ফের সেই মূল্যবৃদ্ধিই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুদের হার কমানোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। যার ফলে কমলো না বাড়ি বা গাড়ি কেনার ঋণের মাসিক কিস্তি বা ইএমআই।
মঙ্গলবার ঋণনীতির পর্যালোচনায় রেপো রেট কমানোর রাস্তায় হাঁটল না রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ফলে ব্যাঙ্কগুলির পক্ষে এখনই সুদ কমানো সম্ভব হবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আগের মতোই রেপো রেট ৮%, রিভার্স রেপো রেট ৭% ও নগদ জমার অনুপাত বা সিআরআর (আমানতের যে-অংশ বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ককে বাধ্যতামূলক ভাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে গচ্ছিত রাখতে হয়) ৪ শতাংশে বেঁধে রেখেছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন। প্রসঙ্গত, বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি যে-হারে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে স্বল্প মেয়াদি ঋণ নেয়, সেটাই রেপো রেট। অন্য দিকে, শীর্ষ ব্যাঙ্ক যে-হারে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের থেকে ঋণ নেয়, সেটা রিভার্স রেপো রেট।
তবে বাজারে নগদ টাকার জোগান বাড়াতে বিধিবদ্ধ জমার অনুপাত বা স্ট্যাটুইটরি লিকুইডিটি রেশিও (এসএলআর) ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে করা হয়েছে ২২%। ব্যাঙ্কগুলি যতটা আমানত সংগ্রহ করে, তার যে-অংশটি বাধ্যতামূলক ভাবে সরকারি ঋণপত্রে বিনিয়োগ করতে হয়, তাকেই বলে এসএলআর। ওই হার কমানোর ফলে ব্যাঙ্কগুলির হাতে মোট ৪০ হাজার কোটি নগদ টাকার জোগান বাড়বে। আর এর ফলে তারা ঋণের পরিমাণ বাড়াতে পারবে বলে আশা বিশেষজ্ঞদের।
বাজারে নগদ টাকার জোগান বাড়াতে আরও একটি পদক্ষেপ করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ‘হেল্ড টু ম্যাচিওরিটি’ (এইচটিএম) খাতে বাধ্যতামূলক ভাবে ঋণপত্র রাখার হারও কমানো হয়েছে। আগে তা ছিল এসএলআর খাতে রাখা মোট ঋণপত্রের ২৪.৫%। ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে তা করা হয়েছে ২৪%। ওই খাতে রাখা ঋণপত্র মেয়াদ পূর্তির আগে বিক্রি করতে পারে না ব্যাঙ্কগুলি। ঋণপত্র রাখার আরও দুটি খাত রয়েছে। এর মধ্যে একটি হল ‘অ্যাভেলেব্ল ফর সেল’ (এএফএস)। ওই খাতে রাখা ঋণপত্র সুযোগ বুঝে প্রয়োজন মতো যখন খুশি ব্যাঙ্কগুলি বাজারে বিক্রি করতে পারে। অপর খাতটি হল ‘হেল্ড ফর ট্রেডিং’ (এইচএফটি)। এই খাতে রাখা ঋণপত্র বাজারে ঘন ঘন কেনাবেচা করা যায়।
এইচটিএমের হার কমিয়ে দেওয়ায় এখন থেকে অন্য দুই খাতে বেশি করে ঋণপত্র রাখতে পারবে ব্যাঙ্কগুলি। অর্থাৎ ঋণপত্র বেচে চটজলদি নগদ টাকা জোগাড়ের ব্যবস্থা করার আরও একটি পথ খুলে দিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই সব ব্যবস্থায় শেয়ার বাজার খুশি। যার ফলে এ দিন সেনসেক্স বেড়েছে ১৮৪.৮৫ পয়েন্ট। থিতু হয়েছে ২৫৯০৮.০১ অঙ্কে। ডলারের সাপেক্ষে টাকার দামও এ দিন ৯ পয়সা বেড়েছে। এক ডলারের দাম এসে দাঁড়িয়েছে ৬০.৮৪ টাকায়।
ব্যাঙ্কগুলির হাতে নগদ টাকার জোগান বাড়ানোকে স্বাগত জানিয়েছেন বন্ধন ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান চন্দ্রশেখর ঘোষ। তিনি বলেন, “এর ফলে ব্যাঙ্কের তহবিল সংগ্রহের খরচ কমবে। বিশেষ করে আমাদের মতো নতুন ব্যাঙ্কগুলি এতে উপকৃত হবে। হাতে নগদের জোগান বাড়লে ব্যাঙ্কগুলি আরও বেশি করে ঋণ দিতে পারবে। বাড়বে তাদের মুনাফা।” এ দিন ঋণনীতির পর্যালোচনায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে-সব ব্যবস্থা নিয়েছে, তা দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাঙ্কগুলির স্বাস্থ্য ফেরাতে সাহায্য করবে বলে মন্তব্য করেন ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞ এবং ইউকো ব্যাঙ্কের প্রাক্তন এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর বি কে দত্ত। তিনি বলেন, “রাজন যে ব্যবস্থাগুলি নিয়েছেন, তা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রেখে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়াতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া রাজকোষ ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দিকেও নজর দিয়েছেন তিনি। শীর্ষ ব্যাঙ্কের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, এই অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতি ৪.১ শতাংশে বেঁধে রাখার যে-লক্ষ্যমাত্রা কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করেছে, তা যাতে পূরণ করা যায়, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া। আমার বিশ্বাস এতে লগ্নিকারীদের আস্থা বাড়বে।”
তবে সাধারণ ভাবে শিল্পমহল অবশ্য সরাসরি সুদ না-কমায় অখুশি। বণিকসভা সিআইআইয়ের ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এক দিকে শিল্প বৃদ্ধির হার তলানিতে এসে ঠেকেছে, অন্য দিকে খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার কমার দিকে। পাশাপাশি বর্ষা কিছুটা ভাল হওয়ার আশা দেখা দেওয়ায় সার্বিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ঝুঁকি আরও কমার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থায় সুদের হার কমানোর জন্য পদক্ষেপ করা উচিত ছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের।”