টানা উত্থানের পরে বড় মাপের পতন দেখল শেয়ার বাজার। গত সপ্তাহের শুরুতে অর্থাৎ সোমবার সেনসেক্স খুইয়েছিল ১১৪৫ পয়েন্ট। পরের তিন দিনে সেই পতন পুষিয়ে নেয়। সপ্তাহের শেষে অর্থাৎ শুক্রবার আবার ১৯৩৯ পয়েন্ট তলিয়ে নামে ৪৯,১০০-র কাছে। ৫৬৮ পয়েন্ট হারায় নিফ্টি-ও। ১৫ হাজারের ঘরে থেকে তা নেমে আসে ১৪,৫২৯ অঙ্কে। তবে শুধু ভারতে নয়, পতন দেখেছে গোটা বিশ্ব।
আসলে মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কায় আচমকাই নেমেছে বন্ডের দাম, বেড়ে উঠেছে ইল্ড। ফলে সুদের হার বাড়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর সুদ বাড়তে পারে, এই আশঙ্কাতেই ধস নামে আমেরিকার শেয়ার বাজারে। তার ধাক্কা আছড়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। আমেরিকায় সুদ বাড়লে ভারত থেকে বিদেশী আর্থিক সংস্থার লগ্নি বেরিয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় কাবু হয় এ দেশের বাজারও।
তবে এই পতন ভাল শেয়ার কম দামে কেনার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। নাগাড়ে উঠে ৫০ হাজার পেরনো বাজারে যা পাওয়া যাচ্ছিল না। তার উপরে আগামী অর্থবর্ষ থেকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে আশা। যে কারণে রেটিং সংস্থা মুডিজ়ের পূর্বভাস ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার ১৩.৭% হতে পারে। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের অনুমান, ২০২২ সালে এ দেশ এগোতে পারে ১১.৫% হারে। অর্থনীতি ফের উন্নতির পথে এগোলে শেয়ার বাজারের জমি পোক্ত হবে। আশা করা যায়, সূচক আরও অনেক নজির গড়বে। লগ্নিকারী তার সুফল পেতে ‘কম জলে ভাল মাছ’ ধরতে নামতে পারেন।
একই কথা বলা যায় বন্ডে লগ্নির ক্ষেত্রে। বন্ডের দাম অনেকটা নামায়, অতীতে যাঁরা বন্ড এবং বন্ড ফান্ডে লগ্নি করেছেন, তাঁরা লোকসানের মুখে পড়েছেন। কিন্তু নতুন করে যাঁরা বন্ড এবং বন্ড ফান্ডে লগ্নি করবেন, ন্যাভ কমে আসায় তাঁরা কম দামে বেশি ইউনিট কিনতে পারবেন।
অবশ্য ব্যাঙ্কগুলি মোটা টাকা লগ্নি করে সরকারি বন্ডে। বন্ডের দাম পড়ায় বহু টাকা লোকসান গুনতে হবে তাদের। মূলত এই কারণেই ব্যাঙ্কের শেয়ারে ধস নেমেছিল শুক্রবার।
মার্চের পর থেকে দ্রুত লাফিয়ে যে সেনসেক্স নজিরবিহীন সময়ে ৫০ হাজারের মাইলফলক পেরিয়েছিল, শুক্রবার তা-ই দেখেছে ১০ মাসের সব থেকে বড় পতন। যার অভিঘাতে এক দিনেই লগ্নিকারীরা হারিয়েছেন ৫.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা। ১৫ ফেব্রুয়ারি সূচক উঠেছিল ৫২,১৫৪ পয়েন্ট। ১০ দিনে কমল ৩০০০ পয়েন্ট। শেয়ার নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ডগুলির ন্যাভও কমেছে।
অনেকখানি দাম কমেছে ভারতীয় বন্ডেরও। দ্রুত বেড়েছে বন্ড ইল্ড। ৫ জানুয়ারি যে ইল্ড ছিল ৫.৮৫%, তা-ই ২৬ ফেব্রুয়ারি উঠেছে ৬.২৩ শতাংশে। অর্থাৎ ৩৮ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি। ইল্ড এতটা বেড়ে ওঠায় সুদ বাড়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ভারতেও। যা শিল্প এবং শেয়ার বাজার কখনওই চায় না। কয়েকটি গৃহঋণ এবং ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে কম-বেশি ৩০ বেসিস পয়েন্ট সুদ বাড়িয়েছে তাদের আমানত প্রকল্পে।
সরকারি কোষাগারে বড় রকমের ঘাটতি হওয়ায় চলতি অর্থবর্ষের বাকি দিনগুলিতে কেন্দ্রকে বাজার থেকে সংগ্রহ করতে হবে ৮৪,০০০ কোটি টাকা। পরের অর্থবর্ষে (২০২১-২২) রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১২ লক্ষ কোটি টাকা। ইল্ড এতটা বেড়ে ওঠায় বন্ডের সুদ বাবদ সরকারের খরচ অনেকটাই বেড়ে যাবে, যা অর্থনীতির পক্ষে মোটেও কাম্য নয়। বন্ডের ইল্ড নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। তবে দেশে পেট্রল, ডিজেল এবং রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের দাম যে ভাবে চলেছে, তাতে আগামী দিনে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হারকে নিয়ন্ত্রণে রাখা শক্ত হবে। মূল্যবৃদ্ধি চড়লে সুদ বাড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি হবে। অর্থনীতির পক্ষে সেটাও কাম্য নয়। তাই তেলের দাম কমাতে কর ছাঁটাইয়ের সওয়াল করছেন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস।
শেয়ারের এতটা পতনে মুষড়ে না-পড়ে একে সুযোগ হিসেবে দেখতে হবে। যথাযথ কারণ ছাড়াই বাজার যে জায়গায় পৌঁছয় তাতে এই পতন কাম্য ছিল। বরং পতনের মাধ্যমে বাজার দেশের আর্থিক পরিস্থিতির বিচারে নিজেকে কিছুটা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, যাকে ‘কনসোলিডেশন’ বা আঁটোসাঁটো হওয়া বলা হয়।
(মতামত ব্যক্তিগত)