পরিচিতি: তুষার (২৫)
কী করেন: বেসরকারি সংস্থার কর্মী। বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকেন নিজেদের বাড়িতে। দিদির বিয়ে হয়েছে সদ্য। বাবার অবসর সামনেই
লক্ষ্য: ২০২১ সালে বিয়ে। বছরে দু’বার ঘুরতে যাওয়া। ৫০ বছরে অবসর ও বেড়ানোর টাকা জোগাড়
মাত্র আড়াই বছর চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজে ইতিমধ্যেই লগ্নির পথে অনেকটা পা বাড়িয়েছেন তুষার। করেছেন মিউচুয়াল ফান্ডে এসআইপি। সেখানে মাসে মাসে ৯,০০০ টাকা রাখেন। পিএফ তো আছেই। তার সঙ্গে সুরক্ষিত প্রকল্প হিসেবে রেখেছেন পিপিএফ-কে। আবার বেড়াতে যাওয়ার টাকা জোগাড়ের জন্য বেছেছেন লিকুইড ফান্ডকেও। তাঁর এই প্রচেষ্টা যথেষ্ট প্রশংসার। কিছু খামতি রয়েছে ঠিক। আছে লক্ষ্য স্থির করা নিয়ে সমস্যাও। কিন্তু তুষারের বয়স যেহেতু কম, ফলে সামনে কিছু দিন অন্তত সুযোগ থাকবে সেগুলি শুধরে নেওয়ার। তবে এখনই কী কী বদল আনা যায়, সেটাই দেখব আজ।
নজরে স্বাস্থ্য বিমা
অফিস থেকে নিজের এবং মায়ের জন্য ১২ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্য বিমা করিয়েছেন তুষার। যার জন্য বছরে ১৩,০০০ টাকা করে দিতে হয় তাঁকে। বাবার অবসরের পরে তাঁকেও এই প্রকল্পের মধ্যে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়াও বাবা নিজের অফিস থেকে পরিবারের সকলের জন্য স্বাস্থ্য বিমার ব্যবস্থা করেছেন। এমনিতে কর্পোরেট স্বাস্থ্য বিমার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা মেলে। কিন্তু তুষারের বর্তমান অবস্থায় এই পুরো ব্যবস্থা ঠিক নয় বলেই আমার মত। কারণ—
প্রথমত, বাবা অগস্টেই অবসর নেবেন। তিনি চাকরি ছাড়লে তাঁর অফিসের বিমা আর থাকবে না। ফলে পরিবারেরও সকলের এক সঙ্গে বিমার সুযোগ হাতছাড়া হবে।
নিট আয় ২৯,০০০
খরচ
বাবা-মাকে দেন ৫,০০০
নিজের ৪,০০০
স্বাস্থ্য বিমা ১,০৮৩
সঞ্চয়
এসআইপি ৯,০০০
পিপিএফ ৫,০০০
সেভিংস অ্যাকাউন্ট ৩,০০০
পিএফ ১,৮০০
লিকুইড ফান্ড ৩,০০০
দ্বিতীয়ত, বাবাকে নিজের অফিসের বিমার আওতায় আনলেও, ভবিষ্যতে যদি আগামী দিনে তুষার এই চাকরি ছেড়ে দেন তখন কিন্তু পরিবারের কারওরই কোনও স্বাস্থ্য বিমা থাকবে না।
তৃতীয়ত, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনও কর্মী অবসর নিলে আর স্বাস্থ্য বিমার সুবিধা দেয় না নিয়োগকারী সংস্থা। তুষার যদি বর্তমান সংস্থাতেই সারা জীবন কাজ করেন, সে ক্ষেত্রেও অবসরের পরের জন্য তাঁকে নিজের এবং পরিবারের বাকিদের জন্য বিমার ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। কারণ ৬০ বছরের পরে তা করতে গেলে সে ক্ষেত্রে বিপুল প্রিমিয়াম গুনতে হবে।
তাই আমি বলব, এখনই নিজের জন্য আলাদা স্বাস্থ্য বিমা করান। বিয়ের পরে স্ত্রীকে এবং তার পরে সন্তানকে এর আওতায় আনতে ভুলবেন না। বাবা মায়ের জন্য আপাতত তাঁর অফিসের বিমায় ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু খোঁজ নিতে পারেন কোনও বিমা সংস্থা প্রবীণদের জন্য সর্বোচ্চ কত টাকার বিমা করায়, সেখানে প্রিমিয়াম কত। সুযোগ বুঝে সেই প্রকল্পও কেনা যায়। তা করা না গেলে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অফিস বিমার সাহায্যই নিতে হবে। যদি চাকরি ছাড়ার কথা ভাবেন, তা হলে দেখে নিতে হবে নতুন সংস্থায় বাবা-মায়ের জন্য বিমার সুবিধা রয়েছে কি না।
একটা কথা ভাল যে, সরাসরি বিমা ছাড়াও তুষারের অফিস থেকে প্রত্যেকের জন্য বাড়িতে থেকে চিকিৎসার জন্যও ৬,০০০ টাকা করে পাওয়া যায়। এটা দৈনন্দিন চিকিৎসার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে।
লগ্নিতে বদল
নিজের চিঠিতে বেশ কিছু ইচ্ছের কথা জানিয়েছেন তুষার। তার মধ্যে রয়েছে আগামী দু’বছরের মধ্যে বিয়ে, বছরে দু’বার বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া। ৫০ বছরে অবসর নিয়ে বেড়াতে যাওয়া এবং সে জন্য ২ কোটি টাকা জমানো।
এমনিতে আমরা অনেকেই আর্থিক পরিকল্পনা করার সময়ে নিজের ইচ্ছে এবং স্বপ্নগুলিকে যতটা গুরুত্ব দিই, তার বাস্তবতা নিয়ে ততটা ভাবি না। আর পরে সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে না-পারলে মুষড়ে পড়ি। ফলে শুরু থেকেই লক্ষ্যগুলি বাস্তবসম্মত হওয়া খুব জরুরি।
আর সেই কারণেই আমি বলব তাঁর এই পরিকল্পনার সব চেয়ে বড় সমস্যা হল যে, লক্ষ্যগুলি ঠিক মতো সাজানো নয়। কারণ, ৫০ বছরে পৌঁছে সংসার, সন্তানের পড়াশোনা এবং অন্যান্য খরচ সামলে দু’কোটি সঞ্চয় ও অবসর নেওয়া কতটা সম্ভব হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকছে। তার উপরে তিনি অবসরের সঞ্চয়, সন্তানের জন্য লগ্নি নিয়ে কোনও কথা ভাবেনননি। এমনকি চিঠিতে সেই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেও চাননি। অথচ সেটাই আগামী দিনে তাঁর আর্থিক পরিকল্পনার সব চেয়ে বড় জায়গাটা দখল করবে। ফলে লক্ষ্যের জন্য তৈরি হওয়ার আগে সেগুলিকে সময় এবং গুরুত্ব অনুসারে সাজানোর পথে হাঁটতে হবে তাঁকে।
বিয়ের জন্য
২০২১ সালে বিয়ের কথা ভাবছেন তিনি। আর সে জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তিনি। যেমন, এখন থেকে ৩,০০০ টাকা করে রেকারিং এবং বিয়ের আগে এসআপি-র কিছু টাকা তুলে নেওয়া। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হল, এখন রেকারিং শুরু করে সেই টাকা দিয়ে বিয়ের খরচ জোগাড় করা সম্ভব নয়। আবার তখন বাজারের অবস্থা কী রকম থাকে, তা না দেখে তখন এসআইপি ভাঙানোর পরামর্শও আমি দেব না।
ফলে আমার মতে রেকারিং না-করে বরং লিকুইড ফান্ডে টাকা রাখুন। দু’ক্ষেত্রেই কর দিতে হবে। কিন্তু লিকুইড ফান্ডে তুলনায় কিছুটা বেশি টাকা মেলার সুযোগ থাকবে। আর অন্য দিকে, এসআইপির বর্তমান অবস্থা খতিয়ে দেখে তার মধ্যে একটি বা দু’টি বন্ধ করুন। সেই টাকাও লিকুইড ফান্ডে রাখুন। এতে বাজারের ওঠাপড়া কিছুটা হলেও এড়ানো যাবে। আবার চটজলদি টাকা তোলার সুবিধাও পাওয়া যাবে।
বিয়ের পরে
• তুষারের উপরে এই মুহূর্তে পরিবার খুব বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল নয়। ফলে এখন জীবন বিমা না-কেনার সিদ্ধান্ত ঠিকই রয়েছে। কিন্তু বিয়ের পরে প্রথমেই নিজের জন্য বড় অঙ্কের একটা টার্ম পলিসি করাতে হবে। যাতে তাঁর কিছু হলে পরিবার অথৈ জলে না-পড়ে। সঙ্গে নিতে হবে সমান অঙ্কের অ্যাক্সিডেন্ট এবং ক্রিটিক্যাল ইলনেস কভারও।
• যে এসআইপি বিয়ের জন্য বন্ধ করা হয়েছিল, সেগুলি আবার চালু করতে হবে। কিন্তু ফান্ড বাছাইয়ের জন্য তখনকার বেতন, বাজারের অবস্থা ইত্যাদি দেখে নিতে হবে।
অন্যান্য
সেভিংস অ্যাকাউন্টে টাকা রাখার অভ্যেস খুবই ভাল। বিপদ-আপদ বলে কয়ে আসে না। তাই আমি বলব অন্তত তিন মাসের বেতন সেখানে রাখার কথা। সে জন্য এখনকার মতো অল্প অল্প করেই টাকা রাখুন। কমপক্ষে ১ লক্ষ টাকা হয়ে গেলে তবে পরের মাসগুলিতে অন্য খাতে লগ্নি সরাতে পারেন।
• বেড়াতে যেতে কে না চায়! সে জন্য টাকা জমাচ্ছেন, সেটাও ভাল কথা। কিন্তু শুধু বেড়ানোর জন্যই ৫০ বছরে ২ কোটি জমানোর পথে হাঁটা তুষারের পক্ষে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। সেটার পরামর্শও দেব না। তবে মাঝেমধ্যে ঘুরতে যেতেই পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেটাও যেন অন্যান্য লগ্নিকে ধাক্কা না-দেয়।
• তুষারের বয়স অনেক কম। দায়দায়িত্বও তুলনায় কম। তাই তাঁর লগ্নির মধ্যে অন্তত ১০-১৫% সরাসরি শেয়ারে রাখার পরামর্শ দেব। কিন্তু যদি নিজে থেকে শেয়ার বাছাইয়ে সচ্ছন্দ না-হন, সে ক্ষেত্রে সেই পথে হাঁটতে যাবেন না। বরং পড়াশোনা করে তৈরি হতে এবং আগামী দিনে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী হলে সেই পথে হাঁটতে পারেন। অথবা এসআইপির সংখ্যা বাড়াতে পারেন।
পাল্টানোর জন্য তৈরি থাকুন
তুষারের বাদবাকি লগ্নি ঠিকই রয়েছে। তবে সেটাকেই আগামী দিনে বজায় রাখতে হবে এমন মানসিকতা যেন না-থাকে। এখন তিনি বাড়িতে ৫,০০০ টাকা মাসে মাসে দেন। তবে আগামী দিনে বিয়ের পরে তাঁর দায়িত্ব আরও বাড়বে। ফলে সংসার খরচও বাড়বে। তাই সে জন্য এখন থেকেই মানসিকতা তৈরি হতে হবে। সেই সময়ে গিয়ে লগ্নির ধরন এবং প্রকল্পও পাল্টাতে হতে পারে। যেমন ধরুন, এসআইপি-র মধ্যে কয়েকটি সন্তানের জন্য বাধ্যতামূলক ভাবে রাখতে হবে। আবার অবসরের জন্য আলাদা লগ্নি করতে হবে। অর্থাৎ, মোদ্দা কথা হল সময় বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে। আর বিয়ের পরে অবশ্যই পুরো আর্থিক পরিকল্পনা খতিয়ে দেখতে হবে। শুভেচ্ছা রইল।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)