মাত্র কয়েক দিন আগের কথা। রাজ্যের কয়েকটা জেলাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে গেল আমপান। চোখ বুজে ছবিটা আরও এক বার মনে করার চেষ্টা করুন তো। কী ভয়ঙ্কর!
তার পর? ধীরে ধীরে ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছে আক্রান্ত এলাকাগুলো। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছেন মানুষ। তাঁরা জানেন, এই ক্ষয়ক্ষতি অল্প সময়ে পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে যে।
অতিমারির অপ্রত্যাশিত ঝড়ে লগ্নি বিধ্বস্ত। কয়েক বছর ধরে সাজিয়ে তোলা আর্থিক তহবিল কার্যত দিশাহীন। বহু মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটের দাম (ন্যাভ) নিম্নমুখী। বেশ কিছু এসআইপিও সঙ্কটে। করোনা ও তার ধাক্কা সামলাতে ঘরবন্দি দশা আমাদের প্রতিটি নয়া পয়সার ভবিষ্যৎকে দাঁড় করিয়েছে প্রশ্নচিহ্নের মুখে। কিন্তু ভাবুন অনেকের থেকেই তুলনায় হয়তো ভাল আছেন আপনি। এ বার চ্যালেঞ্জ, জমিয়ে রাখা তহবিলকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করা। সেই লক্ষ্যে ফান্ড, এসআইপির মতো বাজার নির্ভর প্রকল্পগুলিকে এখন কী ভাবে পরিচালনা করতে হবে তা নিয়েই আজকের আলোচনা।
প্রশ্ন যেখানে
এই অনিশ্চিত সময় সঞ্চয় বা লগ্নির নতুন কৌশল ছকতে গিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন বেশির ভাগ মানুষের মনেরই উঁকি দিচ্ছে। সেগুলি হল—
• এখন শেয়ার নির্ভর প্রকল্প কী ভাবে নির্বাচন করা উচিত?
• ঋণপত্র নির্ভর বা সাবেক লগ্নি প্রকল্পই বা বাছবেন কী ভাবে?
• অনেক ফান্ড বা এসআইপি পোর্টফোলিয়োর অবস্থা এমনিতেই শোচনীয়। পুরোনো সেই লগ্নিকে কোন কৌশলে নতুন ভাবে সাজিয়ে তোলা যাবে? কী ভাবে ঘুরিয়ে দাঁড় করানো যাবে ইতিমধ্যেই ঢালা মূলধনকে?
• আর নতুন লগ্নিকারী? তাঁদের লগ্নি কৌশল কেমন হওয়া উচিত?
মনের মধ্যে ধোঁয়াশা
লগ্নি হল নানান ফুল দিয়ে সাজিয়ে তোলা বোকের মতো। তাতে যেমন মেয়াদি আমানত, ডাকঘরের প্রকল্প থাকে, তেমনই থাকে শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, ফান্ডের এসআইপি, ঋণপত্রও। করোনার আক্রমণে সেই বোকেই পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। লগ্নিকারীরা এখন ফের তাকে গুছিয়ে তুলতে ব্যস্ত। সেই কাজে নতুন কিছু ঝোঁক চোখে পড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। যার কারণ হয়তো মনের মধ্যে জমাট বাঁধা ধন্দ।
• ক’মাস আগে পর্যন্ত ফান্ড, এসআইপি, ইএলএসএসের মতো শেয়ার বাজারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রকল্পের দিকে লগ্নিকারীরা ঝুঁকছিলেন বেশি। ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা ছিল। এখন অনিশ্চয়তার বাজারে তাঁদের একাংশ ব্যাঙ্কে রাখতে চাইছেন বাড়তি নগদ। লগ্নি করছেন কম। আর করলেও সেটা আগের তুলনায় রক্ষণশীল পদ্ধতিতে। এড়াতে চাইছেন শেয়ার বাজারের সঙ্গে যুক্ত প্রকল্প।
• টাকা রাখতে চাইছেন এমন প্রকল্পে যেখান থেকে রিটার্ন নিশ্চিত। নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে হাতে আসে কিছু রোজগার। হোক সেটা কম।
• যার ফলে লগ্নিকারীদের একাংশের পছন্দের নিরিখে শেয়ার বাজার বা ইকুইটি নির্ভর প্রকল্প চলে গিয়েছে পিছনের সারিতে। ঋণপত্র নির্ভর প্রকল্পে টাকা ঢালার প্রবণতা বাড়ছে।
• অনেকে আবার দীর্ঘ দিন ধরে সাজিয়ে তোলা লগ্নির কৌশলও বদল করে সেই পুঁজিকে সরাচ্ছেন ফিক্সড ডিপোজিট, পিপিএফে।
তা হলে করণীয়?
আপৎকালীন অবস্থায় যে লগ্নিকারীরা পুঁজি ঢালার কৌশল বদলাবেন এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু সুদের যা অবস্থা, তাতে মূল্যবৃদ্ধিকে হারানোই শক্ত। ফলে ফিক্সড ডিপোজিট, পোস্ট অফিসের প্রকল্প তো হাতের পাঁচ হিসেবে থাকলই। কিন্তু তার সঙ্গে আগের মতোই জোর দেওয়া উচিত বাজার নির্ভর প্রকল্পগুলিতে। কম দামে কিনতে পারলে ভবিষ্যতে মুনাফা
দেবেই। অতএব—
ক) অনেক দিন ধরে চলা এসআইপি বন্ধ করবেন না। বাজার কিন্তু সাড়া দিতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে আরও সাড়া দেবে।
খ) যদি নতুন লগ্নিকারী হন, তা হলে সিদ্ধান্তের আগে ভাবনাচিন্তায় আরও বেশি সময় দিতে হবে। তবে সব পুঁজি এক বারে ঢেলে দেবেন না। অল্প অল্প করে লগ্নি করতে থাকুন।
গ) শেয়ার বা ফান্ডে লগ্নি করলে নিয়মিত কেনাবেচাটাই দস্তুর। তবে এখন পরিস্থিতি অন্য রকম। সেই রাস্তায় না-হাঁটাই ভাল। তাতে ঝুঁকি বাড়বে। বাড়তে থাকবে লগ্নির খরচও। অতএব অহেতুক লেনদেনের সংখ্যা বাড়াবেন না।
ঘ) একটা ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। শেয়ার বা ফান্ডের পুরোনো লগ্নিতে যদি আজকের তারিখে মুনাফা থেকে থাকে, তা হলে তা ভাঙিয়ে নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন। সংস্থাগুলির ফল বার হচ্ছে। তা খারাপ হলে এবং শেয়ার দর মাথা নামালে সেই সুযোগ না-ও হতে পারে। নতুন লগ্নির ক্ষেত্রে সেই চাপ ততটা নেই।
কোথায় লগ্নি
সময় কঠিন। তবে ভবিষ্যতের জমিটাকে শক্ত রাখতে গেলে সঞ্চয়, লগ্নি তো করতেই হবে। বিকল্প নেই। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লগ্নি প্রকল্প নির্বাচনের আগে কোন কোন বিষয় মাথার মধ্যে নাড়াচাড়া করে নেবেন, সে ব্যাপারেই এ বার সংক্ষেপে আলোচনা করব। তার জন্য লগ্নির বৃহৎ ক্ষেত্রকে পরিষ্কার দু’ভাগে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। ক) শেয়ার বাজার নির্ভর বা ইকুইটি প্রকল্প। খ) ঋণপত্র নির্ভর বা ডেট প্রকল্প। তাতে আলোচনা সহজ হবে।
ইকুইটি ফান্ড
শেয়ার নির্ভর প্রকল্পে লগ্নি করলে কিছুটা সময় দিতে হবে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহে। কী সেই তথ্য?
• হুটপাট করে যে কোনও একটা ফান্ডে টাকা রাখতে শুরু করবেন না। তার আগে সংশ্লিষ্ট ফান্ডটি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করুন। যেমন, ফান্ডটির তহবিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে বণ্টন করা রয়েছে কি না, কিংবা তহবিলের মোট অঙ্কই বা কত? ফান্ডের ক্রমতালিকায় সেটি কোন জায়গায়? অতীতের পারফরম্যান্সই বা কেমন? একটু নেট ঘাঁটাঘাটি করলেই তা পাওয়া সম্ভব।
• এখনই বলছিলাম, অর্থনীতি এবং বাজার সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান থাকলে সুবিধা হবে। কেন? সে ক্ষেত্রে আপনি বুঝতে পারবেন, দোলাচলের এই বাজারে কোন কোন শিল্প ক্ষেত্র বা সংস্থার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, কার ভাগ্য ঝুলে রয়েছে। আপনার বাছাই করা মিউচুয়াল ফান্ডের তহবিলের বণ্টন যেন তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। ধরা যাক, আপনি মনে করছেন তথ্যপ্রযুক্তি কিংবা ওষুধ সংস্থাগুলি ভবিষ্যতে ভাল ফল করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আপনার ফান্ড প্রকল্পটির বিনিয়োগ যেন সেই সব সংস্থায় থাকে। আবার আপনি যদি মনে করেন বিদ্যুৎ ক্ষেত্র ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তা হলে এমন ফান্ড নিশ্চয়ই আপনার বাছা ঠিক হবে না যেটি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে বেশি লগ্নি করে।
• অবশ্যই দেখতে হবে মিউচুয়াল ফান্ডের ‘এক্সপেন্স রেশিয়ো’ কত। যে ফান্ডের ‘এক্সপেন্স রেশিয়ো’ বেশি সেখানে লগ্নি করা সাধারণ ভাবে বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
• এসআইপি কিংবা কিস্তি নির্ভর প্রকল্পে নিজের আর্থিক ক্ষমতা যাচাই করে নেওয়া উচিত। মাসে কত টাকা ঢালতে পারবেন, সেটা ভাল করে হিসেব কষে নিন। যাতে কোনও কিস্তি বাদ না-পড়ে।
ডেট ফান্ড
• ডেট ফান্ড বা ঋণপত্র নির্ভর প্রকল্পে লগ্নির সময়ে যে ব্যাপারটা সবচেয়ে আগে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন, তা হল কত দিন পরে টাকার দরকার হবে আপনার। সেই নিরিখে দেখতে হলে ডেট ফান্ডের লগ্নিকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করে টাকা ঢালা উচিত। স্বল্পমেয়াদ, মধ্যমেয়াদ এবং দীর্ঘমেয়াদ। সব রকম মেয়াদের জন্যই উপযুক্ত ফান্ড রয়েছে।
• ধরা যাক যে কোনও মুহূর্তে টাকার দরকার। তা হলে কিছুটা টাকা রেখে দিতে পারেন লিকুইড ফান্ড, মানি মার্কেট ফান্ড বা লো ডিউরেশন ফান্ডে। স্বল্পমেয়াদে হলেও তার চেয়ে কিছুটা বেশি সময় হাতে থাকলে তার জন্যও ফান্ড রয়েছে।
• আসলে মেয়াদ যা-ই হোক না কেন, ডেট ফান্ডের একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। তা হল নির্দিষ্ট মেয়াদে নির্দিষ্ট রিটার্ন দেওয়া।
• কিছুটা ঝুঁকি কিন্তু ডেট ফান্ডেও আছে। সেই ঝুঁকি দু’ধরনের। ‘ক্রেডিট রিস্ক’ এবং ‘ইন্টারেস্ট রেট রিস্ক’। ‘ক্রেডিট রিস্ক’ নির্ভর করে যে সমস্ত সংস্থার ঋণপত্রে ফান্ডটি লগ্নি করছে, সেগুলির ভিত কতটা শক্তিশালী তার উপরে’। ঋণপত্রের সুদ ঠিক সময়ে ঠিক মতো ফেরত দিতে পারবে তো? ‘ইন্টারেস্ট রেট রিস্ক’ নির্ভর করে সুদের হারের পরিবর্তনের উপরে। সেই সুদ আমাদের দেশে এখন দিনের পর দিন মাথা নামাচ্ছে।
• যে সমস্ত ডেট ফান্ডের মূল্যায়ন ভাল সেগুলির রিটার্ন কিছুটা কম হলেও সুদ এবং আসলের নিশ্চয়তা অনেক বেশি হয়। সেই নিশ্চয়তার খোঁজ যাঁরা করছেন তাঁরা এই ধরনের ফান্ডে লগ্নি করতে পারেন।
মাথায় রাখতে হবে
অর্থনীতি নিম্নমুখী। বহু কর্পোরেট সংস্থার মুনাফাও হয়তো তা-ই। অবস্থা কবে বদলাবে জোর দিয়ে তেমন বলতে পারছেন না কোনও বিশেষজ্ঞই। অথচ সংস্থাগুলির শেয়ারের দামের প্রভাব পড়ে ফান্ডে। এই অবস্থায় সাধারণ লগ্নিকারীদের কৌশল কী হবে?
• আগেই বলেছি, শেয়ার বা শেয়ার নির্ভর প্রকল্পে পুঁজি ঢাললে চারপাশে ঘটে চলা নানা ঘটনার কিছু খবরাখবর রাখতেই হবে। যেমন, লকডাউনের সময়ে পরিবহণ সীমিত। পর্যটন শিল্প তো কার্যত বন্ধই। কবে ঠিক মতো চালু হবে তার ঠিক নেই। এই অবস্থায় হোটেলের শেয়ার বা সেই শেয়ারে লগ্নি করা ফান্ড কেনা ঝুঁকির হয়ে যাবে নয় কি? বিশেষ করে স্বল্পমেয়াদে? আবার এই মুহূর্তে সারা বিশ্ব তাকিয়ে রয়েছে করোনার প্রতিষেধকের দিকে। যার ফলে ওষুধ সংস্থাগুলির শেয়ারের ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ছে লগ্নিকারীদের। খবরাখবর বলতে এই ধরনের সাধারণ কিছু যুক্তির কথাই বলছি আরকি।
• মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে ওপেন এন্ডেড ডাইভার্সিফায়েড ফান্ডে লগ্নি করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যাতে প্রয়োজন মতো টাকা তোলার রাস্তা খোলা থাকে। আবার দীর্ঘমেয়াদে বড় তহবিল তৈরির সুযোগও থাকে। তবে লগ্নির আগে দেখে নিতে হবে ফান্ডটি প্রথম সারির ক্ষেত্রগুলিতে মিলিয়ে মিশিয়ে টাকা ঢালছে তো? আর একটু বেশি ঝুঁকি নিতে চাইলে সেক্টর ফান্ডও বাছতে পারেন।
• ঝুঁকি আরও কমাতে চাইলে ইন্ডেক্স ফান্ডে লগ্নি করুন। সেগুলি শেয়ার বাজারের বিভিন্ন সূচক অনুযায়ী ওঠেনামে। টাকা রাখতে পারেন এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডেও (ইটিএফ)।
এড়িয়ে চলুন
• পুরোনো লগ্নির মুনাফার অংশ ঘরে তুলতে বলেছি ঠিকই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বাজারে ক্রমাগত অপ্রয়োজনীয় কেনাবেচা করতে থাকবেন। তাতে উল্টে ঝুঁকি বাড়ে। বেড়ে যায় লগ্নির খরচও।
• দীর্ঘমেয়াদে বড় মাপের তহবিল তৈরি করার জন্য এসআইপি ভাল। কিন্তু বাজার যদি নীচে থাকে এবং হাতে যদি যথেষ্ট পুঁজি থাকে, তা হলে এত ছোট অঙ্কের কিস্তি নির্ভর লগ্নি না-করে, কিছুটা বড় অঙ্কের পুঁজি ঢালাই ভাল। তাতে তেজি বাজারে লাভ বেশি হয়। সে শেয়ারে হোক, বা হোক মিউচুয়াল ফান্ডে।
(লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ)
মতামত ব্যক্তিগত