ইস্পাত কারখানা। ফাইল চিত্র
কোভিড অতিমারির বিষ নামতে না নামতেই এ বার এভারগ্রান্ডের ছোবল। দালাল স্ট্রিটে ইস্পাত সংস্থার শেয়ারের দাম পড়ছে। আর অভিযোগের আঙুল উঠেছে চিনের দ্বিতীয় বৃহত্তম নির্মাণ সংস্থা এভারগ্রান্ডের দিকে।
শুধু দালাল স্ট্রিট নয়। বিশ্বের অর্থ বাজারে ঘনাচ্ছে আশঙ্কার মেঘ। বুধবার বাজার থেকে নেওয়া ঋণের উপর আট কোটি ৩৫ লক্ষ কোটি ডলারের সুদ দেওয়ার কথা এভারগ্রান্ডের। ডলার পিছু ৭৩ টাকা ৬৫ পয়সা টাকার দাম ধরলে এই সুদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬১৫ কোটি টাকার একটু কম। কিন্তু এ টাকা নাও মিটিয়ে উঠতে পারে বলে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে সংস্থাটি।
চিনের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই নির্মাণ সংস্থার বিশ্ব বাজারে মোট ঋণের পরিমাণ এখন তিরিশ হাজার কোটি ডলার ( এই প্রসঙ্গে উল্লেখ থাক, লেহম্যান ব্রাদার্স দেউলিয়া হয়েছিল ৬১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার ঋণের বোঝা নিয়ে)। আর এই ঋণ শুধু সংস্থাটির নির্মাণ ব্যবসার জন্যই। নির্মাণ শিল্পের বাইরেও সংস্থার আরও অনেক ব্যবসা রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল স্বাস্থ্য, গাড়ি, সংবাদ মাধ্যম, আর্থিক সংস্থা। তাই দেনার দায় নির্মাণ ব্যবসা ডুবলে, একই সঙ্গে ডুবতে পারে বাকি সব ব্যবসাই।
চিনের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইস্পাত নির্মাণ সংস্থা এভারগ্রান্ড। ফাইল চিত্র।
আর্থিক অঙ্কের থেকেও সংস্থার ব্যবসার পরিসর বোঝার জন্য এভারগ্রান্ডের দিকে চোখ রাখা যাক। এই মুহূর্তে সংস্থাটির ১৩০০টি নির্মাণ প্রকল্প রয়েছে, কর্মী সংখ্যা দু’লক্ষেরও উপরে আর প্রতি বছর ব্যবসার প্রয়োজনে সংস্থাটি গড়ে ৩৮ লক্ষ অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করে থাকে নির্মাণ শিল্পের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজের জন্য।
এই রকম একটি সংস্থা ধসে পড়লে বিশ্ব বাজারে তার অভিঘাত যে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। ইতিমধ্যেই নির্মাণ শিল্পে ইস্পাতের চাহিদা কমতে পারে মনে করে শেয়ার বাজারে সংশ্লিষ্ট শিল্পের শেয়ারের দাম পড়তে শুরু করেছে। কারণ নির্মাণ শিল্পের কারণেই ইস্পাতের অন্যতম বাজার হল চিন।
বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ বলছেন, ১৩ বছর আগে লেহম্যান ব্রাদার্স ধসে পড়ায় গোটা বিশ্বে যে আর্থিক সমস্যা তৈরি হয়েছিল, এভারগ্রান্ডের ক্ষেত্রেও আমরা আবার তা প্রত্যক্ষ করতে পারি। মাথায় রাখতে হবে শুধু চিনের বাজার থেকেই নয়, সংস্থাটি বিশ্বের নানান সংস্থার কাছ থেকেই ঋণ নিয়েছে। আর তাই সংস্থাটি ডুবলে বিশ্বের অনেক আর্থিক সংস্থারই নিঃশ্বাস আটকে আসতে পারে। আরও মাথায় রাখতে হবে, কোভিড-উত্তর বিশ্ব বাজারের অবস্থা এখন বেশ নড়বড়ে।
অনেকেই আবার বলছেন যে অতটা না হলেও ১৯৯৬ সালে এশিয়া জুড়ে আর্থিক বাজারে যে সঙ্কট হয়েছিল এভারগ্রান্ড সমস্যা না মিটলে সেই একই সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে এশিয়ার আর্থিক বাজার।
১৯৯৬ সালে তৈরি হওয়া এই সংস্থাটির অন্যতম মালিক শু জিয়ায়িন চিনের রাজনৈতিক ক্ষমতা বলয়ের কাছের মানুষ। তাই আবার অনেকেই বলছেন, চিনা সরকার হয়ত সংস্থাটিকে পুরোপুরি ডুবতে দেবে না। কিন্তু চিনের নির্মাণ শিল্পকে শিক্ষা দিতে হয়ত শেষে গিয়ে চিনা নাগরিকদের স্বার্থ যাতে লঙ্ঘিত না হয় তা দেখতে ব্যবস্থা নেবে। তবে বিদেশি সংস্থাদের ক্ষতির একটা বড় অংশ বহন করতে হবে।
ব্যাঙ্কগুলোও আতঙ্কে। এতটাই যে গত সপ্তাহ থেকে সংস্থার প্রকল্পের ফ্ল্যাট বা অন্য কিছু কিনতে গেলে ব্যাঙ্কগুলি আর ঋণ দিতে চাইছে না। তাদের ভয় এভারগ্রান্ড ডুবে গেলে প্রকল্প শেষ হবে না। আর সে ক্ষেত্রে ঋণের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়েও সমস্যা হতে পারে।
ফাইল চিত্র।
এই অবস্থার জন্য অবশ্য বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছে সংস্থার পরিচালকদেরই। অপ্রয়োজনীয় ঋণ আর আর্থিক পরিচালনার ক্ষেত্রে অপেশাদারি মনোভাবই গোটা সমস্যার মূলে রয়েছে বলে মনে করছেন সবাই। আর এই কারণেই ব্যাঙ্কগুলি এভারগ্রান্ডের তৈরি ঘরবাড়ি কিনতে চাইলে ক্রেতাদের ঋণ দিতে চাইছে না। আর এর ফলে সংস্থাটির নগদের জোগানের সমস্যাও তৈরি হয়েছে। বাজারে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সংস্থাটি সেই চাহিদা মিটিয়ে টাকা ঘরে তুলতে পারছে না, স্রেফ তাদের উপর বাজারের আস্থা চলে যাওয়াতেই।
লেহম্যান ব্রাদার্স বা ১৯৯৬ সালের এশিয় বুদবুদের সময়ও প্রাথমিক ভাবে সমস্যা শিরোনামে আসেনি। এসেছিল বিশ্ববাজার ডুবে যাওয়ার পরেই। কিন্তু এই মুহূর্তে কোভিড উত্তর বাজারে এমনিতেই নানা অনিশ্চয়তা। তার উপর এই এভারগ্রান্ড সমস্যা যে ভাবে গতি পাচ্ছে তাতে একে এড়িয়ে না থেকে এর অভিঘাতের উপর নজর রাখাটা কিন্তু খুচরো বিনিয়োগকারীদের কাছে খুবই জরুরি। বিশেষ করে এমন একটা সময়ে যখন বাজার এমনিতেই সাংঘাতিক তেতে রয়েছে। ইস্পাতের শেয়ারের পতন কিন্তু প্রাথমিক ইঙ্গিত। এভারগ্রান্ডের কারণে ভবিষ্যত নিয়ে সংশয়ে থাকছেই।