যদি গাছ কাটাকে আর্থিক অঙ্কে ক্ষতি আর তার রক্ষাকে আর্থিক লাভের অঙ্কে বদলে ফেলতে পারি তা হলে হয়ত সমস্যাটাকে কিছুটা সামাল দেওয়া যাবে। আর এই ভাবনা থেকেই উঠে আসে ‘কার্বন ক্রেডিট’।
পরিবেশ বাঁচাতে পদক্ষেপ করলেও কর দিতে হবে? ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল থেকে ভারতীয় আয়কর আইনের ১১৫ বিবিজি ধারা অনুযায়ী পরিবেশ বাঁচিয়ে কার্বন ক্রেডিট অর্জন করে তা বিক্রি করলে ১০ শতাংশ হারে কর দেওয়ার নিয়ম তৈরি হয়েছে। আর বিতর্ক চলছে তা নিয়েই।
প্রেক্ষিতটা দেখে নেওয়া যাক। কেরালায় বন্যা, বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি, চেন্নাই ভেসে যাওয়া আর গোটা বছর ধরে আবহাওয়ার নানান পরিবর্তন দুশ্চিন্তা পেরিয়ে এখন ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে লোভের কাছে ভয় নস্যি। তাই বিশ্ব জুড়েই লাভের প্রত্যাশায় গাছ কাটা অব্যাহত। আমাজনের অরণ্য মিলিয়ে যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় তাল গাছের চাষের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হচ্ছে সে দেশের দুষ্প্রাপ্য গাছের অরণ্য। ভারতেও অরণ্য হার মানছে লাভের লোভের কাছে।
এটা যে হবেই তা বুঝেই ভাবনাটা শুরু হয়েছিল। ভাবনার অঙ্কটা ছিল এই রকম। বাতাসে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। গাছ বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে কার্বন শুষে বাতাসে অক্সিজেন ছাড়ে। এ বার একদিকে বাতাসে বিষ বাড়ছে যা উষ্ণায়নের ইন্ধন। উল্টোদিকে আমরা বাতাসের প্রাকৃতিক ফিল্টার যে অরণ্য, তাকে ধ্বংস করে লাভের জমি তৈরি করছি।
এ বার যদি গাছ কাটাকে আর্থিক অঙ্কে ক্ষতি আর তার রক্ষাকে আর্থিক লাভের অঙ্কে বদলে ফেলতে পারি তা হলে হয়ত সমস্যাটাকে কিছুটা সামাল দেওয়া যাবে। আর এই ভাবনা থেকেই উঠে আসে ‘কার্বন ক্রেডিট’।
১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়োটোতে রাষ্ট্রপুঞ্জের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রথম এই ধারণাকে ব্যবহারযোগ্য একটা ভূমি দেওয়ার চেষ্টা করে। ২০০১ সালে জার্মানিতে ১৯১টি দেশ এটি মেনে নেওয়ার অঙ্গীকার করলেও বিশ্ব দূষণে অন্যতম অভিযুক্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটি মানতে চায়নি। বিশ্বব্যাঙ্কের সাম্প্রতিকতম সমীক্ষাতেও দূষণের দায়ভার নিয়ে চিন প্রথম স্থানে, তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের স্থান চতুর্থ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পরেই।
পরবর্তী নানান আলাপ আলোচনার জটিলতা এড়িয়ে এটা বলা যায় যে দূষণকারী ব্যবসায় প্রতি টন দূষণকারী গ্যাস কমানোর জন্য একটি কার্বন ক্রেডিট পাওয়া যায়। এই ক্রেডিট কেনা-বেচার জন্য বাজার রয়েছে। যে দূষণ কমাতে পারছে না সে এই ক্রেডিট কিনবে। যে দূষণ কমাতে পারছে সে তার অর্জিত ক্রেডিট বিক্রি করে আয় করবে। কোথাও এ বাজার সরকার নিয়ন্ত্রিত, কোথাও বা তা বেসরকারি। তবে কেনাবেচা হয় নিলামে। ভারতে এখনও কোনও সরকার স্বীকৃত বাজার নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্টের ১১টি প্রদেশে আঞ্চলিক ভাবে স্বীকৃত বাজার তৈরি হয়েছে। যদিও তা নিয়ে বিতর্ক চলছেই।
ভারতে সরকার নিয়ন্ত্রিত বাজার নেই বলা মানে এই নয় যে, ভারতে দূষণরোধের আর্থিক কোনও ব্যবস্থা নেই। মাথায় রাখতে হবে কার্বন ক্রেডিট দূষণরোধের একটি আর্থিক পথ। তেমনি অন্য নানা রয়েছে। যেমন, সৌরশক্তির ব্যবহারে ভর্তুকি। বা দুষণ হয় এমন উৎপাদন ব্যবস্থার উপর শাস্তিমূলক কর।
ফেরা যাক কার্বন ক্রেডিট প্রসঙ্গে। ২০১৬ সালে সুভাষ কোবিনি পাওয়ার বলে একটি সংস্থা জাপানের একটি সংস্থাকে কার্বন ক্রেডিট বিক্রি করে চার কোটি ৮৯ লক্ষ টাকায়। আয়কর বিভাগ এই লেনদেনকে ব্যবসার আয় হিসাবে দেখে কর ধার্য করে। সংস্থাটি কর্নাটক হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়। সব পক্ষের বক্তব্য শুনে হাইকোর্ট যে রায় দেয় তার মোদ্দা কথা হল, কার্বন ক্রেডিট সংস্থার ব্যবসা নয়। তা এই ব্যবসার উদ্দেশ্যও নয়। সংস্থাটি পরিবেশবান্ধব কাজ করায় এই ক্রেডিট সে পেয়েছে। অতএব একে গণ্য করা উচিত সংস্থার সম্পদ হিসাবেই।
একই বছর আরেকটি মামলায় আমদাবাদের আদালত আবার একে আয় হিসাবে গণ্য করার নির্দেশ দিয়েছে। আবার দেখছি অন্ধ্রপ্রদেশ হাইকোর্ট মনে করছে কার্বন ক্রেডিট আয় করাকে সম্পদ হিসাবে দেখা উচিত।
২০১৮ সালের আয়করের নতুন ধারা কার্বন ক্রেডিটে লেনদেনকে করযোগ্য হিসাবে দেখায় আইনি পথে আদালতের ধারণার উপর নির্ভর করার দায় কমে যায়। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, কেন্দ্র অন্তত এই লেনদেনকে করের আওতার বাইরে রাখলে, উৎপাদকদের দূষণ কমানোর উৎসাহটা বাড়ত।
মাথায় রাখতে হবে চিনের তুলনায় আমাদের উৎপাদন শিল্পের প্রসার তত বিস্তৃত নয়। আর চিনের পরিবেশ দূষণের ৭৭ শতাংশের জন্য দায়ী তাদের উৎপাদন শিল্পই। এই শিল্পে ভারতের তুলনামূলক ভাবে পিছিয়ে থাকাকে আবার অনেকেই আশীর্বাদ হিসাবেই দেখছেন। কারণ, সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তির বদল হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তিতে দূষণের পরিমাণ উত্তরোত্তর কমছে। ভারতের শিল্প তার সুযোগ নিতে পারবে বলেই নয়, হয়ত এক পা এগিয়ে এ দেশের নতুন শিল্প তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব হবে।
তবে একটা বিষয় পরিষ্কার। পরিবেশ দূষণ না কমাতে পারলে পৃথিবীর কিছু যাবে আসবে না। আমাদের সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। এ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু কী ভাবে এই নিয়তি এড়াতে পারব তার পথ জানা থাকলেও, সেই পথে কী ভাবে হাঁটব তা আমরা স্থির করে উঠতে পারছি না। চিন্তা তা নিয়েই। কার্বন ক্রেডিট লেনদেনের উপর কর ও তা নিয়ে মতান্তর শুধু তার একটা উদাহরণ মাত্র।