Budget 2021

ঐতিহাসিক সংস্কার? বাস্তব কিন্তু বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিরোধী

এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ হতে চলেছে এমন একটি অবস্থায় যাকে বলে অভূতপূর্ব।

Advertisement

অচিন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২১ ১৭:০২
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ হতে চলেছে এমন একটি অবস্থায় যাকে বলে অভূতপূর্ব। পূর্বাভাস বলছে ২০২০-’২১ আর্থিক বছরে ভারতের জিডিপি বা মোট জাতীয় উৎপাদন গত বছরের তুলনায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ নীচে থাকবে। যে দিন থেকে এ দেশে জিডিপি মাপা হচ্ছে তখন থেকে এমন সঙ্কোচন ঘটেনি। আবার পূর্বাভাস এ-ও বলছে যে ২০২১-’২২ অর্থবর্ষে গিয়ে বৃদ্ধির মুখ দেখা যাবে এবং তা হবে ৯ শতাংশের আশেপাশে। অতি সম্প্রতি অবশ্য আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার পূর্বাভাস দিয়েছে ২০২১-’২২-এ বৃদ্ধি হবে ১১.৫ শতাংশ। যদি তা বাস্তবায়িত হয়, বলা যায় ২০২১-২২ অর্থবর্ষের জিডিপি ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের জিডিপির প্রায় সমান হবে, সঙ্কোচনের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে।

Advertisement

বাজেটের প্রাক্কালে এটি এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখে এনে ফেলেছে মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে। এতকাল অমুক খাতে বরাদ্দ বাড়ল বলে ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শাসকপক্ষের সাংসদদের জয়ধ্বনি দিতে দেখা যেত। কৌতূহল হচ্ছে, এ বার সেটি কেমন হবে। বরাদ্দ বাড়ানো যায় সরকারের আয় বেশি হলে। আর সরকারের আয় বেশি হয় জিডিপি বাড়লে। কিন্তু আগামী বছরের জিডিপি যে হেতু গত বছরের প্রায় সমান হবে, কোনও খাতে বরাদ্দ বাড়াতে গেলে অন্য খাতে কমাতে হবে। না হলে ঘাটতি বাড়বে। ঘাটতি যে বাড়বে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে যে বরাদ্দও বাড়বে তা-ও অনুমান করা যায়। যেমন স্বাস্থ্যে। কোভিডের পর প্রথম বাজেটে স্বভাবতই সকলের নজর থাকবে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ কতটা বাড়ল সেই দিকে। স্বাস্থ্যে বাজেট বরাদ্দ বছরের পর বছর জিডিপির এক থেকে দেড় শতাংশের মধ্যেই থাকে। যদিও এ যাবৎ যত বিশেষজ্ঞ কমিটি হয়েছে প্রত্যেকেই একবাক্যে বলেছে তা অন্য যে কোনও দেশের তুলনায় কম। একে অন্তত আড়াই শতাংশ করা উচিত। কিন্তু বাজেটের পর বাজেট এসেছে, তা করা হয়নি।

অন্য দিকে একশো দিনের কাজেও বরাদ্দ বাড়তে পারে। কারণ রাজনৈতিক লাভক্ষতির হিসেবে এ ক্ষেত্রটিরও গুরুত্ব থাকবে এর দৃশ্যমানতার কারণে। তা হলে কি অন্য নানা ক্ষেত্রে বরাদ্দে কোপ পড়বে? আশঙ্কা হয়, শিক্ষা থেকে ভাগ্যদেবী মুখ ঘুরিয়ে নেবেন। তার কারণ, এই মুহূর্তে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি তোলার মতো কাউকে দেখছি না। অথচ এই কোভিডকালেই ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ এসে পড়ল। সরকারের কালচেতনার তারিফ করতেই হয়। গত বছরের জুলাই মাসে দেশবাসীর জন্য নতুন শিক্ষানীতি ঘোষিত হল। স্কুল-কলেজ বন্ধ, শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবক সবাই অনলাইন ক্লাস নিয়ে দিশাহারা, ঠিক সে সময়েই এমন নীতিকথার প্রয়োজন অনুধাবন করা সহজ নয়। এমন সরকারি দলিল-দস্তাবেজ অবশ্য স্বভাবতই ভাল ভাল উদ্দেশ্যে পূর্ণ থাকে। যেমন, বিশেষ ভাবে বলা হয়েছে জাতীয় আয়ের অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষায় খরচ করতে হবে। গত বছর পর্যন্ত এই পরিমাণ ছিল চারের নীচে। ছ’য়ে পোঁছতে গেলে ফি বছরের বাজেট লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে হবে। কোভিড পরিস্থিতিতে তা অসম্ভব। অতএব শিক্ষানীতি অনুসারে ব্যয়বৃদ্ধির ভাবনা আগামী কয়েক বছর হয়তো মুলতুবি রাখতে হবে। কিছুকাল আগের কয়েক বছরের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখছিলাম, যে বছর বাজেটে গ্রামোন্নয়নে (যার প্রায় সবটাই একশো দিনের কাজ) ব্যয় বরাদ্দ শতাংশের হিসেবে একটু বেশি বেড়েছে, সে বছরেই স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে কম শতাংশ। সাধারণত কাছাকাছি নির্বাচন থাকলে তেমনটা হয়েছে, কারণ একশো দিনের কাজের যে দৃশ্যমানতা আছে— মানুষজন কাজ পাচ্ছে দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য বা শিক্ষায় তা নেই।

Advertisement

ফিরে আসি অভূতপূর্ব পরিস্থিতির কথায়। আর একটি ব্যাপার এর মধ্যে ঘটে যাচ্ছে। সেনসেক্স ঊর্ধ্বপানে বাড়ছে। এর সঙ্গে অর্থনীতির প্রকৃত স্বাস্থ্যের কোনও সম্পর্ক নেই। ক’দিন আগেই সেনসেক্স ৫০ হাজারের গণ্ডি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। যদিও প্রজাতন্ত্র দিবসের পরের দিনই সূচক অনেকটা পড়ে গিয়েছে। আগে সেনসেক্স তরতর করে বাড়লে আর কিছুর তোয়াক্কা না করে সে দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বলা হত অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। সেই দাবি যাঁরা করতেন, এখন তাঁরা গুটিয়ে গিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, এ আসলে বুদবুদ, ফাটতে দেরি নেই। এ ক্ষেত্রেও অর্থমন্ত্রীর চিন্তার কারণ আছে। বিশেষত এই অবস্থায় এখন শেয়ার বাজারে দাম পড়তে থাকলেও বিপদ। কারণ লোকে বলবে, “দেখেছ, এই বাজেটে কর চাপানো হবে আন্দাজ করেই পুঁজি বাজার ছাড়ছে। তাই বাজার পড়তে শুরু করেছে।” মন্ত্রী মহোদয়া যদি এই কটাক্ষের দিকটি আগেভাগেই অনুমান করতে পারেন তা হলে কর চাপানোর ইচ্ছে নির্ঘাত গিলে ফেলবেন। বিশেষত ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরেই এক বার কর্পোরেট আয়ের ওপর কর অনেকটা কমানো হয়েছিল। তার পরিণতিতে বিনিয়োগ কতটা বাড়ল বুঝে ওঠার আগেই করোনাভাইরাস এসে গেল। এখন আর কোন যুক্তিতে কর্পোরেট কর বাড়ানো যায়?

শেয়ারের দাম ফুলেফেঁপে ওঠার কারণ বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে এর পিছনে আছে উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলির তাদের অর্থনীতিতে বিপুল পরিমাণে নগদের যোগান এবং সেই দেশগুলিতে সুদের হারকে প্রায় শূন্যে নিয়ে যাওয়া। ফলে বিদেশ থেকে পুঁজি আসছে ভারতে, একটু লাভের আশায়। কিন্তু সে সব দেশে সুদ বাড়তে শুরু করলেই যে কোনও সময়ে পুঁজি আবার পালাতে শুরু করবে। ফলে সেনসেক্স পড়বে। ২০১৩ সালে এক বার এ রকম হয়েছিল, যখন আমেরিকায় সুদের হার বাড়ছে অনুমান করে ভারত-সহ অন্যান্য উঠে-আসতে-থাকা দেশগুলি ছেড়ে পুঁজি পালিয়েছিল। বিদেশি পুঁজি যখন বেরতে থাকে, সেনসেক্স পড়তে থাকে, শঙ্কিত হয়ে অন্যরাও শেয়ার বেচতে থাকে, দাম আরও পড়তে থাকে। বিদেশি পুঁজি বেরতে থাকলে ডলার সাপেক্ষে টাকার দামও কমতে থাকে, আমদানির খরচ বেড়ে যায়।

এ বছরের বৃদ্ধি নিয়ে যে রকম আশাবাদ দেখা যাচ্ছে কোনও কোনও মহলে, তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। সন্দেহের মূল কারণ, মন্দা কাটিয়ে চাহিদা যে গা ঝাড়া দিয়ে দ্রুতগতিতে উঠে দাঁড়াচ্ছে, তেমন লক্ষণ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। সামগ্রিক ভাবে দেশে সঞ্চিত মোট অর্থ যে পরিমাণ রয়েছে তার ভগ্নাংশমাত্র বিনিয়োগ হচ্ছে। সরকারি চেষ্টায় ঋণ সহজলভ্য করে তুলেও বিনিয়োগ তেমন বাড়ানো যাচ্ছে না। পণ্যের চাহিদার অভাবকেই তার কারণ বলে মনে হয়। সরাসরি নগদের যোগান বাড়িয়ে চাহিদা বাড়িয়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বারবার মনে করিয়ে দিলেও কোনও এক দুর্বোধ্য কারণে অর্থমন্ত্রক তা এড়িয়ে চলেছে। তাই বাজেটে যে এ বাবদে বিশেষ কিছু বৈপ্লবিক ঘোষণা থাকবে না তা অনুমান করা যায়। আশা করব এই অনুমান যেন মিথ্যে হয়।

(নির্দেশক, ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement