এই প্রথম ‘সেপ্টেম্বর ইভেন্টে’ ঘোষণা হবে না নতুন আইফোনের আত্মপ্রকাশের। ফাইল ছবি।
আইফোন-প্রেমীরা সারা বছর অপেক্ষা করেন অ্যাপলের ‘সেপ্টেম্বর ইভেন্ট’-এর জন্য। সেপ্টেম্বরের কোনও এক দিন অ্যাপল ঘোষণা করে তাদের নতুন কোন প্রডাক্ট বাজারে আসবে। নতুন সেই প্রডাক্টের বিশেষত্ব, ফিচার, দাম— সবই জানানো হয় সেই ইভেন্টে।
এ বছর তা হচ্ছে ১৫সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার। অডিটোয়ামের বদলে ভার্চুয়ালি হবে সেই অনুষ্ঠান। অতিমারির আবহে জমায়েত এড়াতে অনেক অনুষ্ঠানই ভার্চুয়ালি হচ্ছে। কিন্তু অ্যাপলের ‘সেপ্টেম্বর ইভেন্ট’ আলোচনায় অন্য কারণে। এই প্রথম ‘সেপ্টেম্বর ইভেন্টে’ ঘোষণা হবে না নতুন আইফোনের আত্মপ্রকাশের। যা অ্যাপলের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
করোনাভাইরাস অতিমারির জেরে সারা বিশ্বেই ছন্দ হারিয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা। কমবেশি সব দেশেই পরিবহণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ সচল নয়। দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ কল কারখানা। ফলে ঘাটতি পড়েছে উৎপাদনে। করোনার ধাক্কা থেকে ছাড় পায়নি অ্যাপলও। যার জেরে তাদের সরবরাহ-চেনে ভাঙন ধরেছে। সেই কারণেই ২০২০ সালের ‘সেপ্টেম্বর ইভেন্টে’ বহুপ্রতীক্ষিত ফাইভ-জি আইফোন আত্মপ্রকাশ করবে না।
তবে নতুন আইফোন (আইফোন-১২) না এলেও অ্যাপলের একগুচ্ছ নতুন গ্যাজেট প্রকাশ্যে আসবে ১৫ সেপ্টেম্বর। ভারতীয় সময় রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ শুরু অ্যাপলের ‘টাইম ফ্লাইজ’ অনুষ্ঠান। অ্যাপলের ওয়েবসাইট, তাদের অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেল এবং অ্যাপল টিভি অ্যাপে তা দেখতে পারবেন বিশ্ববাসী।
তবে কলকাতার বাজারে ওই পণ্যগুলি আসতে আসতে অন্তত অক্টোবর। তেমনই জানাচ্ছেন শহরের বিভিন্ন অ্যাপল ফ্র্যাঞ্চাইজিতে কর্মরত লোকজন। নতুন পণ্যের দাম নিযেও এখনই মুখ খুলতে নারাজ তাঁরা। তাঁদের কথায়, আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হলেও দামও জানা যাবে। তার আগে নয়।
প্রতিবারের মতো এ বারের অ্যাপলের সেপ্টেম্বর ইভেন্টে দেখা যাবে না উপচে পড়া প্রেক্ষাগৃহ। ফাইল চিত্র।
ওই অনুষ্ঠানে নতুন আইপ্যাড, অ্যাপল ওয়াচ, অ্যাপল টিভি এবং আইওএস ১৪-র মতো অ্যাপল পণ্যের বিষয়ে ঘোষণা হবে। গ্যাজেট সংক্রান্ত বিভিন্ন ওয়েবসাইটের খবর, ঘোষণা হতে পারে ‘আইপ্যাড এয়ার ৪’। আইপ্যাডের এই ভার্সনে যোগ হতে পারে ‘টাচ আইডি’। চিরাচরিত ‘হোম বাটন’ থাকবে না এই মডেলে। ১০.৮ ইঞ্চির স্ক্রিনে থাকবে ‘এজ টু এজ ডিসপ্লে’। অ্যাপল ওয়াচ সিরিজ ৬-এর ঘোষণাও হতে পারে মঙ্গলবার। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কথা মাথায় রেখে অতিরিক্ত বেশ কিছু ফিচার যোগ হতে পারে অ্যাপল ওয়াচের এই ভার্সনে। ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম এবং রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা নির্ণায়ক ফিচার যোগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। পাশাপাশিই, তুলনায় কম দামের অ্যাপল ওয়াচ এবং ‘এয়ারপড স্টুডিয়ো’ নামের বিশেষ হেডফোনের ঘোষণার কথাও শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন মহলে।
হারানো প্রডাক্টের উপর নজর রাখার জন্য ‘এয়ারট্যাগ’ আনার কথাও ঘোষণা হতে পারে। সঙ্গে অ্যাপলের নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেমের আপগ্রেড ভার্সন ‘আইওএস ১৪’ বাজারে আনার কথাও প্রকাশ্যে আসার কথা।
মূলত আইফোনের মাধ্যমেই বিশ্বজয় করেছিল অ্যাপল। ২০০৭ সালে প্রথম বাজারে আসে আইফোন। তার পর থেকে অ্যাপলের আয়ের সিংহভাগই এসেছে আইফোন বিক্রি করে। এ ভাবে চলতে চলতেই একে একে অন্যান্য প্রডাক্ট বাজারে আনতে শুরু করে স্টিভ জোবসের সংস্থা। সেগুলিরও চাহিদা বাড়তে থাকে। পক্ষান্তরে, বিগত কয়েক বছরে বিশ্ব জুড়ে আইফোনের চাহিদা আগের তুলনায় খানিকটা কমেছে। যা আরও কমেছে অতিমারির কারণে। তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে আইফোন থেকে অ্যাপলের আয় কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ।
চলতি অর্থবর্ষের শেষ চার মাসে আইফোনের বিক্রি ৬৩ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৪ শতাংশে। কিন্তু আইফোন বিক্রিতে ভাটা পড়ার সময়কালেই অ্যাপল ওয়াচ, আইপ্যাড-সহ অ্যাপলের বিভিন্ন পণ্য থেকে রোজগার বেড়েছে। অ্যাপল ওয়াচ ও এয়ারপডের বিক্রি বেড়েছে ১৪৪ শতাংশ। যা থেকে অ্যাপলের রোজগার হয়েছে ৬৪৫ কোটি ডলার (প্রায় ৪৭ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা)। আইপ্যাডের বিক্রিও বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। পাশাপাশি, বিভিন্ন অ্যাপ সার্ভিস ১৬২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা থেকে অ্যাপলের আয় হয়েছে ১,৩২০ কোটি ডলার (প্রায় ৯৬ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা)। এই পরিসংখ্যান থেকেই প্রশ্ন উঠছে— করোনার কারণে যখন নতুন আইফোন বাজারে আনতে দেরি হচ্ছে, তখন অন্যান্য গ্যাটেজ দিয়ে কি বাজার ধরতে চাইছে অ্যাপল?
সেই প্রশ্ন উস্কে দিচ্ছে প্রতিপক্ষ সংস্থার প্রডাক্টের সঙ্গে অ্যাপল প্রডাক্ট বিক্রির তুলনাও। এক মার্কিন সংস্থার সমীক্ষা জানাচ্ছে, প্রতি ১০০টি আইফোনের সঙ্গে ৪৯ জোড়া এয়ারপড এবং ১৪টি অ্যাপল ওয়াচ বিক্রি হয়। স্যামসাং গ্যালাক্সি-এস সিরিজের ১০০টি ফোনের বিক্রিতে ৩৪ জোড়া গ্যালাক্সি বাড এবং ১৪টি কমপ্যানিয়ন ওয়াচ বিক্রি হয়। স্যামসাংয়ের গ্যালাক্সি বাডের দাম ৮৫ ডলার। সেটির প্লাস ভার্সনের দাম ১৪০ ডলার। সেখানে অ্যাপলের এয়ারপডের দাম ১৩৪ ডলার। তার প্রো ভার্সনের দাম ২২৯ ডলার। অর্থাৎ, স্মার্টফোন ছাড়া অন্যান্য এক্সেসরিজ বিক্রিতে রোজগারের হিসাবে অ্যাপলের ধারেকাছে কেউ নেই। সে জন্যই কি ওইসব পণ্যকে আরও বেশি করে গ্রাহকদের সামনে তুলে ধরতে চাইছে অ্যাপল?
আইফোন বিক্রিতে ভাটা পড়ার সময়কালেই অ্যাপল ওয়াচ, আইপ্যাড-সহ অ্যাপলের বিভিন্ন পণ্য থেকে রোজগার বেড়েছে। ফাইল চিত্র।
বিশ্ব বাজারে আইফোনের চাহিদা কম হতেই ভারতের বাজারকে (যেখানে আইফোন এখনও সে ভাবে রাজত্ব করতে পারেনি) পাখির চোখ করেছে অ্যাপল। ভারতের বাজারে এখনও নিজস্ব স্টোর খুলতে পারেনি অ্যাপল। এখানে সমস্ত স্টোরই ‘থার্ড পার্টি স্টোর’। বিদেশি দ্রব্যের খুচরো বিক্রিতে বলবত্ ‘৩০ শতাংশ’ নিয়মই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অ্যাপলের সামনে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন অ্যাপলের সিইও টিম কুক। তিনি ভারতে অ্যাপলের এক লক্ষ নিজস্ব স্টোর তৈরির ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এর জেরে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ ভারতীয়ের কর্মসংস্থানের বিষয়টিও জানান। এবং সে কারণে ৩০ শতাংশ নিয়মের শিথিলতা নিয়ে ভারত সরকারকে ভাবতে বলেন।
অ্যাপল ছাড়াও ‘আকিয়া’-র মতো বেশ কয়েকটি সংস্থাও ওই নিয়ম শিথিল করার জন্য দরবার করেন মোদীর কাছে। এর পর ২০১৯ সালে অগস্টে কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী পীযূষ গয়াল ঘোষণা করেন, ৩০ শতাংশের শর্ত পূরণ না করেই বিদেশি ব্র্যান্ড রিটেলাররা নিজেদের অনলাইন বা ফিজিক্যাল স্টোর খুলতে পারবে ভারতের বাজারে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)-কে ভারতের বাজারে উৎসাহিত করতেই এই পদক্ষেপ বলে জানিয়েছিলেন তিনি। মোদী সরকারের সেই পদক্ষেপকে বিবৃতি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল অ্যাপল। অতঃপর গত ফেব্রুয়ারিতে কুক ঘোষণা করেন, ২০২১ সালেই ভারতে খোলা হবে অ্যাপলের নিজস্ব রিটেল স্টোর। এ সবের লক্ষ্য একটাই— ভারতের বাজারে আইফোন-সহ অন্যান্য অ্যাপল গ্যাজেটের বিক্রি বাড়ানো।
আরও পড়ুন: স্থায়ী আমানতে ফের সুদ কমাল স্টেট ব্যাঙ্ক
করোনাভাইরাস লকডাউনে বাড়িতে বসেই কাজ করতে হচ্ছে অধিকাংশ সংস্থার কর্মীর। যার জেরে ট্যাবলেট ও স্মার্টফোনের চাহিদা বেড়েছে। যদিও ভারতে ট্যাবলেট ও প্রিমিয়ার স্মার্টফোন (২৫ হাজার টাকার বেশি দাম) বিক্রিতে কিছুটা হলেও পিছিয়ে অ্যাপল। ভারতের বাজারে প্রিমিয়াম স্মার্টফোন বিক্রির ৩৭ শতাংশই স্যামসাংয়ের দখলে। আইফোনের বিক্রি ২৬ শতাংশেই আটকে। ওয়ান প্লাসের দখলে ১৫ শতাংশ। যদিও আইফোন-১১ ভারতের বাজারে ভালই সাড়া ফেলেছিল। ট্যাবলেট বিক্রিতে ভারতের বাজারে এগিয়ে লেনোভো। বাজারের ৪৮ শতাংশই তাদের দখলে। ট্যাবলেটের বাজার ২৪ শতাংশ দখল করে দ্বিতীয় স্থানে স্যামসাং। সেখানে ভারতে ট্যাবলেটে বিক্রির মাত্র ১২ শতাংশ অ্যাপলের। ভারতে নিজেদের স্টোর খুলে এই শূন্যস্থানই ভরাট করতে চাইছে অ্যাপল। যদিও আইফোন, আইপ্যাডের দাম এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। সেই বাধা দূর করার পথে বেশ কয়েক কদম এগিয়েছে অ্যাপল। ভারতে ইতিমধ্যেই তাঁদের কিছু কিছু পণ্যের উৎপাদন শুরুও হয়েছে বলে জানিয়েছেন অ্যাপলের কলকাতার ফ্রাঞ্চাইজিতে কর্মরত এক কর্মী। তাঁর মতে, ভারতে উৎপাদন বাড়লে অ্যাপলের প্রোডাক্টের দাম কিছুটা হলেও কমবে। যার জেরে মধ্যবিত্তের আরও নাগালের মধ্যে আসবে আইফোন এবং আইপ্যাড।
আইফোন-১১ ঘোষণার পর ভারতে আইফোনের বিক্রিতে নতুন রেকর্ড হয়েছিল। আইফোন-১২ ঘোষণা না হওয়ায় কলকাতার বাজারে তার কেমন প্রভাব পড়বে? কলকাতার অ্যাপল সংস্থার কর্মী সুশান্ত দাসের আশা, ‘‘আইফোন-১২ নিয়ে ঘোষণা এখন না হলেও খুব উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে না।’’ তাঁর যুক্তি, ‘‘কোভিডের কারণে আইফোনের সরবরাহ বেশ খানিকটা মার খেয়েছে। আবার অধিকাংশ লোক বাড়িতে থেকে কাজ করছেন। ফলে আইপ্যাড, ম্যাকবুকের চাহিদা তুলনায় অনেক গুণ বেড়েছে।’’ কলকাতা তথা ভারতের বাজারে ম্যাকবুক, আইপ্যাডের চাহিদার তুলনায় যোগানে ঘাটতি রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। তবে বিগত কয়েক বছরে আইফোনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অ্যাপলের অন্যান্য গ্যাজেটের চাহিদাও বেড়়েছে বলেই তিনি জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: পর্যটন চালু করবে সিকিম, শর্ত ঘিরে উদ্বেগ রাজ্যে
১৫ সেপ্টেম্বর ঘোষণা হলেও অ্যাপলের নতুন গ্যাজেট বাজারে আসতে প্রতি বছরই অক্টোবর হয়ে যায়। ফলে প্রতি বছরের মতো এ বছরও এই সময়ে বিক্রি কিছুটা থমকে থাকবে বলেই অভিমত সুশান্তের। তাঁর কথায়, ‘‘প্রতি বছরই এই সময় অ্যাপলপ্রেমীরা একটু দেখে নেন নতুন কী আসতে চলেছে। সে জন্যই আইফোন লঞ্চ না হওয়া পর্যন্ত হয়তো স্মার্টফোনের বিক্রি একটু কমই থাকবে।’’ তবে সরবরাহ স্বাভাবিক হলেই আইফোন-১২’র অভাব অ্যাপল ওয়াচ, আইপ্যাড এবং ম্যাকবুক মিটিয়ে দেবে বলেই আশা তাঁর। অ্যাপলের নতুন ভার্সনের প্রোডাক্টগুলিতে দামের খুব একটা হেরফের হবে না বলেই মনে করেন সুশান্ত। বিগত বছরগুলিতে অ্যাপলের নতুন ভার্সনের দাম আগের ভার্সনের প্রায় আশেপাশেই থেকেছে। মঙ্গলবার আত্মপ্রকাশমুখী নতুন গ্যাজেটের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হবে না বলেই তাঁর অভিমত।
আইফোন-১২’র ঘোষণা পিছিয়ে যাওয়া স্মার্টফোনের বিক্রিতে কিছুটা প্রভাব ফেললেও অন্যান্য গ্যাজেট সেই শূন্যস্থান ভরিয়ে দিতে পারবে বলেই মত অ্যাপল-ওয়াকিবহালদের।