এ বারের মতো দুর্গাপুজো শেষ। এই সময়টা কেমন যেন তিতকুটে লাগে। আবার সেই এক বছরের প্রতিক্ষা। উৎসবের এখনও বেশ কিছুটা বাকি। কিন্তু তা-ও মন খারাপ ঘিরে ধরে আমাদের। অথচ কাজে তো ফিরতেই হবে! আবার ভাবতে হবে কী ভাবে অল্প অল্প করে টাকা জমানো যায়, যাতে আগামী দিনগুলো একটু ভাল থাকার পাথেয় তৈরি হয়। শুধু জমানোই নয়, নজর দিতে হবে টাকা-পয়সা বাড়ানোর কাজেও। কিন্তু প্রশ্ন হল টাকা জমাতে যাবেন কোথায়? ব্যাঙ্ক, ডাকঘরের সুদ যেখানে ঠেকেছে, তাতে শুধু এর হাত ধরে মূল্যবৃদ্ধিকে টেক্কা দেওয়া শক্ত। আবার শেয়ার বাজার একে তো ঝুঁকির জায়গা, কেন্দ্রের দাওয়াইয়ে তা কিছুটা উঠলেও, গত কয়েক দিন ফের সূচক বেশ অস্থির। বাকি রইল বন্ড বা ঋণপত্রে লগ্নি। তাই দেখতে হবে এই টালমাটাল অর্থনীতির আবহে কেমন আছে লগ্নির এই ঠিকানা? সুদ পাওয়া যাচ্ছে কেমন? লগ্নি করা যায় কি? তার ঝুঁকি কতটা? ঝুঁকি থাকলে, তা এড়িয়ে লগ্নির পথ আছে কি?
আজ ঋণপত্রের বাজারে উঁকি মেরে এমনই হাজারো প্রশ্নের উত্তর খুঁজব আমরা। কারণ পরিস্থিতি যা-ই হোক, সঞ্চয় বাড়াতেই হবে। আর সেই কাজে ভারসাম্য বজায় রাখতে, লগ্নিও করতে হবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ফলে দেখেশুনেই সে পথে পা বাড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ।
গোড়ার কথা
শেয়ার, ব্যাঙ্ক আমানত নিয়ে যতটা চর্চা আমাদের মধ্যে হয়, ততটা বন্ড নিয়ে হয় না। অথচ শেয়ারের চেয়ে কম ঝুঁকির প্রকল্পের কথা যদি ভাবি, তা হলে বন্ড বেশ ভাল জায়গা। প্রথমে চলুন দেখে নিই বন্ড বলে কাকে।
• এক কথায় বলতে গেলে বন্ড হল ঋণপত্র। বাজারে তা ছেড়ে টাকা তোলে কোনও দেশের সরকার, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা। কোনও বন্ড কেনার অর্থ যে ওই ঋণপত্র বাজারে ছাড়ছে, তাকে ঋণ দেওয়া।
• বন্ড কেনার বদলে লগ্নিকারী পান সুদ। যা পরিচিত কুপন রেট নামে।
• কোনও সংস্থার শেয়ার কেনা মানে আপনি অন্তত খাতায়-কলমে তার আংশিক মালিক। বন্ডের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। এখানে আপনি খুব বেশি হলে ঋণদাতা। অধিকাংশ বন্ডেরই নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। তা ফুরোনোর পর সুদ-আসল হাতে পেলেই সংস্থার সঙ্গে আপনার সম্পর্কে দাঁড়ি।
• এমনিতে বলা হয় শেয়ারের তুলনায় বন্ডের সুরক্ষা বেশি। তবে এতে একেবারে যে ঝুঁকি নেই, তা নয়। কারণ, নিয়ম অনুসারে সুদের হারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজারে বন্ডের দর ওঠানামা করে। যে কারণে বন্ডে লগ্নির আগে সুদ কত যাচ্ছে, তা দেখে নেওয়ার কথা বলা হয়।
• বেশির ভাগ বন্ডে মেয়াদ ফুরোনোর আগে ভাঙানোর সুবিধা থাকে না। তাই অনেক ক্ষেত্রে বন্ড বাজারে নথিবদ্ধ করা হয়। যাতে ক্রেতারা সেখান থেকেই তা কিনতে পারেন।
• ওই সমস্ত নথিবদ্ধ বন্ড শেয়ারের মতো ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কেনাবেচা করা যায়। পড়তি সুদে বন্ডের দাম অনেক সময় বাড়ে। সেই পরিস্থিতিতে পুরো সময়ে বন্ড ধরে না-রেখে তখনই সেটি বিক্রি করলে মূলধনী লাভের সম্ভাবনা থাকে।
• বাজারে বিভিন্ন ধরনের বন্ড রয়েছে। কোনওটাতে সুরক্ষা বেশি, কোনওটাতে কম। যে কারণে কোনও সংস্থার বন্ড কেনার আগে অবশ্যই রেটিং দেখতে হবে।
লগ্নি কী ভাবে?
সাধারণত তিন ভাবে বন্ডে লগ্নি করা যায়—
• প্রথম যখন বাজারে বন্ড ছাড়া হচ্ছে, তখন তা সরাসরি কেনা যায়।
• এক বার বাজারে বন্ড ইসু হয়ে যাওয়ার পরেও তাতে টাকা ঢালা যায়। সে জন্য বন্ডের বাজারদরে তা কিনতে হবে। যা কি না ব্যাঙ্কের সুদের হারের উপরে অনেকটাই নির্ভর করে।
• বিভিন্ন ধরনের ঋণপত্র নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা ঢেলে বন্ডে লগ্নি করা সম্ভব।
আয়ের সূত্র
তিন ভাবে বন্ড থেকে রিটার্ন মেলে—
• বন্ড কেনার পরে তা থেকে প্রাপ্য সুদ। ১০০ টাকা দামের বন্ড বছরে ১০ টাকা সুদ দিলে, তার কুপন ১০%।
• ওই কুপন না-তুললে, তা ফের বন্ডেই বিনিয়োগ হয়। ফলে সেটা কুপনের উপরে বাড়তি সুদ। তার মানে, প্রথম বছরে কুপন হিসেবে পাওয়া ওই ১০ টাকার উপরেও দ্বিতীয় বছরে তার ১০% (১ টাকা) সুদ পাওয়া যাবে।
• বাজারে দরের ওঠা-নামায় ১০০ টাকায় কেনা বন্ড ১১০ টাকায় বেচতে পারলে, তা থেকেও মুনাফা ১০ টাকা।
এই তিন ধরনের প্রাপ্তি মিলিয়ে যে-মুনাফা হাতে আসবে, তা মোট বিনিয়োগের অনুপাতে কতখানি, সহজ কথায় তা-ই হল ওই বন্ডের ইল্ড। বন্ড বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এই ইল্ড কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সুদের বিপরীত পথে হেঁটে
বন্ডের বাজার দর ব্যাঙ্কের সুদের উল্টো দিকে হাঁটে। অর্থাৎ ব্যাঙ্ক-জমায় সুদ কমলে, বন্ডের দাম বাড়ে। আর সুদ বাড়লে, দাম কমে। কারণ—
মনে করুন, বন্ড আর ব্যাঙ্ক, দু’জায়গাতেই এখন সুদ পাওয়া যাচ্ছে ৭% হারে। এ বার আপনি ১,০০০ টাকা দামের বন্ড কিনলেন। এ বার ব্যাঙ্কে সুদ কমে হল ৬%। তখনও কিন্তু বন্ডে ৭ শতাংশই সুদ পাওয়া যাবে। ফলে ওই সময়ে সামান্য বেশি দামে ওই বন্ড কেনা হলেও, শেষ পর্যন্ত গিয়ে বেশি টাকাই আসবে আপনার ঘরে। এই কারণেই ব্যাঙ্কে সুদ কমলে, বন্ডের চাহিদা বাড়ে। ফলে তার দরও বাড়ে।
আবার ধরুন ব্যাঙ্কে সুদ বাড়ছে। তখন বন্ডের চাহিদা কমবে। ফলে কমবে তার দামও। তবে হাতফেরতা বন্ডের বাজারে (সেকেন্ডারি মার্কেট) ঋণপত্রের দর পড়ে গেলেও, মেয়াদ ফুরোনো পর্যন্ত তা ধরে রাখলে, পুরো টাকাই ফেরত মেলে।
• রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ঋণনীতিতে টানা কয়েক বার সুদের হার কমানোয় ব্যাঙ্ক আমানতেও সুদের হার নেমেছে অনেকটাই। ফলে এখন বন্ডের বাজার বেশ ভাল চলছে।
তবে বিভিন্ন সংস্থার আমানতে সুদ এখনও ৭.৭৫-৮.৩০ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে ঠিকই। যদি সেখানে টাকা রাখার কথা ভাবেন, তা হলে কিন্তু অবশ্যই ঝুঁকি দেখে নিতে হবে।
দেখুন রেটিং
কোনও বন্ডে টাকা ঢালার আগে তার রিটার্ন বা ইল্ড কেমন হবে, তা নিয়ে খোঁজ খবর করি আমরা। কিন্তু আমার মতে আরও বেশি জরুরি ঝুঁকি খতিয়ে দেখা। আর সে জন্য চোখ রাখতে হবে বন্ডের রেটিংয়ের দিকে। বিশেষ করে গত বছরে আইএল অ্যান্ড এফএস কাণ্ড সামনে আসার পরে যে ভাবে বিভিন্ন সংস্থার ঋণপত্রের মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তাতে আরও বেশি করে এই বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরি। সুদ না-হয় একটু পাওয়া গেল, কিন্তু লগ্নি করা পুরো টাকার ভবিষ্যৎ নিয়েই যাতে প্রশ্ন না-ওঠে, তা আগে দেখতে হবে।
সাধারণত বলা হয়, সরকারি বন্ডের সুরক্ষা সবচেয়ে বেশি। সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ইসু করা বন্ডের সুরক্ষাও বেশ ভাল।
কোন বন্ড কতটা সুরক্ষিত, তার রেটিং দেখে সেই সম্পর্কে কিছুটা আঁচ পাওয়া যেতে পারে। এমনিতে মনে করা হয় যে, সুরক্ষার দিক থেকে ‘AAA’ রেটিংযুক্ত বন্ডই সবচেয়ে ভাল। রেটিং এর থেকে কম হলে সুদ সাধারণত একটু বেশি হয়। অর্থাৎ ঝুঁকির সঙ্গে সুদও পাল্টে যায়। সংস্থাগুলি সেই ঝুঁকির বদলে বেশি সুদ দেয়।
এটা ঠিক যে সব সময়ে রেটিং দেখেই বলা যায় না যে আগামী দিনে কী হবে। যেমন দেখুন, গত বছরে সামনে এসেছে আইএল অ্যান্ড এফএস কাণ্ড। অথচ সেই সংস্থার ঋণপত্রের বেশ ভাল রেটিংই ছিল।
সেই কারণেই তার ক্রেডিট রেটিংকে (ঋণের টাকা ফেরত পাওয়া সংক্রান্ত ঝুঁকির মূল্যায়ন) গুরুত্ব দিতে হবে। রেটিং যত ভাল, তাকে ঋণ দেওয়া তত কম ঝুঁকির।
নজর থাকুক মেয়াদে
যে কোনও বন্ডেরই নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। সাধারণ ভাবে বন্ডের মেয়াদ বেশি হলে সুদও একটু বেশি হয়। যে সংস্থা বন্ড ছাড়ছে, তার স্থায়িত্ব ও ভাল ব্যবসার নিশ্চয়তা থাকলে বড় মেয়াদের বন্ড কেনা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, কত দিন পরে গিয়ে আপনার টাকার প্রয়োজন হচ্ছে, সেটাই ঠিক করবে আপনার লগ্নির মেয়াদ কত হবে। ধরুন, আপনি তিন বছর পরে বন্ড ভাঙাতে চান। সে ক্ষেত্রে পাঁচ বছরে গিয়ে মেয়াদ শেষ হওয়া কোনও বন্ডে নিশ্চয়ই লগ্নি করবেন না।
আমার মতে, আপাতত সুদের হার এবং শেয়ার বাজার যে রকম অস্থির, তাতে কম মেয়াদের বন্ডে লগ্নি করাই যুক্তিযুক্ত। সে ক্ষেত্রে সরাসরি বন্ড না-কিনে টাকা রাখতে পারেন ফান্ডে। এতে তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনতা থাকে প্রকল্প ছেড়ে বেরোনোর। এ জন্য বাছতে পারেন লিকুইড ফান্ড, মানি মার্কেট ফান্ড, আলট্রা শর্ট টার্ম ফান্ড, শর্ট টার্ম ফান্ড ইত্যাদি।
আর যদি বন্ডেই টাকা রাখতে চান, তা হলে মাঝারি মেয়াদ (সাধারণত ৫-৮ বছর) ও বেশি মেয়াদের (৮-১২ বছর) বন্ড বাছতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে তার থেকেও বেশি মেয়াদের বন্ড পাওয়া যায়। তবে এখন তা থেকে দূরে থাকাই ভাল।
খেয়াল রাখুন সুদ
• বিভিন্ন সংস্থার বন্ডে নানা সুদ মেলে। এখন মোটামুটি ভাবে এক বছর মেয়াদের বন্ডে সুদ পাওয়া যাচ্ছে ৬%-৮%। কিছু বন্ড অবশ্য বেশি সুদ দিতে পারে। কিন্তু দেখতে হবে সেগুলি যথেষ্ট সুরক্ষিত কি না।
• সাধারণত বন্ডে সুদ দেওয়া হয় প্রতি মাসে, তিন মাসে, ছ’মাসে অথবা বছরে এক বার। ছ’মাস, এক বছর অন্তর সুদ নিলে সুদ একটু বেশি হয়। তা সরাসরি পাঠানো হয় লগ্নিকারীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।
• বন্ডের পুরো মেয়াদে সুদ একই থাকে। সাধারণত প্রথমবার বাজারে আসার সময়ে সুদের হার ঠিক হয় মূল্যবৃদ্ধির হার, রেপো রেট, ব্যাঙ্কে সুদ, ভবিষ্যতে সুদের সম্ভাব্য গতিবিধি ইত্যাদির উপরে ভিত্তি করে।
কর লাগবেই?
• করমুক্ত বন্ড ছাড়া বাকি সব বন্ডের সুদ করযোগ্য।
• কয়েক বছর আগে পর্যন্ত কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে কয়েক বছরের জন্য করমুক্ত বন্ড ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এখনও এই বন্ড কেনা যেতে পারে বাজার থেকে।
• করের অঙ্ক ঠিক হয় ক্রেতার প্রযোজ্য করের হার অনুসারে।
• মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে তার নিয়ম অনুসারে কর ধার্য হবে।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)