মুকেশ অম্বানী।
‘ডিজিটাল ইন্ডিয়ায়’ জ্বালানি জোগাতে ৫ থেকে ৭ বছরে যে টাকা (৭৫,০০০ কোটি) গুগলের সারা ভারতে ঢালার কথা, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার প্রায় ৪৫% (৩৩,৭৩৭ কোটি টাকা) চলে গেল জিয়ো প্ল্যাটফর্মের পকেটে! ফেসবুকের পরে মুকেশ অম্বানীর ডিজিটাল সংস্থায় অংশীদারির কামড় বসাল গুগলও। গ্রাহকের তথ্য (ডেটা) বহুজাতিকের সার্ভার ঘুরে দেশের বাইরে যাওয়া নিয়ে যে বিতর্ক, একে তাতে জল ঢালার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন অনেকে। সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে না-দিয়েও বিশেষজ্ঞদের একাংশের আবার দাবি, ভারতের ডিজিটাল-বাজারে হাড্ডাহাড্ডি টক্করের ছবি আগামী দিনে কেমন দাঁড়াবে, তা অনেকটাই স্পষ্ট জিয়োর সঙ্গে ‘জোট বাঁধা’ সংস্থার তালিকাতেই।
সিলভার লেক, টিপিজি ক্যাপিটাল, কেকেআর, মুবাডালার মতো যে সমস্ত প্রাইভেট ইকুইটি কিংবা লগ্নি-তহবিল সংস্থা জিয়োয় টাকা ঢেলেছে, তাদের পরিচিতিই মোটা মুনাফার গন্ধ আগাম পাওয়ার জন্য। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে ভারতের ডিজিটাল-বাজার এবং সেই সূত্রে জিয়োর লাভ ফুলেফেঁপে ওঠার আশাতেই মুকেশের সংস্থার শেয়ার কিনেছে তারা।
কিন্তু সেই বাজারে যুযুধান প্রতিদ্বন্দ্বী কারা, সেই ছবি স্পষ্ট বাকি বিনিয়োগকারীদের নামে। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞেরা বলেন, ডেটা-নির্ভর অর্থনীতিতে পণ্য-পরিষেবার অনলাইন হাতবদল নির্ভর করে মূলত চারটি জিনিসের উপরে। সস্তায় বিপুল তথ্য জমা রাখা ও তা ব্যবহারের ক্ষমতা (ক্লাউড কম্পিউটিং), সেই ডেটা মেশিনে কাজে লাগানো (প্রসেসিং), হাতে-হাতে সস্তার স্মার্টফোন এবং কম খরচে দ্রুত গতির নেট।
প্রসেসর তৈরির জন্য যাদের খ্যাতি দুনিয়া জোড়া, সেই ইন্টেলের সিইও ব্রায়ান ক্রানিকের দাবি, “সত্তরের দশকের তুলনায় এখনকার প্রসেসরের ক্ষমতা বেশি ৩৫০০ গুণ। বিদ্যুৎ লাগে ৯০ হাজার ভাগের এক ভাগ! আর দামও ৬০ হাজার ভাগের এক ভাগ!” সংস্থার দাবি, এই একই হিসেব মানতে হলে, ফোক্সভাগেনের বিটল গাড়ির এখনকার গতি হবে ঘণ্টায় ৩ লক্ষ মাইল। এক গ্যালন গ্যাসে পাড়ি দেবে ২০ লক্ষ মাইল। দাম? ৩ টাকা মতো। তাদের মতে, ডেটা প্রসেসিং এত দ্রুত আর সস্তা হয়েছে বলেই অনলাইনে কেনাকাটার রমরমা। জিয়োর প্ল্যাটফর্মে এই ইন্টেল অংশীদার।
সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’, ক্রেতাদের পছন্দ-অপছন্দ থেকে বড় ব্যবসার বিপুল তথ্য— সমস্ত কিছুই এখন থাকে ‘ক্লাউডে’। এই বাজার ধরার জন্য সারা বিশ্বে মারকাটারি প্রতিযোগিতা অ্যামাজ়ন, মাইক্রোসফট, গুগল, আইবিএম, আলিবাবার মতো সংস্থার। ২০০৮ সালে বিশ্বে ক্লাউডের বাজার যেখানে ৫৮২ কোটি ডলারের ছিল, সেখানে ২০১৯ সালে তা ১৫,১৭৬ কোটি ডলার! এ দেশের ছোট ব্যবসায়ীদের তথ্য নিজেদের ক্লাউড পরিষেবা অ্যাজিওরে রাখতে আগেই জিয়োর সঙ্গে চুক্তি করেছে মাইক্রোসফট। জল্পনা আরও বড় বিনিয়োগেরও।
দামি ফোনে অ্যাপল কিংবা স্যামসাংয়ের কাটতি থাকলেও, সস্তার স্মার্টফোনকে পাখির চোখ করছে জিয়ো। যাতে দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তের অতি সাধারণ আয়ের মানুষটির হাতে তা ধরিয়ে দেওয়ার পরে ডেটা-প্যাকের খোঁজ করেন তিনি। গুগল চায়, ওই ফোনে সেঁধিয়ে থাকুক তাদের সফ্টওয়্যার অ্যান্ড্রয়েড। তা ছাড়া, ফোনে মশগুল মানুষ যত বাড়বে, তত বাড়বে তাতে বিভিন্ন বিষয়ের খোঁজ বা ‘সার্চ’। রকমারি অ্যাপ ডাউনলোড হবে তাদের প্লে-স্টোর থেকে। বাড়বে ইউটিউব-সহ অন্যান্য ব্যবসার পরিধিও।
জিয়োর দাবি, সস্তায় ৪জি পরিষেবা দ্রুত সারা দেশে পৌঁছে দিয়েই ভারতের নেট-ব্যবহারের অভ্যেস পাল্টে দিয়েছে তারা। এ বার পাখির চোখ ৫জি। এই প্রযুক্তিতে অগ্রণী কোয়ালকম ইতিমধ্যেই শেয়ার কিনেছে জিয়োয়। আর দ্রুত গতির নেট যত বাড়বে, তত পোয়াবারো ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার। একই সঙ্গে মার্ক জ়ুকেরবার্গের সংস্থা চায়, কেনা-কাটায় দাম মেটানোতে এ দেশে জনপ্রিয় হোক তাদের হোয়াটসঅ্যাপ পে। জিয়োর প্রায় ১০% অংশীদারি তাই তাদের পকেটে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দিনে বাকি বিশ্বের মতো এ দেশেও অনলাইন বিজ্ঞাপনের ৮০%-৯০% থাকার সম্ভাবনা চার সংস্থার পকেটে। গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজ়ন এবং মাইক্রোসফট ও তার লিঙ্কডইন। এর মধ্যে প্রথম দু’য়ের হাতেই প্রায় ৬০%। কড়া টক্কর অনলাইন খুচরো-ব্যবসার (রিটেল) বাজারে। সেখানে আবার অ্যামাজ়ন, ফ্লিপকার্ট, বিগ-বাস্কেটকে কড়া প্রতিযোগিতার মুখে ফেলতে পারে জিয়ো-মার্ট। জেফ বেজোসের অ্যামাজ়ন এ দেশে লগ্নি বাড়াচ্ছে প্রতি বছর। ১২০০ কোটি ডলারে কেনার পরে ফ্লিপকার্টে সদ্য ফের ১২০ কোটি ঢেলেছে মার্কিন রিটেল বহুজাতিক ওয়ালমার্ট। সেখানে বিনিয়োগ রয়েছে মাইক্রোসফটেরও। বিগ-বাস্কেটে লগ্নি রয়েছে চিনা ধনকুবের জ্যাক মা-র হাতে গড়া সংস্থা আলিবাবার। আর জল্পনা, জিয়ো মার্টে বিপুল টাকা ঢালতেই নাকি জিয়ো প্ল্যাটফর্মের শেয়ার এতগুলি সংস্থাকে বেচেছেন মুকেশ। শুধু পণ্য বেচা নয়, এই সমস্ত সংস্থার নজর ক্রেতা-গ্রাহকদের পছন্দ, অপছন্দ, আয়, ব্যয়-সহ যাবতীয় তথ্যে। মুখোমুখি বিশ্বের ধনীতম বেজোস আর ভারতের পয়লা নম্বর ধনকুবের মুকেশও।
অনলাইন বিজ্ঞাপন হোক বা বিক্রিবাটার বাজার— ডেটার জোরে তা ধরতে ধনকুবের আর বহুজাতিক দৈত্যদের লড়াই তাই জমাটি।