গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
আর মাত্র কয়েক দিন। তার পরেই ঘোষিত হবে ২০২১-২২-এর কেন্দ্রীয় বাজেট প্রস্তাব। শুধুমাত্র ভারতে নয়, গোটা বিশ্বেই, ২০২১ সালটা বা ২০২০-২১ আর্থিক বছরটা ভুলে যেতে চাওয়ার মতো সময়। ল্যাটিনে যাকে বলে আনাস হরিবিলিস। ভয়ঙ্কর বছরের এই ল্যাটিন বিশেষণটি কুইন এলিজাবেথের আগেও ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ১৯৯২ সালে, তাঁর তিন সন্তানেরই বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে অশান্তির কারণে এলিজাবেথের এই উক্তি এবং ২০০৪ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানান অভিযোগ প্রসঙ্গে কোফি আন্নানের মন্তব্য এই বিশেষণটির ব্যবহারকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছে।
আনাস হরিবিলিস-ই বটে! ১৯১৮ থেকে ১৯২০-র স্প্যানিশ ফ্লু-এর পরে এমন অতিমারি আর দেখা যায়নি। এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন বিশ্ব জুড়ে কোভিড-এ সনাক্ত করা গিয়েছে এমন আক্রান্তের সংখ্যা ৯.৭ কোটি, মৃতের সংখ্যা ২১ লাখের কাছাকাছি। বাস্তবে আক্রান্তের সংখ্যা নিঃসন্দেহে এর থেকে বেশি। ভারতে প্রথম ধাক্কাটা আসে ৩০ জানুয়ারি, ২০২০ অর্থাৎ প্রায় এক বছর আগে। বিশ্বের প্রতিটি লিপিভুক্ত প্লেগ এসেছে বিশ্বায়নের মারফৎ, এক রাষ্ট্র থেকে অন্য রাষ্ট্রে মানুষের যাতায়াতের ফলে। চিন থেকে ভারতে আসা প্রথম প্রতিপাদিত কোভিড সংক্রমণ ধরা পড়ে ৩০ জানুয়ারি ২০২০। ওই ইমিগ্রেশন-এর দরুন। ঘটনার পরে বুদ্ধির উন্মেষ সকলেরই ঘটে। মাথায় রাখতে হবে এই সব ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে তথ্যের অভাব থাকে। সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশ থেকে যাত্রী আসা বন্ধ করে দিলে নিশ্চয়ই প্রকোপ কম হতো। কিন্তু মূলত প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবেই তা সম্ভব হয়নি। চিন-ও স্পষ্ট করে তাদের কোভিড অভিজ্ঞতা বিশ্বের সঙ্গে ভাগ করে নেয়নি। তাই বিশ্বের অন্য দেশের ক্ষেত্রেও সমস্যাটা ছিল একই রকম।
ভুলে গিয়ে থাকতে পারি। তাই ১৮ থেকে ২১ মার্চের কথা স্মরণ করিয়ে দিই। সেন্টার ফর ডিজিজ ডায়নামিক্স, ইকনমিক্স অ্যান্ড পলিসি-র অধিকর্তার মুখ দেখা গিয়েছিল প্রত্যেকটি টিভি পর্দায়, সাক্ষাৎকার বেরিয়েছিল সংবাদপত্রে। তাঁর মতানুসারে ভারতের মতো অনগ্রসর দেশে ইনফেকশনের সম্ভাব্য সংখ্যা ছিল ৭০ থেকে ৮০ কোটি। মৃতের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ লক্ষ। এই মুহূর্তে ইনফেকশন-এর বাস্তবিক সংখ্যা ১ কোটি ৬ লক্ষ, মৃতের সংখ্যা ১ লক্ষ ৫৩ হাজার। অর্থাৎ যা ভয় করা হচ্ছিল, সেই তুলনায় দেশ ধাক্কাটা ভালই সামলেছে। অবশ্য কোভিড-এর ভবিষ্যৎ রূপরেখা এখনও স্পষ্ট নয়, যেমন স্পষ্ট নয় ভ্যাকসিন-এর উপযোগিতা। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে, ঝড়টা মোটামুটি সামলানো গিয়েছে। এই ঝড় সামলে যাওয়ার পিছনে একটা বড় কারণ লকডাউন। প্রথম লকডাউন শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ। তার পর ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে পয়লা জুন থেকে আন-লকডাউন চলছে। লকডাউন সম্বন্ধে বিতর্কের অভাব নেই, যদিও তা একটু প্রশমিত হয়েছে এখন। কারও মতে লকডাউন আরও আগে ঘোষণা করা প্রয়োজন ছিল, যেমন ধরুন ফেব্রুয়ারি মাসে। কারও মতে লকডাউন ছিল নিষ্প্রয়োজন। এর ফলেই অর্থনীতির করুণ অবস্থা। মানুষের চাকরি গিয়েছে, মাইনে কমেছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ত্রাহি ত্রাহি রব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ববিধি এখনও প্রচলিত। ফলে তাদের পুনরুজ্জীবন এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে লুক্কায়িত। আগেই বলেছি, অনেক সময় সিদ্ধান্ত নিতে হয় প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাব থাকা সত্ত্বেও। কোনও সরকারই ঝুঁকি নিতে চায় না যখন প্রাণহানির সম্ভাবনা প্রবল। লকডাউন না করার দরুন যদি সত্যি সত্যি মৃতের ২০ লক্ষ হয়ে দাঁড়াত, তা হলে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। মার্চ মাসে লকডাউন ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।
কোভিড-এর সরাসরি আর্থিক প্রভাব গ্রামাঞ্চলে তেমন পড়েনি। তার পিছনে অবশ্যই রয়েছে নানান সরকারি প্রকল্পের অবদান। নয়তো লকডাউন-এর প্রভাব হতো আরও ভয়াবহ। মনরেগা, প্রধানমনন্ত্রী জন-ধন প্রকল্প, রাষ্ট্রীয় সামাজাকি সাহায্য প্রকল্প, দরিদ্র আবাস যোজনা, সৌভাগ্য, প্রধানমন্ত্রী জন-আরোগ্য যোজনা, আয়ুষ্মান ভারত, স্বচ্ছ ভারত অভিযান, সরাসরি ভর্তুকি (ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার) ও আধার— এটি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের একটি নিছক তালিকা নয়। গ্রামীণ ভারত যে লাভবান হয়েছে তা প্রমাণিত। পরিযায়ীর গ্রামে ফিরে যাওয়ার ফলে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বৈকি। তবে মাথায় রাখতে হবে এ ধরনের প্রকল্পের পোর্টেবিলিটি না হওয়ার পিছনে কিন্তু রয়েছে ১৯৭৯ সালের ইন্টার স্টেট মাইগ্রান্ট ওয়ার্কমেন অ্যাক্টটি কোনও রাজ্যেই চালু না হওয়া।
লকডাউন চলাকালীন সরকারের অন্যান্য ঘোষণার কথা থাক। বাজেট-এর প্রসঙ্গে আসি। চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর চারিদিকে হইচই পড়ে গেল। প্রকৃত (রিয়েল) জাতীয় আয় বৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির হার যোগ করে পাওয়া যায় নমিনাল বা বর্তমান মূল্যে হিসেব করা আর্থিক বৃদ্ধির হার। তার সঙ্গে মূল্যমানে বৃদ্ধি (ইনফ্লেশন) যোগ করে পাওয়া যায় নমিনাল বৃদ্ধি। কোভিড-এর মুখ দেখার আগেই বিশ্বের অর্থনীতির অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। বিশ্বের অর্থনীতির হাল ভাল না হলে, ভারতের রফতানিও বাড়বে না। রফতানির সাহায্যে জাতীয় আয় বাড়ানোর সুযোগটা যাবে কমে। অনেকাংশে সে জন্যই ভারতে ২০১৭-১৮ থেকে আর্থিক বৃদ্ধিটা একটু ঢিমে তেতালায় চলছে। তার মানে এই নয় যে জাতীয় আয় বাড়ছে না। বাড়ছে, তবে আগে যে হারে বাড়ছিল, তার তুলনায় বৃদ্ধির হার হয়েছে কম। এই মন্দীভূত পরিস্থিতির উপর এসে পড়ল কোভিড ও আনুষঙ্গিক লকডাউন-এর ধাক্কা। তাই প্রথম ত্রৈমাসিকে শুধু যে জাতীয় আয় বৃদ্ধি হয়নি তা নয়, বরং ২৩.৫ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে। লকডাউন-এর ফলে যদি সাধারণ অর্থনৈতিক গতিবিধি ব্যাহত হয়, এমন হ্রাসটাই স্বাভাবিক। মনে রাখবেন, জাতীয় আয়ের একটা মুখ্য অবদান আসে শহুরে ভারত থেকে। এবং এই শহুরে ভারতে লকডাউনের ব্যাপকতা ছিল সর্বাধিক।
ওই ২৩.৫ শতাংশ হ্রাস দেখে তুমুল হইচই। সর্বনাশ ঘটে গিয়েছে। নানা দেশে দেখা গিয়েছে লকডাউনের রকমফের। এই ধরনের লকডাউন কতটা গুরুতর তা মাপার চেষ্টা করে অক্সফোর্ড কোভিড-১৯ গভর্মেন্ট রেসপন্স ট্র্যাকার (ওএক্সসিজিআরটি)। এর সাহায্যে একটা সূচক বা ইনডেক্স তৈরি করা হয়। সূচকের সর্বাধিক মান ১০০, সর্বনিম্ন ০। মান ১০০ হওয়ার তাৎপর্য সম্পূর্ণ লকডাউন। মান ০ হওয়ার মানে লকডাউন নেই। ২৭ জানুয়ারি ভারতে সূচকের মান ছিল ১০.১৯। ২৫ মার্চ হল ১০০। ৩০ জুন হল ৭৬.৩৯। প্রথম ত্রৈমাসিক অর্থাৎ এপ্রিল, মে ও জুন-এই তিন মাসের কথা বলা হচ্ছে। যদি এই ধরনের লকডাউন বলবৎ থাকে, তা হলে যে আয়ে হ্রাস ঘটবে, তা আর আশ্চর্য কি? সুতরাং লকডাউন-এর অপসারণ ঘটলেই অবস্থাটা এতটা সঙ্গীণ থাকবে না। বাস্তবে তাই হল। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকেও জাতীয় আয় হ্রাস পেয়েছে। তবে ২৩.৫ শতাংশ হ্রাস নয়, ৭.৫ শতাংশ হ্রাস। বাজেটের আগে তৃতীয় ত্রৈমাসিকের অঙ্কটি পাওয়া যাবে না। তবে কতগুলো ক্ষেত্র ছেড়ে দিলে মোটামুটি দেখা যাচ্ছে ঘুরে দাঁড়ানোর চিহ্ন ব্যাপক। যাকে প্রায় সার্বিকওবলা হয়। ফলে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে প্রকৃত বৃদ্ধির হার সংকোচনের সীমা পেরিয়ে বাস্তবিক বৃদ্ধির পথে হাঁটবে। সামগ্রিকভাবে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে আনুমানিক ৭.৫ শতাংশ আয়ের হ্রাস সত্য। ঠিক তেমনই, আগামী আর্থিক বছরে, অর্থাৎ ২০২১-২২-এ অন্তত ১০ শতাংশ জাতীয় আয়ে প্রকৃত বৃদ্ধি প্রায় নিশ্চিত সত্য। ইনফ্লেশন যোগ করলে হয়ত বা আপাত বৃদ্ধি হবে ১৫ শতাংশ।
অনিশ্চয়তা এখনও আছে—
১) কবে কোভিডকে সম্পূর্ণ ভাবে বিদায় জানানো যাবে, তা জানা নেই।
২) জানা নেই নাগরিক গতিবিধির উপর বাধা-নিষেধ কবে সম্পূর্ণ ভাবে উঠে যাবে। তা না হওয়া পর্যন্ত বাণিজ্য, হোটেল, রেস্তরাঁ, বেড়ানো, যান চলাচল— এই সব ক্ষেত্রে পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সম্পূর্ণ আর্থিক পুনরুজ্জীবন।
৩) টিকাকরণের উপর মোট কত ব্যয় হবে, তাও স্পষ্ট নয়।
৪) পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের সুপারিশের প্রভাব এখনও প্রত্যক্ষ হয়নি। আর এ বাবদ ব্যয়ের উপরও প্রভাব এখনও পরোক্ষ।
৫) ভ্যাকসিন ছাড়াও কোভিড সাব্যস্ত করেছে স্বাস্থ্য খাতে বেশি ব্যয় প্রযোজন।
৬) মূলধনী খাতে খরচ ও পরিকাঠামো ব্যয় বাড়াতে হবে।
৭) ঝট করে সরকারি কোষাগারের খরচের দক্ষতা বাড়ানো যায় না।
তাই এই সবের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে অনেক ক্ষেত্রে কৃত্রিম ভাবে ব্যয় সংকোচন বা এক্সপেনডিচার কমপ্রেশন করা হয়েছিল। তা তো আর ২০২১-২২ অর্থবর্ষে চলতে পারে না। রাজকোষ ঘাটতিও অত্যধিক বাড়ানো যাবে না, কারণ তার আছে নানাবিধ অবাঞ্ছিত প্রতিফল। অথচ এমন কিছু করতে হবে যাতে প্রকৃত জাতীয় আয় বৃদ্ধি ৫.৫ বা ৬ শতাংশের গণ্ডিতে আবদ্ধ না থাকে। তাও যথেষ্ট নয়।
মোটামুটি অর্থমন্ত্রীর অনিশ্চয়তা ও সমস্যার উল্লেখ করলাম। বাজেট ঘিরে আমাদের অনেক প্রত্যাশা। বাজেটকে আমরা যে চোখে দেখে এসেছি, তার চিরন্তন প্রত্যাশা হল কর কমা। করের ব্যাপারে স্থৈর্য (স্টেবিলিটি) এসে গিয়েছে। বছর বছর কর বদলাবে না, বদলানো উচিতও নয়। চূড়ান্ত স্থৈর্যে কি পৌঁছে গিয়েছি, তা অবশ্যই নয়। জিএসটি-তে সেই পথে দেশ খানিকটা এগিয়েছে। প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে সংস্কার এখনও বাকি। সংস্কারের পথে হাঁটা ভারতে বাজেটের মূল্যায়নের মাপকাঠি হওয়া উচিত সেই সংস্কারই।
(লেখক প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান। মতামত ব্যক্তিগত)