বাজার দিন গুনছিল দুটো জিনিস নামার আশায়। প্রথমটি সুদ। অন্যটি বর্ষা। প্রথম আশাটি বাস্তবে মিলে গিয়েছে। কিন্তু সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে পরেরটির পরিমাণ নিয়ে। এবং তা ঘটেছে একই দিনে, গত মঙ্গলবার।
সুদ কমলে সাধারণত বাজার উপরের দিকে মুখ তোলে। মঙ্গলবার কিন্তু সুদ কমানোর কথা ঘোষণা হওয়া সত্ত্বেও সেনসেক্স নেমে গিয়েছে ৬৬১ পয়েন্ট। মাত্র এক দিনে লগ্নিকারীদের শেয়ারের মোট দর নেমেছে ১,৯৮,৫৬১ কোটি টাকা। এর জন্য অবশ্যই সরাসরি দায়ী করা যায় বর্ষা নিয়ে কেন্দ্রের পূর্বাভাসকে। সুদ কমবে এমন আশা বাজারের ছিলই। সেই কারণে সুদ কমার ঘোষণা তেমন উত্তেজনা ছড়ায়নি। অন্য দিকে ঘাটতি বর্ষার ঘোষণা নিমেষের মধ্যে বিভিন্ন সূচকে রক্তাল্পতা সঞ্চার করে। দ্রুত বিক্রির চাপ লক্ষ করা যায় সর্বত্র। বাজার যথেষ্ট দুর্বল ছিল সপ্তাহের পরের দিনগুলিতেও। কেরলে বর্ষা প্রবেশ করেছে এই খবরে বাজার সাময়িক সবুজে ফিরলেও তা ধরে রাখতে পারেনি। বর্ষার উপর আমাদের অর্থনীতি কতটা নির্ভরশীল, তার ইঙ্গিত আবারও পাওয়া গেল।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী এ বার দেশে গড়ে বৃষ্টি হতে পারে স্বাভাবিকের ৮৮ শতাংশ। এই আগাম অনুমান যদি বাস্তবে মেলে, তবে যথেষ্ট দুঃখের কারণ আছে। এতে ফসল কম হবে। ফলে খাদ্যের দাম বাড়বে। বাড়বে মূল্যবৃদ্ধির হার। ক্ষীণ হবে পরের দফায় সুদ কমার সম্ভাবনা। ফসল কম ফললে কমবে গ্রামের মানুষের আয়, কমবে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা। মার খাবে বিশেষ করে ভোগ্যপণ্য, কৃষি রসায়ন, বাইক, মোপেড এবং ছোট গাড়ি শিল্প। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে শহরের মানুষেরও খরচের ক্ষমতা কমবে। ফলে সর্বত্র চাহিদা কমার আশঙ্কা প্রবল হবে। এই সব ভয়ই গ্রাস করেছে লগ্নিকারীদের।
এ বার বর্ষা আসছেও একটু দেরি করে। বৃষ্টিতে ঘাটতি অবশ্য সর্বত্র সমান হওয়ার কথা নয়। দীর্ঘমেয়াদি গড়ের তুলনায় বর্ষা ৯৬ থেকে ১০৪ শতাংশ হলে তাকে স্বাভাবিক ধরা হয়। স্বাভাবিকের থেকে কম ধরা হয় বর্ষা ৯০ থেকে ৯৬ শতাংশ হলে। ৯০ শতাংশের কম বর্ষণ হলে তাকে ঘাটতির পর্যায়ে ফেলা হয়। আশঙ্কা, এ বারের বর্ষা ঘাটতির পর্যায়ে পড়বে। তথ্য অনুযায়ী, উত্তর পশ্চিম ভারতে বৃষ্টিপাত হতে পারে ৮৫ শতাংশ, মধ্য ভারতে ৯০ শতাংশ, পূর্ব এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৯০ শতাংশ এবং দক্ষিণাঞ্চলে ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ সবথেকে কম বৃষ্টি হতে পারে রাজস্থান, গুজরাত এবং মহারাষ্ট্রের কোনও কোনও অঞ্চলে। সামগ্রিক ভাবে ব্যাপারটা ভয় জাগায় বটে। তাই সবাই চাইছেন, আবহাওয়া দফতরের এই আগাম বাণী যেন ভুল প্রমাণিত হয়। এই অনুমান কতটা মিলতে পারে সে সম্পর্কেও তথ্য দেওয়া হয়েছে। ৬৬ শতাংশ সম্ভাবনা— বর্ষায় এ বার ঘাটতি (৯০ শতাংশের কম) থাকবে। ২৭ শতাংশ সম্ভাবনা— বৃষ্টি স্বাভাবিকের থেকে কম হবে।
বিনিয়োগের দৃষ্টিকোণ থেকে সময়টা আদৌ ভাল নয়। জাতীয় উৎপাদন যে হারেই বেড়ে থাকুক, বিভিন্ন সংস্থার আর্থিক ফলাফল কিন্তু বেশ খারাপ হয়েছে। তার উপর কম বর্ষার আশঙ্কা। এই অবস্থায় বাজার শক্তি পাবে কোথা থেকে? বিশ্ব বাজারও যথেষ্ট টলমল। একমাত্র ভাল খবর হল, তেল রফতানিকারী দেশগুলির সংগঠন ওপেক আগামী ৬ মাসে উৎপাদন কমাচ্ছে না। অর্থাৎ তেলের দাম এখনই বাড়ার সম্ভাবনা অনেক কম।
বাজার এতটা দুর্বল হয়ে পড়ায় নতুন ইস্যু এবং বিলগ্নিকরণের জন্য প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হল। সর্বোচ্চ জায়গা থেকে বাজার নেমেছে কম-বেশি ১০ শতাংশ। আরও কিছুটা নামতেই পারে।
মনে রাখতে হবে, এই ধরনের পতনই সুযোগ করে দেয় কমা জলে মাছ ধরার। ভাল শেয়ার অল্প অল্প করে জমাতে হবে এই সুযোগে। তবে বর্তমান বাজারে খুব চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। নজর রাখতে হবে দেশের এবং বিশ্ব বাজারের গতিবিধির উপর। লগ্নি করতে হবে এমন শিল্পে, যা কম বৃষ্টিতে তেমন ক্ষতির মুখে পড়বে না এবং অন্য দিকে সুদ কমায় বেশ লাভবান হবে। ভাল শেয়ার আগে থেকে বাছাই করে রেখে, তা বাজার থেকে তুলে নিতে হবে পতনের হাত ধরে।
বর্ষার ঘাটতি নিয়ে দুর্ভাবনা চিরকাল থাকবে না। বাজারকে এক সময়ে উঠতেই হবে। তাই ভাল শেয়ার কেনা ছাড়াও সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়া যায় ভাল মিউচুয়াল প্রকল্পেও।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রেপো রেট ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমানোয় নতুন করে সুদ কমানো হচ্ছে বিভিন্ন আমানত প্রকল্পে। সুদের হার কমা সত্ত্বেও বন্ডের বাজার দর কিন্তু তেমন ভাবে বেড়ে ওঠেনি। এক দিকে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং অন্য দিকে সুদ কমতে থাকায় ভাল রকম সমস্যায় পড়বেন অসংখ্য সুদ নির্ভর মানুষ। ব্যাঙ্ক-জমায় সুদ আরও কমলে ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পগুলির চাহিদা আগামী দিনে বাড়তে পারে।
প্রসঙ্গত, সাধারণ মানুষের লগ্নি নিয়ে অনেক ভাল পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিনিয়োগ-গুরু ওয়ারেন বাফে। তাঁর দেওয়া কিছু টোটকা দেওয়া হল সঙ্গের সারণিতে। মেনে চলতে পারলে দীর্ঘ মেয়াদে উপকার হতে পারে।