গর্বের ই-গভর্ন্যান্সেও রাজ্যের স্থান নীচের দিকে

দেশের ৩৬টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে স্থান ২০ নম্বরে। অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাত তো কোন ছার, পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে মিজোরাম, ছত্তীসগঢ়ও। ই-গভর্ন্যান্সের ব্যবহার তালিকায় একেবারে নীচের দিকেই ঠাঁই পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। সেই পশ্চিমবঙ্গ, যে-রাজ্য এক অর্থে ই-গভর্ন্যান্সের ভগীরথ। বিনিয়োগে লাল ফিতের ফাঁস কাটতে যেখানে ওই পরিষেবার সফল ব্যবহার নিয়ে প্রায়শই কৃতিত্ব দাবি করেন অর্থমন্ত্রী, এমনকী মুখ্যমন্ত্রীও।

Advertisement

গার্গী গুহঠাকুরতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৫ ০২:০৮
Share:

দেশের ৩৬টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে স্থান ২০ নম্বরে। অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাত তো কোন ছার, পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে মিজোরাম, ছত্তীসগঢ়ও। ই-গভর্ন্যান্সের ব্যবহার তালিকায় একেবারে নীচের দিকেই ঠাঁই পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। সেই পশ্চিমবঙ্গ, যে-রাজ্য এক অর্থে ই-গভর্ন্যান্সের ভগীরথ। বিনিয়োগে লাল ফিতের ফাঁস কাটতে যেখানে ওই পরিষেবার সফল ব্যবহার নিয়ে প্রায়শই কৃতিত্ব দাবি করেন অর্থমন্ত্রী, এমনকী মুখ্যমন্ত্রীও।

Advertisement

সারা দেশে বিভিন্ন ই-গভর্ন্যান্স প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন (ই-ট্রানজাকশন) কেমন হচ্ছে, তার হিসেব রাখে কেন্দ্রের ওয়েব পোর্টাল ইলেকট্রনিক ট্রানজাকশন অ্যাগ্রিগেশন অ্যান্ড অ্যানালিসিস লেয়ার (ই-তাল)। সেখানকার তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে ই-গভর্ন্যান্সে প্রতি হাজার মানুষ গড়ে আর্থিক লেনদেন করেন মাত্র ২৬৩টি। যেখানে কেরল, তেলঙ্গানায় তা ১০ হাজারের বেশি। ৯ হাজারের বেশি অন্ধ্রপ্রদেশেও। গুজরাত ৪ হাজারের ওপরে। তুলনায় পিছিয়ে থাকা মিজোরাম এবং ছত্তীসগঢ়ে এই সংখ্যা যথাক্রমে ২৭১ ও ৮৬২। যে-রাজ্যের জনসংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের দ্বিগুণেরও বেশি, সেই উত্তরপ্রদেশেও ওই সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে।

শুধু প্রতি হাজার মানুষের গড় ব্যবহারের নিরিখেই নয়, আরও দুই মাপকাঠিতেও পিছিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। যেমন, তালিকায় প্রথম স্থানে থাকা অন্ধ্রপ্রদেশে যেখানে মোট ই-লেনদেনের সংখ্যা ৪৫ কোটির বেশি, সেখানে এ রাজ্যে তা কোনওক্রমে ২ কোটি ছাড়িয়েছে। যে-রাজ্য তথ্যপ্রযুক্তিতে তেমন প্রথম সারির বলে আদৌ বিবেচিত হয় না, সেই মধ্যপ্রদেশেও এই সংখ্যা ১৮ কোটির বেশি। উল্লেখ্য, এই সমস্ত পরিসংখ্যানই দেওয়া হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের ১২ তারিখ পর্যন্ত সময়ের জন্য।

Advertisement

অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাত, ছত্তীসগঢ়, কেরলের মতো রাজ্যের থেকে পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে দেওয়া সরকারি পরিষেবার সংখ্যার নিরিখেও। যেখানে অন্ধ্রপ্রদেশ ২৪১টি, গুজরাত ১৯২টি এবং ছত্তীসগঢ় ১১৫টি পরিষেবা দেয়, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে মেলে মাত্র ৯৫টি।

সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান আরও বেসুরো বাজছে, কারণ হামেশাই ই-গভর্ন্যান্সে সাফল্যের কথা ফলাও করে প্রচার করে রাজ্য। যেমন, সম্প্রতি শিল্পমহলের সঙ্গে এক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, ভ্যাট বা যুক্তমূল্য কর সংক্রান্ত পরিষেবা থেকে শুরু করে ট্রেড লাইসেন্স— সবই এখন পাওয়া যাবে অনলাইনে। ই-গভর্ন্যান্সের সাফল্যের খতিয়ান প্রায় প্রতিটি বণিকসভার মঞ্চে তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী তথা তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অমিত মিত্রও। কিন্তু অনেকের মতে, ই-তালের পরিসংখ্যান অন্য কথা বলছে।

অথচ দেশের মধ্যে ই-গভর্ন্যান্স প্রথম চালু হয় পশ্চিমবঙ্গেই। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, বাম জমানাতেই ‘বাংলার মুখ’ নামে চালু হওয়া তথ্য পরিষেবা সংক্রান্ত কেন্দ্রগুলি মুখ থুবড়ে পড়েছিল মূলত সরকারি গাফিলতিতে। বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সঠিক সমন্বয়ের অভাবে প্রয়োজনীয় সরকারি তথ্য কম্পিউটারে তোলার কাজটুকুই করে ওঠা যায়নি।

পরে কেন্দ্রের চাপে সেই অবস্থা কিছুটা বদলালেও সমন্বয়ের অভাব সেই থেকেই গিয়েছে। খোদ সরকারি মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে, অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প চালু হচ্ছে নামকেওয়াস্তে। তাতে আমজনতা আদৌ কতটা পরিষেবা পাবেন, সেই চিন্তা বা নজরদারি না-করেই।

সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ, এখনও মূলত এই কারণেই পিছিয়ে রয়েছে রাজ্য। এখানে পরিষেবা আছে। পরিকাঠামোও একেবারে না-থাকা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে ই-গভর্ন্যান্সকে অনেক বেশি করে আমজনতার দরজায় পৌঁছে দেওয়া যায়নি, তার মূল কারণ প্রশাসনিক গড়িমসি। অনেক সময়ে ছোট শহর বা গ্রামে এই পরিষেবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার লোক পাওয়া যায় না। কিছু ক্ষেত্রে আবার সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় যথাযথ পরিকল্পনার অভাব।

এই পরিকল্পনার অভাবের হাতেগরম প্রমাণ তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের অধীন ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ। আইআইটি খড়্গপুরের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে এই পরিষদ তৈরি হয়েছে অনেক আগে। বাংলা ভাষায় কম্পিউটার চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি তৈরি করেছে তারা। পরিষদের দাবি, বাংলা ও অলচিকি ভাষায় কি-বোর্ড তৈরি করা হয়েছে। তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সফটওয়্যার। অর্থাৎ এক কথায়, স্থানীয় ভাষায় কম্পিউটারে কাজকর্ম করার উপযোগী প্রযুক্তি তৈরি করা রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল, ওই প্রযুক্তির ব্যবহার সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকাঠামোই পরিষদের নেই। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, যে-সব রাজ্যে মাতৃভাষার মাধ্যমে ই-গভর্ন্যান্স সংক্রান্ত কাজ করা যায়, সেখানে তার ব্যবহার সাধারণত বেশি। কর্নাটক, গুজরাতের মতো রাজ্য আগেই তা প্রমাণ করেছে।

সরকারি সূত্রে খবর, পশ্চিমবঙ্গে ই-গভর্ন্যান্সের কাজ বাংলায় করার সুবিধা আছে। কেন্দ্রের নির্দেশে তা রাখাও বাধ্যতামূলক। কিন্তু তৃণমূল স্তরে তা কার্যকর করার তাগিদ নেই বলে ই-গভর্ন্যান্স পরিষেবার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারছে না রাজ্য।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement