ছবি রয়টার্স।
দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট কড়া ধমক দিয়ে বলল, ১৭ মার্চের মধ্যে টেলিকম সংস্থাগুলি স্পেকট্রাম ব্যবহারের চার্জ ও লাইসেন্স ফি বাবদ কেন্দ্রীয় সরকারের পাওনা মিটিয়ে না-দিলে আদালত অবমাননার দায়ে পড়বেন সংস্থার কর্ণধারেরা। পাশাপাশি, বকেয়া আদায়ের ব্যাপারে কেন নরম মনোভাব দেখানো হচ্ছে, এই প্রশ্ন তুলে কেন্দ্রকেও কঠোর ভর্ৎসনা করল তারা। তার পরেই সন্ধ্যায় কেন্দ্র জানিয়ে দিল, ঘড়ির কাঁটা শনিবারে পৌঁছনোর আগেই, অর্থাৎ শুক্রবার রাত ১১টা ৫৯ মিনিটের মধ্যে সব টাকা মিটিয়ে দিতে হবে টেলিকম সংস্থাগুলিকে।
বিচারপতি অরুণ মিশ্র, বিচারপতি এস আব্দুল নজির এবং বিচারপতি এম আর শাহের ডিভিশন বেঞ্চের রায় এবং কেন্দ্রের নির্দেশিকার জেরে তোলপাড় টেলিকম শিল্প। ভোডাফোন-আইডিয়া এবং এয়ারটেল, এই দুই সংস্থার কাছ থেকেই বেশির ভাগ টাকা পাওনা কেন্দ্রের। সব মিলিয়ে যার পরিমাণ প্রায় ১ লক্ষ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। ভোডাফোন-আইডিয়া আগেই জানিয়েছে, সংস্থার যা আর্থিক অবস্থা, তাতে ত্রাণ না-পেলে তারা তাদের বকেয়া ৫৩ হাজার কোটি টাকা মেটাতে পারবে না। প্রয়োজনে তাঁরা ব্যবসা গুটিয়ে ফেলবেন, বলেছেন সংস্থার চেয়ারম্যান কুমার মঙ্গলম বিড়লা।
সুপ্রিম কোর্ট কার্যত ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময় দিলেও কেন্দ্র কেন শুক্রবার মাঝ-রাতের মধ্যেই টাকা মেটানোর নির্দেশ দিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তা ছাড়া, বিএসএনএল ধুঁকতে থাকায় মোবাইল বাজারে এ বার কি শুধুই জিয়ো বনাম এয়ারটেল, জল্পনা সেটাও।
কার কত বকেয়া
• ভোডাফোন আইডিয়ার ৫৩,০৩৮ কোটি টাকা
• এয়ারটেলের ৩৫,৫৮৬ কোটি টাকা
• এয়ারটেল সেই টাকা সরিয়ে রাখলেও, ভোডাফোন রাখতে পারেনি
• রিলায়্যান্স জিয়ো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ১৯৫
কোটি মিটিয়েছে
এয়ারটেলের বকেয়ার পরিমাণও অবশ্য কম নয়। প্রায় সাড়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। তবে সেই টাকার সংস্থান করা আছে বলেই সংস্থা সূত্রের দাবি। আজকের নির্দেশিকার পরে টেলিকম দফতরকে লেখা চিঠিতে এয়ারটেল বলেছে, ২০ তারিখের মধ্যে ১০ হাজার কোটি এবং ১৭ মার্চ সুপ্রিম কোর্টে পরবর্তী শুনানির আগে বাকি টাকা মিটিয়ে দিতে চায় তারা। ভোডাফোন কী করবে, তা রাত পর্যন্ত জানা যায়নি। বিএসএনএলের বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।
শীর্ষ আদালত অবশ্য অনেক আগেই টেলিকম সংস্থাগুলিকে বকেয়া মেটানোর নির্দেশ দিয়েছিল। গত ২৪ অক্টোবরের রায়ে তিন মাসের মধ্যে টাকা মেটানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু গত ২৩ জানুয়ারি টেলিকম দফতর নির্দেশিকা দিয়ে বলে, টেলি সংস্থাগুলি সুপ্রিম কোর্টের রায় মান্য করতে ব্যর্থ হলে তাদের উপরে চাপ দেওয়া যাবে না বা তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
বিচারপতি বলেন
• আদালতের নির্দেশ লঙ্ঘন করেছে সংস্থাগুলি। সরকারের প্রাপ্য বকেয়া জমার নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করা নিয়ে রিভিউ পিটিশন খারিজ হয়েছে। অথচ এখনও টাকা জমা দেয়নি কেউ। দেখে মনে হচ্ছে, আদালতের নির্দেশের প্রতি তাদের একফোঁটাও শ্রদ্ধা নেই।
• টেলিকম দফতরের এক অফিসারের এত ঔদ্ধত্য যে, কোর্টের রায় সত্ত্বেও তিনি নির্দেশ দিয়েছেন বকেয়া মেটাতে কোনও সংস্থাকে জোর না-করতে এবং কেউ টাকা না-দিলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না-নিতে। নির্দেশ না-মানায় তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার প্রক্রিয়া শুরু করছি। সন্ধের মধ্যে উনি নির্দেশটি না-ফেরালে জেলে যাওয়ার জন্য তৈরি থাকুন।
• নিজেকে নিয়ে ভাবি না, আপনারা আমাকে এক ইঞ্চিও বুঝতে পারেন না। একজন অফিসার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দিচ্ছেন। উনি কি আদালতেরও উপরে! এটা সহ্য করা যায় না।
• দেশে কি আইন নেই? সুপ্রিম কোর্টকে কি তা হলে গুটিয়ে ফেলতে হবে!
• আমি বেদনার্ত। মনে হয় না এই ব্যবস্থার মধ্যে এবং
এই আদালতে আর কাজ করা উচিত।
• আমি এত রেগে যাই না। কিন্তু এই ব্যবস্থা ও দেশের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা হারিয়েছি। এই দেশে থাকার চেয়ে ছেড়ে চলে যাওয়া ভাল।
এই নির্দেশিকা নিয়ে আজ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতিরা বলেন, ‘‘আমরা জানি না, এই রকম অর্থহীন ব্যাপার কারা তৈরি করছেন।... এক জন ডেস্ক অফিসার নিজেকে বিচারপতি বলে মনে করছেন এবং আমাদের রায় স্থগিত করে দিচ্ছেন! দেশে কি আইন বলে কিছু নেই? এ দেশে থাকার চেয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াই ভাল।’’
রায়ের পরেই ভোডাফোনের শেয়ার দর প্রায় ২৮ শতাংশ পড়ে যায়। দিনের শেষে পতনের পরিমাণ প্রায় ২৩ শতাংশ। টেলিকম দফতরের নির্দেশের পরে, শেয়ার বাজারে লগ্নিকারীদের সঙ্গে ‘কনফারেন্স কল’-ও বাতিল করে দেয় ভোডাফোন। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ভোডাফোন সত্যিই বন্ধ হয়ে গেলে মোবাইল পরিষেবার দুনিয়া কার্যত দু’টি সংস্থার প্রতিযোগিতায় সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। এমনিতেই মোবাইল পরিষেবার মাসুল বাড়ছে। প্রতিযোগিতা কমলে মাসুল আরও বাড়তে পারে। সর্বোপরি ভোডাফোন বন্ধ হলে হাজার হাজার কর্মীর কী হবে, সেই প্রশ্ন উঠেছে। সার্বিক ভাবে লগ্নিকারীদের কাছেও ভুল বার্তা যেতে পারে। নরেন্দ্র মোদী সরকার ও তার টেলিকম দফতরের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বাজেটের পরে এয়ারটেলের কর্ণধার রাজন ভারতী মিত্তল অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে টেলিকম শিল্পের দিকে নজর দিতে বলেছিলেন। কিন্তু সরকার ১৪ বছরের পুরনো বকেয়া আদায় করার অবস্থানে অনড় ছিল।
টেলিকম দফতরের নির্দেশের পরেই আদালতের রায় মানা হচ্ছে না বলে সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ জমা পড়েছিল। আজ বিচারপতি অরুণ মিশ্রের বেঞ্চে এই মামলা আসতেই তিনি কার্যত তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। বিচারপতি মিশ্র বলেন, ‘‘ওই অফিসারকে এখানে ডাকুন।’’ কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতাকে বিচারপতি প্রশ্ন করেন, ‘‘এই অফিসারের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? আমরা কি সুপ্রিম কোর্ট তুলে দেব? এর পিছনে কি টাকার খেলা নেই? কারা এ-সব স্পনসর করছে? সব রকম দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।’’
বিচারপতি মিশ্র এর পরে টেলিকম দফতরের সংশ্লিষ্ট অফিসারের জবাব তলব করে বলেন, সন্ধ্যার মধ্যে ২৩ জানুয়ারির নির্দেশ প্রত্যাহার করা না-হলে তাঁকে জেলে যেতে হবে।