বিট (কেল) কয়েন

ইন্টারনেটে ঢুঁ মারলেই এখন বিটকয়েনের বিজ্ঞাপন। রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার হাতছানি। হাজার টাকা ঢাললে নাকি এক বছরেই তা কয়েক কোটি! অথচ জিনিসটা আদপে কী, তা-ই সবার কাছে স্পষ্ট নয় এখনও। এ মুদ্রার ঠিকুজি অজানা। যে কোনও দিন কিন্তু তা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে স্রেফ কর্পূরের মতো। সতর্ক করলেন শৈবাল বিশ্বাসশুধু আমরা  নই, এই মুদ্রা থেকে একশো হাত দূরে থাকতে বলছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ, কিংবদন্তি ধনকুবের ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফে। তাঁদের কাছে বিটকয়েন নেহাতই মরিচিকা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:১৩
Share:

মোবাইল, ল্যাপটপ কিংবা টেবিলে বসানো পুরনো কম্পিউটার— ইদানীং নেট খুলতেই চোখের সামনে চকচকে মুদ্রা। বিটকয়েন! সম্প্রতি তার দাম চড়েছে হু হু করে। হালে আগাম লেনদেনে ১ বিটকয়েনের দাম ছাড়িয়েছিল ২০ হাজার ডলার বা ১৩ লক্ষ টাকা! এখন তা ১০ লক্ষের ধারেপাশে। রীতি মতো চোখ কপালে ওঠার মতো অঙ্ক না? এক বছরে এই মুদ্রার দাম বেড়েছে ১৮-২০ গুণ। চোখে-চিন্তায় ধাঁধা লেগে যাওয়ার মতোই বটে। আর হয়তো সেই কারণেই আছড়ে পড়তে শুরু করেছে বিজ্ঞাপন— ‘এখানে টাকা রাখুন’। আর আজ আমাদের এই আলোচনাও ঠিক সেই কারণেই। কোথাও কারও টাকা রাখা-না-রাখা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু অন্তত এই মুদ্রার সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়টুকু সেরে নিতে চাই আমরা। দেখতে চাই তা এল কোথা থেকে? একই সঙ্গে স্পষ্ট বলতে চাই— এই মুদ্রার অনেক কিছুই এখনও স্পষ্ট নয়। ধোঁয়াশায় ভরা। এই কয়েন কোনও দেশের নয়। কোনও নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রক নেই। অনেকটা হাওয়ার ভিতে অট্টালিকার মতো। তাই সেখানে টাকা ঢালবেন কি না, আপনার ব্যাপার। আমরা শুধু বলব, তার আগে দশ বা হাজার বার নয়, লক্ষ বার ভাবুন। কোনও পরামর্শ নয়, বিষয়টির গোড়ার কথা জানাই আজকের আলোচনার মূল লক্ষ্য।

Advertisement

আমরা একা নই

শুধু আমরা নই, এই মুদ্রা থেকে একশো হাত দূরে থাকতে বলছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ, কিংবদন্তি ধনকুবের ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফে। তাঁদের কাছে বিটকয়েন নেহাতই মরিচিকা। এর থেকে মানুষকে সতর্ক করছেন বিভিন্ন দেশের আর্থিক নিয়ন্ত্রকরাও। তাদের মতে, মুনাফার লোভে এখানে সর্বসান্তও হতে পারেন কেউ। বিভিন্ন বেআইনি কাজে এর ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বারবারই। বেশ কয়েকটি দেশে ইতিমধ্যে বন্ধ হয়েছে বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ। টাকা হারিয়েছেন লগ্নিকারীরা। আর হ্যাঁ, বিটকয়েন একা নয়। এমন বহু ডিজিটাল মুদ্রার ফাঁদ পাতা রয়েছে নেটের ভুবনে। সুতরাং সাবধান।

Advertisement

বিটকয়েন কী?

একটু খটমট, কিন্তু ব্যাপারটা মোটামুটি এ রকম—

•• বিটকয়েন হল অনলাইন লেনদেনে ব্যবহারের জন্য এক ধরনের মুদ্রা (ডিজিটাল কারেন্সি)। তা দিয়ে কেনাকাটা করা কিংবা টাকা মেটানো যাবে শুধু নেটেই।

•• ১ টাকা মানে যেমন ১০০ পয়সা, তেমনই ১ বিটকয়েন মানে ১,০০০ মিলি-বিটকয়েন। আর ১ মিলি-বিটকয়েন= ১,০০,০০০ শাতোশি।

•• এই মুদ্রার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ, এতে লেনদেনকারীর পরিচয় গোপন থাকে। তার বদলে ব্যবহার হয় সঙ্কেতলিপি। অর্থাৎ, অন্য ডিজিটাল লেনদেনে যেমন বলা যায় যে, তা কার কাছ থেকে কার কাছে গিয়েছে, বিটকয়েনের ক্ষেত্রে তা বলা যায় না। শুধু জানা যায় এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্যটিতে তার লেনদেন হয়েছে। তবে যদি এক্সচেঞ্জে এর লেনদেন (ট্রেডিং) করতে চান অথবা বিটকয়েন ভাঙিয়ে টাকা হাতে নিতে চান, তা হলে পরিচয় গোপন রাখা শক্ত।

•• ব্যবহার করা যায় মোবাইল, ট্যাবলেট, কম্পিউটার মারফত। ইন্টারনেট থাকলেই হল।

•• বিশ্বের বেশ কিছু নামী সংস্থা এবং ওয়েবসাইট বিটকয়েনের মাধ্যমে টাকা নেয়। দু’জনের হাতে এই মুদ্রা থাকলে, লেনদেন করা যায় নিজেদের মধ্যেও। তবে দু’য়ের সংখ্যাই কম।

কারিগর কে?

শাতোশি নাকামোতো। ২০০৮ সালে তিনিই প্রথম তৈরি করেন এই মুদ্রার সফটওয়্যার। কিন্তু তিনি কি এক জন মানুষ? নাকি একটি গোষ্ঠী? কোন দেশের?— এ সব প্রশ্নের উত্তর গত আট বছর ধরে জানা যায়নি।

অনেকের দাবি, নাকামোতোর জন্ম ১৯৭৫ সালের ৫ এপ্রিল। তিনি জাপানের মানুষ। আবার অনেকে মনে করেন, নাকামোতো কোনও এক জন ব্যক্তি নন। বরং মার্কিন মুলুক এবং ইউরোপের অনেকে মিলে তৈরি করেছেন বিটকয়েন। তাহলেই বুঝুন, এর উৎস কতখানি অচেনা।

কেনা-বেচা কী ভাবে?

•• চাইলে কেনা যায় বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ অথবা কোনও ব্যক্তির কাছ থেকে। বিক্রিও হয় সে ভাবেই।

•• সাধারণত কেনার চেয়ে বিক্রি করা কঠিন। কারণ, যে কোনও এক্সচেঞ্জ থেকে বিটকয়েন কেনা যতটা সহজ, বিক্রি ততটা নয়। এই মুদ্রা বিক্রি করতে হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক্সচেঞ্জে জমা দিতে হয় কেওয়াইসি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য ইত্যাদি। তাতেও হ্যাকিংয়ের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর আলাদা করে কাউকে বিক্রিও কতটা সুরক্ষিত, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

•• বিটকয়েন লেনদেনের জন্য প্রথমেই খুলতে হয় বিটকয়েন ওয়ালেট। যে কেউই তা খুলতে পারেন।

•• এই ওয়ালেটে বিটকয়েন জমা থাকে। যা রাখা যায় অনলাইনে। কম্পিউটারে এবং নেট মাধ্যমে তৈরি ‘ভল্ট’ বা লকারে।

•• লেনদেন করতে চাইলে ওই জমা বিটকয়েনই পাঠাতে হয়। কিন্তু এক বার বিটকয়েন চুরি গেলে, কোনও পুলিশের ক্ষমতা নেই খুঁজে আনার।

•• পাসবই দেখে বা নেট ব্যাঙ্কিং করে বলা যায় যে আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কত টাকা রয়েছে কিংবা তা থেকে কী লেনদেন করেছি। বিটকয়েনের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। বরং তার বদলে থাকে কত কয়েন ছিল আর কত আছে।

ধরুন ‘ক’ ‘খ’-কে ১ বিটকয়েন পাঠাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে লেনদেন শেষ হলে ‘ক’ ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে দেখাবে ১ বিটকয়েন কমেছে। আর ‘খ’-এর তা বেড়েছে। তা দেখেই বোঝা যাবে হাতবদল হয়েছে বিটকয়েন। তবে অ্যাকাউন্ট জানা গেলেও, এ ক্ষেত্রে লেনদেনকারীর পরিচয় জানা যায় না।

ঝুঁকি কোথায়?

•• সব দেশের মুদ্রারই নিয়ন্ত্রক রয়েছে (যেমন ভারতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক)। বিটকয়েনের সে রকম কোনও নিয়ন্ত্রক নেই। কোনও দেশের সরকার বা শীর্ষ ব্যাঙ্ক দ্বারাও স্বীকৃত নয় এই মুদ্রা। এখানেই তার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।

কারণ, ব্যাঙ্ক থেকে আপনার টাকা মার গেলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দ্বারস্থ হতে পারেন আপনি। শেয়ার বাজারে গোলমাল দেখার জন্য রয়েছে সেবি। কিন্তু বিটকয়েন কেউ নিয়ন্ত্রণ করে না। এবং তা স্বীকৃত না-হওয়ায়, আপনার টাকা মার গেলে কারও কাছে যাওয়ার নেই। এক বার টাকা গেেল, তা ফেরতের সম্ভাবনা প্রায় নেই।

•• অনেক ক্ষেত্রে ভুয়ো অর্থলগ্নি সংস্থা বিটকয়েনের মতো ডিজিটাল মুদ্রায় বেশি রিটার্নের লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের থেকে টাকা তুলছে বলেও অভিযোগ আসছে। এ ধরনের সংস্থার দাবি, এটা ইনিশিয়াল কয়েন অফারিং (আইসিও)। অর্থাৎ, বাজারে শেয়ার নথিভুক্তির সময়ে যেমন তাতে টাকা ঢালা হয়, তেমনই এই মুদ্রা বাজারে আসার সময়ই কম দামে লগ্নি করা। সেখানেও কিন্তু একই সমস্যা। কারণ, যেখানে মুদ্রাটি স্বীকৃতই নয়, সেখানে আপনার টাকা মার গেলে অভিযোগ জানানোর জন্য কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। উল্টে বেশি টাকা ঢেলে আয়কর দফতরের প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে। ফলে সতর্ক থাকুন।

•• বিটকয়েনের দাম বাড়ছে শুধুমাত্র এর জোগান কম বলে (পরে এ নিয়ে আলোচনা করব)। এর কোনও আর্থিক ভিত্তি নেই। অর্থাৎ, কোনও সংস্থার শেয়ারে টাকা রাখা হলে তার ব্যবসার ধরন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, আর্থিক হিসেব ইত্যাদি দেখা হয়। কিন্তু বিটকয়েনের ক্ষেত্রে সে রকম কিছুই নেই। তাই চাহিদা কমে গেলেই, তার দাম পড়বে। মার খাবেন লগ্নিকারী।

শুরু কবে?

•• প্রথম বিটকয়েন নাম প্রকাশ্যে আসে ২০০৮ সালে শাতোশি নাকামোতো-র লেখা একটি প্রবন্ধে।

•• ২০০৯ সালে চালু হয় বিটকয়েন লেনদেন। তবে শুধু মাত্র বন্ধুদের মধ্যে ব্যবহারের জন্য (পিয়ার টু পিয়ার)।

•• ২০১০ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে চালু বিটকয়েনের দাম ঘোষণা। সেই সঙ্গে পিৎজা কিনতে এর ব্যবহার দিয়ে শুরু লেনদেনও।

তৈরি কী ভাবে?

•• বিভিন্ন দেশের সরকার বা শীর্ষ ব্যাঙ্ক নোট বা কয়েন ছাপায়। কিন্তু নেটে ব্যবহার করা হয় বলে বিটকয়েন ছাপানোর কোনও প্রশ্ন নেই। তবে এই মুদ্রা ‘মাইনিং’ করা হয়।

•• নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত ১০ মিনিট) বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কম্পিউটার থেকে হওয়া বিটকয়েনের লেনদেন নিয়ে তৈরি হয় এক-একটি ব্লক। আর এই ব্লকগুলির হিসেব যে ‘নেট-খাতায়’ (লেজার) লেখা থাকে, তাকেই বলে ‘ব্লক-চেন’।

লেনদেনের যে কোনও সময়ে ব্লক-চেনই বলে দেবে কোথা থেকে বিটকয়েন কোন অ্যাকাউন্টে গিয়েছে। তা বদলানো হলেও, ধরা পড়বে সঙ্গে সঙ্গে। এ ভাবে লেনদেনের হিসেব রাখার পুরো প্রক্রিয়াকে বলে ‘মাইনিং’। আর যাঁরা এই কাজ করেন, তাঁদের বলে ‘মাইনার’।

এই সব মাইনার ২,১০,০০০ ব্লকের সমাধান খুঁজে পেলে তাঁদের বিটকয়েন ‘রিওয়ার্ড’ বা উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। এ ভাবেই বিটকয়েন বাজারে আসে।

মাত্র ২.১ কোটি!

হ্যাঁ। সারা পৃথিবীতে ২.১ কোটিই বিটকয়েন তৈরি করা সম্ভব। কারণ—

মাইনারদের রিওয়ার্ড দেওয়া শুরু হয়েছিল ৫০ বিটকয়েন দিয়ে। প্রতি ২.১০ লক্ষ ব্লকে তা অর্ধেক হয়। অর্থাৎ, ৫০ এর পরে ২৫, তার পরে ১২.৫, ৬.২৫ ইত্যাদি। হিসেব অনুসারে, প্রতি বার রিওয়ার্ড অর্ধেক হতে চার বছর লাগে। এখন তা ১২.৫। এ ভাবে চলতে থাকলে ২১৪০ সালে গিয়ে ২.১ কোটি বিটকয়েন তৈরি করা যাবে, যখন ওই রিওয়ার্ড হবে প্রায় শূন্য। অর্থাৎ, নতুন বিটকয়েন আসবে না।

তবে হ্যাঁ, অঙ্ক অবশ্য বলে যে, এই নিয়ম মানলে তার থেকে বেশি বিটকয়েন তৈরি সম্ভব। কারণ, তখন দশমিকে বা শাতোশি-তে হিসেব হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে একটি বিটকয়েন তৈরিতে কয়েকশো বছর লাগতে পারে। তাই সেই কাজ মাইনারদের পক্ষে কতটা লাভজনক, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ফলে ২.১ কোটিকেই চূড়ান্ত সংখ্যা হিসেবে ধরা হয়।

অনেকের অবশ্য মত, এই সংখ্যা কাকতালীয়। এর সঙ্গে হিসেবের সম্পর্ক নেই। কিন্তু এর ভিত্তিতে যার দাম ঠিক হয়, তার পাশা যে কোনও সময় উল্টাতে পারে না কি?

বিতর্কের সূত্রপাত

এ জন্য কিছু খবরে চোখ রাখা যাক—

•• প্রথম দিকে বিটকয়েন নিয়ে সে ভাবে কেউ মাথা না-ঘামালেও, প্রথম তার চোখে পড়ার মতো উত্থান ঘটে ২০১৩ সালে। ওই বছরেই বিটকয়েনের দাম ছাড়ায় ১,০০০ ডলার। আর তার পরেই এই মুদ্রা নিয়ে সতর্কতা জারি হয় বিভিন্ন দেশে। ভারতেও প্রথম বার সাধারণ মানুষকে সতর্ক করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।

•• ২০১৩ সালে আমেরিকায় বাজেয়াপ্ত করা হয় বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ এমটি-গক্সের অ্যাকাউন্ট। এর মাধ্যমে বেআইনি লেনদেন হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে বিটকয়েন ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও সামনে আসে।

•• পরের বছরের শুরুতেই খবরের শিরোনামে উঠে আসে বিটকয়েন। প্রায় ৮.৫০ লক্ষ বিটকয়েন চুরি যাওয়ায় ফেব্রুয়ারিতে টোকিওয় বন্ধ হয়ে যায় মুদ্রাটির অন্যতম বড় এক্সচেঞ্জ এমটি-গক্স। শেষমেশ দেউলিয়া ঘোষণা। বিটকয়েনের দাম নামে ৩০০ ডলারে।

•• গত বছরের শেষ থেকেই ফের দাম বাড়তে থাকে বিটকয়েনের। দু’বছর পরে ফের পৌঁছোয় ১,০০০ ডলারে।

•• চলতি বছরের বেশ কয়েক বার হ্যাকিংয়ের জেরে খবরে আসে বিটকয়েন। যেমন, ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে কম্পিউটারে হানা দেওয়া হয়। সেখানে কম্পিউটার বন্ধ করে, বিটকয়েনের মাধ্যমে টাকা দাবি করে হ্যাকাররা। একই ভাবে একটি টিভি চ্যানেলের ওয়েবসাইট হ্যাক করে বেশ কিছু স্ক্রিপ্টের গোপন তথ্যও চুরি করা হয়। সে ক্ষেত্রেও বিটকয়েন মারফত টাকা দাবি করা হয়েছিল।

অর্থাৎ, বেআইনি কাজের সঙ্গে বারবার নাম জড়িয়েছে বিটকয়েনের।

শুধুই কি বিটকয়েন?

বিটকয়েন ছাড়াও বাজারে চালু রয়েছে অসংখ্য ডিজিটাল কারেন্সি। যার মধ্যে রয়েছে— লাইটকয়েন, ইথেরিয়াম, রিপ্‌ল, জিক্যাশ, ড্যাশ প্রভৃতি। এক সময়ে এই ধরনের ডিজিটাল মুদ্রার সংখ্যা পৌঁছে গিয়েছিল ৩০০-র দোরগোড়ায়। পৃথিবীতে টাকা, ডলার, পাউন্ডের মতো ১৮০টি মুদ্রা চালু রয়েছে। সেখানে ডিজিটাল মুদ্রা ২৯০টি। সতর্কবার্তা কিন্তু জারি হয়েছে এই সমস্ত মুদ্রা নিয়েই।

সুতরাং...

বিটকয়েনের দশ বছরও পেরোয়নি! আর যতটুকু দেখা গিয়েছে, তাতে অনিশ্চয়তাই বেশি। তাই শুধুমাত্র লোভে পড়ে কষ্টের সঞ্চয় এখানে ঢালবেন কেন? বরং ধৈর্য ধরুন। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার নেশায় সব খোয়ানোর ঝুঁকি নেবেন কেন?

ধনকুবেরের গল্প

ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া তৈরির চিন্তা প্রথম তাঁদের মাথাতেই এসেছিল বলে মার্ক জুকেরবার্গের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছিলেন উইন্‌কলভস ভাইয়েরা। সেই মামলায় ৬.৫ কোটি ডলার (প্রায় ৪,২২৫ কোটি টাকা) ক্ষতিপূরণ পেয়ে আপসে মেটান ক্যামেরন এবং টাইলার উইন্কলভস। মামলা থেকে পাওয়া অর্থের মধ্যে ১.১ কোটি ডলার ঢেলেছিলেন বিটকয়েনে। তাঁরাই বিশ্বের প্রথম বিটকয়েন ধনকুবের। এই ডিজিটাল মুদ্রায় যাঁদের লগ্নির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ১০০ কোটি ডলার। তবে বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড খুলতে তাঁদের আর্জি অবশ্য খারিজ হয়েছে মার্কিন মুলুকে। আর হ্যাঁ, উইন্কলভস ভাইদের মতো ট্যাঁকের জোর আমার-আপনার আছে কি?

সাবধান

•• ভারতে লগ্নিকারীদের বিটকয়েন নিয়ে বারবারই সতর্ক থাকতে বলেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সেবি। দেশের বিভিন্ন বিটকয়েন এক্সচেঞ্জে তল্লাশি চালিয়েছে আয়কর দফতর। এমনকী ৪ থেকে ৫ লক্ষ উচ্চবিত্ত বিটকয়েন লেনদেনকারীকে আয়কর নোটিস পাঠানো হবে বলেও জানিয়েছে তারা।

•• শুধু ভারত নয়, বিভিন্ন দেশেই বিটকয়েন নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। কোনও দেশ বা শীর্ষ ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ না-থাকায় সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। অস্ত্র, মাদকের মতো বিভিন্ন বেআইনি লেনদেনে বিটকয়েনের ব্যবহার নিয়েও সতর্ক করেছে নিয়ন্ত্রকরা।

•• চিনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে বিটকয়েনের উপর। দক্ষিণ কোরিয়া জানিয়ে দিয়েছে, সে দেশের কোনও ব্যাঙ্ক বিটকয়েনের মতো ডিজিটাল মুদ্রা লেনদেন করতে পারবে না। ওই দেশে বিটকয়েন এখন দেউলিয়া!

•• জাপানে এক সংস্থা কর্মীদের বিটকয়েন মারফত বেতনের একাংশ দেওয়ার কথা জানিয়েছে। সম্প্রতি শিকাগোর আগাম পণ্য বাজারে চালু হয়েছে এর লেনদেন। কিন্তু মনে রাখবেন, কারা নিয়ন্ত্রক, সমস্যা হলে কার কাছে দৌড়তে হবে, বিটকয়েনে কিছুই স্পষ্ট নয়। তাই অনেকেই বলেন, রাতারাতি এই বাজার ধসে গেলেও তাঁরা তেমন আশ্চর্য হবেন না।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ

(মতামত ব্যক্তিগত)

পাঠকের প্রশ্ন ?

প্রঃ এসআইপি জিনিসটা ঠিক কি এবং এই অ্যাকাউন্ট কোথায়, কী ভাবে খুলতে হয়? এই ফান্ড কত রকমের হয় এই বিষয়ে জানালে উপকৃত হব।

সাকিব হুসেন

কোনও মিউচুয়াল ফান্ডে নিয়মিত (সাধারণত মাসে-মাসে) টাকা ঢেলে লগ্নি করার পদ্ধতিই হল এসআইপি। ভাল ফান্ড বাছাইয়ের পরে লম্বা সময় ধরে সেখানে অল্প-অল্প করে টাকা ঢেলে যেতে পারলে প্রায় অজান্তেই তৈরি হয় মোটা অঙ্কের তহবিল। সাধারণত লম্বা মেয়াদে নির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্য পূরণের জন্য টাকা জোগাড় করতে এসআইপি-র পথে হাঁটেন অনেকে। যেমন, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, অবসর জীবনের আয়ের বন্দোবস্ত ইত্যাদি। এর টাকা খাটানো যায় মূলত তিন ধরনের ফান্ডে।

ইকুইটি ফান্ডের ক্ষেত্রে তহবিল লগ্নি করা হয় শেয়ারে। শেয়ারের দরে প্রতিনিয়ত যে ওঠা-পড়া চলে, তাতেই ফুলে-ফেঁপে ওঠে ফান্ডের বিনিয়োগ। তাই এতে রিটার্ন চড়া হওয়ার সম্ভাবনা। তবে ঝুঁকিও বেশি।

ডেট ফান্ডের টাকা প্রায় পুরোটাই খাটে সরকারি ও বেসরকারি ঋণপত্রে। ডেট ফান্ডের লগ্নিতে ঝুঁকি ইকুইটি ফান্ডের তুলনায় অনেক কম। তবে একেবারে নেই বলা যাবে না। রিটার্ন ভাল হতে পারে, যদি ভাল ঋণপত্রে লগ্নি করে ফান্ড। তবে তা ইকুইটি ফান্ডের মতো তাক লাগানো হয় না।

আর মিশ্র ফান্ডের তহবিল শেয়ার ও ঋণপত্র মিলিয়ে লগ্নি করা হয়।

এসআইপির সুবিধা হল, নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী কিস্তির টাকা ঠিক করা যায়। মেয়াদ বাড়ানো যায় প্রয়োজন মতো। অসুবিধায় পড়লে এসআইপি মাঝপথে বন্ধও করে দেওয়া যায়।

এসআইপিতে লগ্নি করার জন্য—

•• ঠিক করুন কোন লক্ষ্য পূরণের জন্য কত টাকা জমাতে চান। সেই অনুযায়ী ভাল ফান্ড সংস্থার কাছে গিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদ ও ঝুঁকির ভিত্তিতে ফান্ড বাছুন।

•• আবেদনপত্র ভর্তি করুন।

•• কেওয়াইসি করুন।

•• নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিতে হবে। সেই কিস্তির অঙ্ক ঠিক করুন। ইসিএস মারফত টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখুন। এতে মাসের নির্দিষ্ট তারিখে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কেটে নেবে ফান্ড।

•• আবেদনপত্রের সঙ্গে অন্যান্য নথি ও তথ্য-প্রমাণ, ছবি ইত্যাদি দিন।

পরামর্শদাতা: নীলাঞ্জন দে

পরামর্শের জন্য লিখুন:

‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ,

আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১।

ই-মেল: bishoy@abp.in

ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement