—প্রতীকী চিত্র।
পরিচিতি: সুস্মিতা (৬০)
কী করেন: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী। থাকেন শিলিগুড়িতে পরিবারের সঙ্গে নিজেদের বাড়িতে
লক্ষ্য: অবসরের সময়ে প্রাপ্ত তহবিল লগ্নি করে সংসারের খরচ সংগ্রহ এবং সঞ্চয়
আজকের আলাপ আলোচনা একটু অন্য রকম। এত দিন দেখে এসেছি, মূলত চাকরিজীবী বা পেশাদারেরা জানতে চাইছেন ভবিষ্যতের তহবিল তৈরির জন্য নিজেদের মাসিক আয়ের একাংশ কোথায় কোথায় কী ভাবে লগ্নি করা যায়। আজকের প্রশ্নকর্তা অবসরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। পেনশন পাবেন ঠিকই। কিন্তু সংসারের মাসিক খরচের তুলনায় তা অনেকটাই কম। বাকি টাকা সংগ্রহ করতে হবে অবসরের সময়ে প্রাপ্ত তহবিল থেকে।
সুস্মিতাদেবী জানুয়ারিতে চাকরি থেকে অবসর নিচ্ছেন। তিনি জানিয়েছেন, অবসরের পরে প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, জমে থাকা ছুটি বাবদ প্রাপ্য-সহ যাবতীয় খাত থেকে ৮৫ লক্ষ টাকা পাবেন। পোস্ট অফিসের মান্থলি ইনকাম স্কিমে (এমআইএস) ৯ লক্ষ টাকা রয়েছে। সেই সঙ্গে মাসে পেনশন পাবেন ২৫,০০০ টাকা। অথচ সংসার, চিকিৎসা-সহ তাঁর মাসে খরচ নয় নয় করেও ৫০,০০০-৬০,০০০ টাকা। তিনি জানতে চেয়েছেন, ওই ৮৫ লক্ষ টাকার তহবিল কোন কোন খাতে লগ্নি করলে যাবতীয় খরচ তোলা যাবে। আবার সেই সঙ্গে আপৎকালীন প্রয়োজনে কিছু টাকা সঞ্চয়ও করতে চান। জানতে চেয়েছেন তা নিয়েও।
মান্থলি ইনকাম স্কিম বাদে অন্য কোনও প্রকল্পে সঞ্চয় বা লগ্নি আছে কি না অথবা পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা বিমা আছে কি না, সে সম্পর্কে সুস্মিতাদেবী বিস্তারিত কিছু জানাননি। অতএব অন্য কোনও লগ্নি নেই ধরে নিয়েই আমরা হিসেব কষব। আর থাকলে তো খুবই ভাল কথা।
গোড়ার কথা
এ বার প্রশ্নকর্তার খরচ ও লগ্নি সংক্রান্ত হিসেবে আসা যাক। ধরে নেওয়া যাক তাঁর বয়স ৬০ বছর পার হয়েছে এবং তিনি প্রবীণ নাগরিক। প্রত্যেক মাসে ২৫,০০০ টাকা করে পেনশন পাচ্ছেন। তাঁর মান্থলি ইনকাম স্কিমে এখন বার্ষিক সুদ ৭.৩%। অর্থাৎ, ইতিমধ্যেই জমানো ৯ লক্ষ টাকা থেকে তাঁর মাসিক আয় ৫৪৭৫ টাকা। অতএব বোঝা যাচ্ছে তাঁর খরচের ঘাটতি পূরণ করতে মাসে আরও ৩০,০০০ টাকা করে দরকার। এ বার দেখা যাক ৮৫ লক্ষ টাকার মূলধন কী ভাবে বিনিয়োগ করলে এই টাকা তোলার পাশাপাশি, কিছু সঞ্চয়ও হয়। যাতে ভবিষ্যতের মূল্যবৃদ্ধিকেও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
এসসিএসএস
সিনিয়র সিটিজেন্স সেভিংস স্কিম (এসসিএসএস) সরকার নিয়ন্ত্রিত সঞ্চয় প্রকল্প, যেখানে প্রবীণ নাগরিকেরা তহবিল লগ্নি করে নিশ্চিত অঙ্কের আয় করতে পারেন। যেহেতু এই প্রকল্পের তহবিল সরকারের কাছে থাকে, তাই এর নিরাপত্তা ব্যাঙ্কের মেয়াদি আমানতের চেয়ে বেশি।
• এই প্রকল্পে ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত রাখা যায়।
• মেয়াদ পাঁচ বছর।
• প্রত্যেক তিন মাসে সুদ দেওয়া হয়। এখন সুদ ৮.৬%।
• এই প্রকল্পে বছরে ১.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ কর ছাড়ের আওতায় পড়ে। সুদ অবশ্য করযোগ্য।
আমার পরামর্শ, ১৫ লক্ষ টাকা এসসিএসএসে রাখুন। প্রতি তিন মাসে ৩২,২৫০ টাকা করে সুদ জমা পড়বে। অর্থাৎ, মাসে ১০,৭৫০ টাকা।
প্রধানমন্ত্রী বয়োবন্দনা যোজনা
এটি এক ধরনের মেয়াদি আমানত। এই প্রকল্পে তহবিল গচ্ছিত থাকে এলআইসির কাছে। প্রকল্পের মেয়াদ ১০ বছর। সুদের হার বছরে ৮%। এই প্রকল্পের সুদ অবশ্য আয়করের আওতায় পড়ে। আমানতের সর্বোচ্চ অঙ্ক ১৫ লক্ষ টাকা। হিসেব কষলে দেখতে পাবেন, প্রকল্পটিতে ওই অঙ্কের তহবিল লগ্নি করলে মাসে ১০,০০০ টাকা উপার্জন হতে পারে।
মেয়াদি আমানত
এর পরে আমাদের এমন একটি ফিক্সড ডিপোজিট প্রকল্প খুঁজে বার করতে হবে যেখানে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য অন্তত ৭% সুদ রয়েছে। এখন অনেক ব্যাঙ্কেই এই ধরনের প্রকল্প রয়েছে। সেখানে অন্তত ২০ লক্ষ টাকা লগ্নি করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে মাসে অন্তত ১১,০০০ টাকা করে সুদ মিলবে।
এর পরেও
তিনটি প্রকল্পে ৫০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে মাসে ৩০ হাজারের কিছু বেশি টাকা আয় হতে পারে সুস্মিতাদেবীর। সেই সঙ্গে পেনশন ও মান্থলি ইনকাম স্কিমের টাকা যোগ করে সহজেই মাসের খরচ সংগ্রহ করতে পারবেন। এর পরেও থাকবে ৩৫ লক্ষ টাকা। তার একটা অংশ কয়েকটি কয়েকটি দীর্ঘ মেয়াদি ও স্বল্প মেয়াদি প্রকল্পে ঢালতে পারেন। তা হলে হাতে নিয়মিত রিটার্ন আসবে। বাড়বে সঞ্চয়। এ জন্য—
• সাত বছর মেয়াদি আরবিআই বন্ড কিনতে পারেন। সুদ মিলবে ৭.৭৫%।
• মিউচুয়াল ফান্ডে কিছু টাকা রাখা যেতে পারে। তবে তা রাখতে হবে ডেট ও ইকুইটি ফান্ডে মিলিয়ে মিশিয়ে। অবশ্যই ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা বুঝে। ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডগুলি ধারাবাহিক রিটার্ন দেবে। আর ইকুইটি ফান্ড কাজে লাগবে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার জন্য।
• শেয়ার বাজার থেকে করমুক্ত বন্ড কেনা যায়। সেই বন্ড সরকারি হলেই ভাল। এ ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি মেয়াদের ও বেশি ইল্ডের বন্ড বাছতে হবে।
• কিছু টাকা লিকুইড ফান্ড ও স্বল্প মেয়াদি স্থায়ী আমানতে রাখা যায়।
অ্যানুইটি
সুস্মিতাদেবীর পেনশন রয়েছে। তাই অ্যানুইটির পরামর্শ সে ভাবে দিতে চাই না। কিন্তু যদি মনে হয়, সে ক্ষেত্রে বিমা সংস্থার কাছ থেকে তা কেনা যায়। সেটি
হতে হবে ইমিডিয়েট অ্যানুইটি। যেখানে সঙ্গে সঙ্গে টাকা মেলা শুরু হবে।
এর পাশাপাশি, আরও কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখুন। আগে যা বলছিলাম, সুস্মিতাদেবী নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা বিমা রয়েছে কি না, তার উল্লেখ করেননি। না-থাকলে সাধ্য অনুযায়ী করিয়ে রাখতে হবে। কিছু টাকা তার প্রিমিয়াম বাবদ সরিয়ে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে:
• এই সমস্ত লগ্নির পরে যদি তিনি আয়করের আওতায় পরেন, তা হলে প্রত্যেক মাসে ইএলএসএস প্রকল্পে লগ্নি করতে পারেন। তাতে আয়কর আইনের ৮০সি ধারায় করছাড় মেলে।
• আর যদি সন্তানের উচ্চ শিক্ষা কিংবা বিয়ের মতো পরিকল্পনা থাকে, তার জন্য অনেক দিন আটকে থাকে এমন প্রকল্পে বেশি টাকা লগ্নি করা চলবে না। সহজে ভাঙানো যায়, এমন প্রকল্পে পরিকল্পনা মাফিক নির্দিষ্ট অঙ্কের তহবিল রাখতে হবে।
• বেড়াতে যেতে ঋণপত্র নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ডে কিছু টাকা সরিয়ে রাখতে পারেন। তার রিটার্ন থেকেই খরচের একাংশ উঠে আসবে।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)
ছবি প্রতীকী