ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে সেই যে ক্রেতাদের বাজারের উপর আস্থা পড়তে শুরু করেছে, তা কিন্তু একই ভাবে নিম্নগামীই থেকে গিয়েছে। কোভিডের চাপে তা খানিকটা তীক্ষ্ণ হয়েছে বটে, কিন্তু চলতি বছরের মার্চ মাস, মানে লকডাউনের আগেও, এই পতনের গ্রাফের পথ পরিবর্তনের কোনও চিহ্ন ছিল না।

এ বার ব্যাঙ্কের সঞ্চয়ের হারের সঙ্গে, সুদ কমা এবং ক্রেতার আস্থা যদি যোগ করি তা হলে কী দাঁড়াবে? সুদের হার কমলেও মানুষ সেই ব্যাঙ্কেই টাকা রাখছেন। কারণ, বাজারের উপর তার কোনও ভরসা নেই। তাই সুদের হার যাই হোক না কেন, ঝুঁকি বাড়িয়ে বেশি আয়ের রাস্তায় না হাঁটার থেকে ঘরের টাকা ঘরে (পড়ুন ব্যাঙ্কে) রাখাই শ্রেয় মনে করছেন। শক্তিকান্ত দাস এ সব তথ্য হাতে নিয়েই তাঁর আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। যে আশঙ্কার কথা বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন আগেই ব্যক্ত করেছিলেন, আর নীতি নির্ধারকরা তা ক্রমাগত উড়িয়ে দিয়ে এসেছিলেন। যাঁরা মরা গাছে নতুন প্রাণের সঞ্চার হতে দেখেছিলেন, তাঁরা কি আগাছার মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত খুঁজেছিলেন? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের কথায় তো তাই মনে হচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement