করোনার মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে ও সাবধানে থাকার চেষ্টা করেই দুর্গা পুজো কাটিয়ে ফেললাম আমরা। অন্যান্য বছরের মতো হুল্লোড় হয়তো করা হয়নি। হয়নি দেদার ঘুরে ঠাকুর দেখা, আড্ডা বা রেস্তরাঁয় খেতে যাওয়া। সে জন্য মন খারাপ তো হবেই। আমি যদিও বলব, এ বারের পুজোকে অন্য রকম বলেই ভাবুন না! মনে করুন যে এতে কিছুটা স্বাদ বদল হল। বাড়ির লোকের সঙ্গে আর একটু বেশি আড্ডা দেওয়া গেল। ভাবুন না যে, এ ভাবে বাইরের হইচই থেকে দূরে থেকে নিজের ও পরিবারের সকলের জন্য ভবিষ্যতের সুরক্ষা নিশ্চিত করলেন আপনি। ঠিক যে ভাবে আমরা প্রিয়জনের কথা মাথায় রেখে বিমা কিনি, এটাও খানিকটা সে রকম। যেখানে এক দিকে কিছুটা হলেও করোনাকে দূরে রাখা গেল, অন্য দিকে পরিবারকে উপহার দেওয়া হল মানসিক নিরাপত্তা।
তবে শুধু ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবেন কেন? আমি তো বলব, অতিমারির আবহে উৎসবের মরসুমে পরিবারের জন্য সব চেয়ে ভাল উপহার হল বিমার সুরক্ষাই। অন্যান্য বার যেমন স্মার্টফোন-ফ্রিজ-টিভি কেনেন, এ বার না-হয় রোজগেরে নিজের জন্য কিনলেন জীবন বিমা। আর তা ইতিমধ্যেই থাকলে, এই সুযোগে বাড়িয়ে নিলেন বিমার অঙ্ক। তাই চলুন, এই সুযোগে দেখে নিই বিভিন্ন ধরনের বিমার খুঁটিনাটি।
জীবন বিমার রকমফের
সাধারণত বাজারে তিন ধরনের জীবন বিমা প্রকল্প দেখা যায়। সেগুলি হল—
• টার্ম পলিসি
• এনডাওমেন্ট
• ইউনিট লিঙ্কড (ইউলিপ)
প্রত্যেকটি পলিসিরই নানা সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। এ ছাড়াও, কোনও বিমায় মেলে অ্যানুইটির সুযোগ। কোথাও বাড়তি প্রিমিয়ামের বিনিময়ে পাওয়া যায় রাইডারের সুবিধা। এই সব বিষয়েই কথা বলব আজ।
টার্ম পলিসি
এই ধরনের বিমা ঝুঁকির রক্ষাকবচ। একমাত্র গ্রাহক মারা গেলেই পলিসির টাকা পাওয়া যায়। নইলে মেয়াদ শেষে হাতে কিছুই আসে না। তবে এর সুবিধা হল টার্ম পলিসিতে সাধারণত এনডাওমেন্টের চেয়ে কম টাকায় বেশি অঙ্কের কভারেজ মেলে। আমাদের দেশে ধীরে ধীরে হলেও জনপ্রিয় হচ্ছে এ ধরনের প্রকল্প। কিন্তু সেই সংখ্যাটা এখনও নগণ্য। এই প্রকল্পে—
• প্রথমেই ঠিক করতে হবে কত টাকার বিমা কিনতে চান, অর্থাৎ তার সাম অ্যাশিয়োর্ড কত হবে। এ জন্য নিজের সমস্ত দায়কে এক জায়গায় করতে হবে। যার মধ্যে থাকবে সংসার চালানোর খরচ, নিয়মিত চিকিৎসা ও ওষুধের ধরচ, চালু থাকা সব ঋণ, সন্তানের শিক্ষার খরচ ইত্যাদি। সেই সঙ্গে জুড়তে হবে আগামী দিনে আর কী কী খরচ যোগ হতে পারে, তার অঙ্ক। যেমন ধরুন সন্তানের উচ্চশিক্ষা ও বিয়ে, অবসরের পরের সময়ে গিয়ে সংসার চালানো এবং চিকিৎসার খরচ প্রভৃতি। এই সব হিসেবই করতে হবে মূল্যবৃদ্ধি যোগ করে। এর মোট অঙ্কই হতে হবে সাম অ্যাশিয়োর্ড।
• যদি এ ভাবে হিসেব করা সম্ভব না-হয়, তা হলে বিমার অঙ্ক ঠিক করার সহজ উপায় রয়েছে। তা হতে হবে ৪০ বছর বয়সের আগে বার্ষিক আয়ের ২০ গুণ। অর্থাৎ, বছরে আয় ৫ লক্ষ টাকা হলে বিমামূল্য হবে ১ কোটি।
আর বয়স ৪০ বছরের বেশি হলে তা ১০-২০ গুণ হতে পারে।
• বাড়ি বা গৃহঋণের মতো দায় থাকলে, সে জন্য আলাদা বিমা করাতে পারেন। এতে ঋণগ্রহীতার কিছু হলে পরিবারের উপরে চাপ তৈরি হবে না।
• বিমার অঙ্ক ঠিক হয়ে গেলে, তার পরে স্থির হবে প্রিমিয়াম। মনে রাখবেন, আপনার বয়স এবং অভ্যাসের (ধূমপান, মদ্যপান ইত্যাদি) উপরে ভিত্তি করে প্রিমিয়ামের অঙ্ক হেরফের হতে পারে।
• অনেক সংস্থা এখন টার্ম পলিসিতে নানা ধরনের সুবিধা দেয়। যেমন কোথাও, মেয়াদ শেষে টাকা ফেরতের ব্যবস্থা থাকছে, তো কোথাও দেওয়া হচ্ছে মেয়াদের মাঝে বিমার অঙ্ক বাড়ানোর সুযোগ। কোথাও ধূমপান না-করলে প্রিমিয়াম কম দেওয়ার সুবিধাও থাকছে। বিমা কেনার আগে এ সবই দেখে নিতে হবে।
এনডাওমেন্ট পলিসি
তিন ধরনের জীবন বিমার মধ্যে সব থেকে বেশি জনপ্রিয় এনডাওমেন্ট পলিসি। এতে বিমার সুরক্ষা তো মেলেই। নিয়মিত প্রিমিয়াম দিলে মেয়াদ শেষে হাতে আসে বোনাস-সহ টাকা। ফলে অনেকেই লগ্নির পথ হিসেবে একে বেছে নেন। এ ক্ষেত্রে—
• বিমার অঙ্ক ঠিক করুন।
• টার্ম পলিসির চেয়ে এই বিমার প্রিমিয়াম বেশি। ফলে দেখে নিন কত টাকা নিয়মিত দিতে পারবেন।
• মেয়াদ শেষের আগে গ্রাহক মারা গেলে, শর্তসাপেক্ষে নমিনি বোনাস-সহ বিমার টাকা ফেরত পান।
• এমন অনেক বিমা পলিসি (যেমন, মানি ব্যাক) রয়েছে, যেখানে নির্দিষ্ট মেয়াদের পরে নিয়মিত টাকা মেলে।
• অনেক ক্ষেত্রে সারা জীবনের বিমার সুবিধাও মেলে। সে ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষ হলেও সেই সুবিধা থাকতে পারে।
• বিমা কেনার আগে বিভিন্ন সংস্থার প্রকল্প খতিয়ে দেখুন। শুধু প্রিমিয়ামের অঙ্ক দেখে বিমা কিনবেন না।
ইউলিপ পলিসি
এই প্রকল্পে বিমার পুরোদস্তুর সুবিধা তো বহাল থাকেই, সেই সঙ্গে ইউলিপ কিছুটা মিউচুয়াল ফান্ডের মতোও কাজ করে। এর টাকা লগ্নি করা হয় শেয়ার, ঋণপত্র ও মূলধনী বাজারে। রয়েছে শর্তসাপেক্ষে করছাড়ের সুবিধা। এই পলিসিতে মেয়াদ শেষে প্রাপ্য টাকার অঙ্ক বাজারের উপর নির্ভরশীল। সাধারণত, বলা হয় ইউলিপে কমপক্ষে ৬-৮ বছরের জন্য টাকা ঢালতে। এ ক্ষেত্রে—
• বিমা কেনার আগে ঠিক করতে হবে সাম অ্যাশিয়োর্ড ও প্রিমিয়ামের অঙ্ক।
• লগ্নি করা টাকার একাংশ যায় জীবন বিমার খাতে। বাকি অংশ লগ্নির যে মাধ্যম বিমাকারী বেছে নেন, সেখানে।
• চাইলে লগ্নির মাধ্যম বদলানো যায়। অর্থাৎ, শেয়ার থেকে ঋণপত্রে যাওয়া যায় বা উল্টোটা করা যায়।
• শর্তসাপেক্ষে করছাড় মেলে।
• জীবনের সুরক্ষার সঙ্গেই লগ্নির মাধ্যম হিসেবে একটিই প্রকল্প বাছতে চাইলে ইউলিপ কিনতে পারেন।
রাইডার
বিমা প্রকল্পের সঙ্গে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার নামই হল রাইডার। যেমন ধরুন, দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যু, শারীরিক ভাবে অক্ষম হওয়া, দুরারোগ্য রোগ ইত্যাদির জন্য বাড়তি বিমার ব্যবস্থা করা যায় রাইডার নিলে। এর ফলে—
• বিমাকারীর কিছু হলে পরিবারকে আর্থিক ভাবে সমস্যায় পড়তে হয় না।
• অনেক ক্ষেত্রে রাইডারের আওতায় চিকিৎসার খরচ পাওয়া যায়, ফলে অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসার টাকার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না।
• সংস্থাগুলি নানা ধরনের রাইডার বাজারে ছাড়ে। তাই কোনটা কার জন্য জরুরি, তা দেখে নিতে হবে।
করছাড়
আয়কর আইনের ৮০সি ধারায় জীবন বিমার প্রিমিয়ামে ১.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত কর ছাড় মেলে। শর্তসাপেক্ষে মেয়াদ শেষে হাতে আসা টাকাও করমুক্ত। রাইডার-সহ টার্ম পলিসির ক্ষেত্রেও করছাড়ের সুবিধা রয়েছে।
তবে খেয়াল রাখুন, চলতি অর্থবর্ষ থেকে আয়করের নতুন বিকল্পে যে বেশ কিছু ছাড় ছাড়তে হবে, তার মধ্যে জীবন বিমাও রয়েছে। ফলে করের সুবিধা পেতে বিমা কিনলেন অথচ নতুন বিকল্পে গেলেন, তা করলে কিন্তু পুরো পরিকল্পনাই মাটি হবে।
অ্যানুইটি
অবসরের পরেও নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা করতে কাজে লাগে অ্যানুইটি। বিভিন্ন জীবন বিমা সংস্থার থেকে এই প্রকল্পটি কেনা যায়।
• এতে একলপ্তে টাকা ঢেলে সেখান থেকে মাসে মাসে পেনশনের ব্যবস্থা করতে হয়। তা সারাজীবনের জন্য হতে পারে, বা নির্দিষ্ট মেয়াদেরও হয়।
• পেনশনের অঙ্ক নির্ভর করে মূলত তিনটি বিষয়ের উপরে— গ্রাহকের বয়স, প্রকল্পের ধরন ও লগ্নির অঙ্ক।
• প্রধানত দু’ধরনের অ্যানুইটি হয়— ইমিডিয়েট ও ডেফার্ড। প্রথমটিতে টাকা জমার পরের মাস থেকে পেনশন মেলে। দ্বিতীয়টিতে নির্দিষ্ট সময় পর।
• এই তালিকার বাইরেও আরও কিছু ধরনের অ্যানুইটি প্রকল্প রয়েছে।
• সংস্থা, প্রকল্প বিশেষে শর্ত আলাদা হয়। তা ভাল করে দেখে নিেত হবে।
স্বাস্থ্য বিমা
বিভিন্ন সাধারণ বিমা সংস্থা তো স্বাস্থ্য বিমা ছাড়েই। বিভিন্ন জীবন বিমা সংস্থাও তা আনে। চাইলে একই সংস্থার থেকে জীবন ও স্বাস্থ্য বিমা কেনা যায়। আবার আলাদা সংস্থার থেকেও কেনা সম্ভব। প্রিমিয়ামে আছে করছাড়ের সুবিধাও। তবে যার থেকেই স্বাস্থ্য বিমা কিনুন না কেন, কিনতে হবেই। বিশেষত বর্তমান অবস্থায় এই কথা আরও বেশি প্রযোজ্য। আর কে না জানে, পরিবারের সামগ্রিক নিশ্চিন্তির জন্য জীবন ও স্বাস্থ্য, এই দুই বিমা না-থাকলেই নয়।
লেখক কোটাক মহীন্দ্রা লাইফ ইনশিওরেন্সের এমডি-সিইও
(মতামত ব্যক্তিগত)