২১ অগস্টের রক্তের দাগ এখনও অমলিন

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙ্গালি আর অসাম্প্রদায়িকতা— এই চারটি শব্দকে হত্যা করার জন্যই বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার দিকে গ্রেনেড ছুড়েছিল ঘাতকেরা। ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতাই ছিল ২১ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা। শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলও সে দিনের হামলায় নিহত হন ২৪ জন।

Advertisement

অঞ্জন রায়

ঢাকা শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৬ ১৭:১৫
Share:

হামলার পর।

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙ্গালি আর অসাম্প্রদায়িকতা— এই চারটি শব্দকে হত্যা করার জন্যই বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার দিকে গ্রেনেড ছুড়েছিল ঘাতকেরা। ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতাই ছিল ২১ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা। শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলও সে দিনের হামলায় নিহত হন ২৪ জন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হত্যা, তথ্যপ্রমাণ নষ্ট, হত্যাকারীদের আড়াল করতে এর পর সাজানো হয় জজ মিয়া নাটক। এই প্রতিটি আয়োজনই ছিল বাংলাদেশে সন্ত্রাসের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। একুশে অগষ্ট বাঙালিকে আবার মনে করিয়ে দেয়— পাকিস্তান শুধু একটা রাষ্ট্র, পাকিস্তান একটি দর্শন।

Advertisement

ভয়াল সেই দিনের কথা

Advertisement

২০০৪ সাল, ২১ আগস্ট। দিনটি ছিল শনিবার। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামি লিগের সমাবেশ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সেই সময়ের বিরোধী দলনেত্রী শেখ হাসিনা। সমাবেশে হাজার হাজার মানুষের স্রোত। প্রায় ৫০ হাজার মানুষের সমাগমে রীতিমতো মহাসমাবেশের পরিণত বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের চারপাশ।

বিকাল ৫টা ২২ মিনিট। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তৃতা শেষ করে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে এগোতে থাকলেন ট্রাক থেকে নামার সিঁড়ির কাছে। মুহূর্তেই শুরু হল নারকীয় গ্রেনেড হামলা। বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হতে লাগল একের পর এক গ্রেনেড। আর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হল মৃত্যুপুরীতে। শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে খই ফোটার মতো একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় ঘাতকরা।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই ১২-১৩টি গ্রেনেড হামলার বীভৎসতায় মুহূর্তেই রক্তমাংসের স্তূপে পরিণত হয় সমাবেশস্থল। রক্তগঙ্গা বয়ে যায় এলাকা জুড়ে। ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল শেখ হাসিনা। পরিস্থিতির তাৎপর্য বুঝতে ট্রাকে অবস্থানরত নেতৃবৃন্দ ও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মানবঢাল রচনা করে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধু কন্যাকে। নেতা ও দেহরক্ষীদের আত্মত্যাগে মৃত্যুজাল ছিন্ন করে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আজ সেই রক্তস্নাত ভয়াল-বিভীষিকাময় ২১ আগস্ট দ্বাদশ বার্ষিকী। বারুদ আর রক্তমাখা বীভৎস রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের দিন। মৃত্যু-ধ্বংস-রক্তস্রোতের নারকীয় গ্রেনেড হামলার দিন। ২০০৪ সালের এই দিনে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামি লিগের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশে চালানো হয় নৃশংস গ্রেনেড হামলা। এ ঘটনায় প্রাণ হারান বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও মহিলা আওয়ামি লিগের প্রধান আইভি রহমান-সহ ২৪ জন। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামি লিগের শীর্ষ নেতা-সহ গুরুতর আহত হন প্রায় ৩০০ জন।

২০০৪ সালের সেই বিকেলে আরেকটি রক্তাক্ত ১৫ অগস্ট ঘটাতে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে উপর্যুপরি ১৩টি গ্রেনেড ছুড়েই ক্ষান্ত হয়নি ঘাতকরা, গ্রেনেডের আঘাতে পরাস্ত করতে না পেরে সে দিন শেখ হাসিনার গাড়িতে ঘাতকরা বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়েছিল। একেবারে পরিকল্পিত ও টার্গেট করা ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গুলি ভেদ করতে পারেনি শেখ হাসিনার বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাচ। শেখ হাসিনাকে আড়াল করে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে জীবন বিলিয়ে দেন তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স কর্পোরাল (অব) মাহবুবুর রশিদ।

ঘাতকদের পরিকল্পিত বহুমুখী হামলায় এই দিনে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ আওয়ামি লিগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় চত্বর মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। সে দিন যদি ঘাতকদের ছোড়া গ্রেনেড সমাবেশের জন্য ব্যবহৃত ট্রাকে বিস্ফোরিত হত তবে শেখ হাসিনা-সহ আওয়ামি লিগের কোন শীর্ষ নেতাই প্রাণে রক্ষা পেতেন না। আর এটাই ছিল ঘাতকদের মূল পরিকল্পনা।

শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে ফিরে এলেও সে দিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় গোটা এলাকা। এই ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার পর সে দিন স্‌প্লিন্টারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন শত শত মানুষ। হামলায় মানব দেহের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। কারও হাত নেই, কারও পা উড়ে গেছে। রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায় পিচঢালা কালো পথ। অস্থায়ী সভামঞ্চ ট্রাকের চারপাশে রক্তের অনাহূত আলপনা, শত শত মানুষের আর্ত চিৎকার। বেঁচে থাকার জন্য, প্রাণ বাঁচানোর জন্য মুমূর্ষুদের আকুতি, কাতর চিৎকার— অবর্ণনীয় মর্মান্তিক সেই দৃশ্য।

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হত্যাচেষ্টার তথ্যপ্রমাণ ধ্বংস

নারকীয় হামলা প্রতিহতে সেই সময়ে কোনই ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোটের পুলিশ বাহিনী। শত শত রক্তাক্ত-ছিন্নভিন্ন হওয়া মানুষগুলোকে উদ্ধারের পরিবর্তে পরিকল্পিত ভাবে চতুর্দিক থেকে কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে নির্বিঘ্নে ঘাতকদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করা হয়। এমনকী, তাজা গ্রেনেড উদ্ধার করা হলেও তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করতে সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। হামলাস্থলে থাকা সব প্রমাণ একে একে ধ্বংস করা হয়।

এমনকী, শত শত আহত মানুষ যাতে চিকিৎসা না পায় সে জন্যও রাষ্ট্রীয় নির্দেশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, তৎকালীন পিজি হাসপাতাল-সহ সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকদের উপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। হামলার পর অগণিত আহতকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে নিয়ে আসা হলেও মূল প্রবেশদ্বার বন্ধ করে রাখা হয়। বিএনপি-জামাত জোট সমর্থক চিকিৎসকরা চিকিৎসা করতে গড়িমসি করেন। ফলে বেশিরভাগ আহত নেতাকর্মীকে সরকারি হাসপাতালের পরিবর্তে শিকদার মেডিক্যাল কলেজ, মিটফোর্ড হাসপাতাল-সহ নানা ক্লিনিকে ভর্তি করানো হয়। এমনকী, ওই ভয়াল সময়েও নিহতদের লাশের ময়নাতদন্ত নিয়েও নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ঘটেছে।

লাশের পাহাড় আর আহতদের কান্নারোল

২১ অগস্টের সেই রক্তাক্ত হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগস্ট মারা যান আইভি রহমান। আহত হওয়ার পর প্রায় দেড় বছর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান আওয়ামি লিগের জনপ্রিয় নেতা ও প্রথম নির্বাচিত মেয়র মহম্মদ হানিফ। রক্তাক্ত-বীভৎস ওই ভয়াল গ্রেনেড হামলায় নিহত অন্যরা হলেন শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স কর্পোরাল (অব) মাহবুবুর রহমান, মুস্তাক আহমেদ সেন্টু, হাসিনা মমতাজ রিনা, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (সবার প্রিয় আদাচাচা), রতন শিকদার, মহম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, লিটন মুন্সি, আব্দুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাস উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসির উদ্দিন সরদার, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, জাহেদ আলি, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম।

গুলির আঘাতে জখম।

আহত হয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি (তৎকালীন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য) জিল্লুর রহমান, প্রয়াত আবদুর রজ্জাক, ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত মহম্মদ হানিফ, আমির হোসেন আমু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, আইনজীবী সাহারা খাতুন, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, ডা. মহিউদ্দিন খান আলমগীর, কাজী জাফর উল্লাহ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, এস এম কামাল হোসেন, পঙ্কজ দেবনাথ, সঈদ খোকন, নজরুল ইসলাম বাবু, নাসিমা ফেরদৌসি, শাহিদা তারেক দীপ্তি, উম্মে রাজিয়া কাজল, আসমা জেরিন ঝুমু, রাশেদা আখতার রুমা, আবুল হোসেন মোল্লা, মামুন মল্লিক, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন, হামিদা খানম মনি-সহ পাঁচ শতাধিক আওয়ামি লিগের নেতাকর্মী।

স্‌প্লিন্টারে লেখা মৃত্যুর ইতিকথা

বঙ্গবন্ধু হত্যার ঊনত্রিশ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে আবারও ঘাতকদের দল এই অগস্টেই জোট বেঁধেছিল। শোকাবহ-রক্তাক্ত সেই দিনের স্মৃতি উস্কে আরেকটি ১৫ অগস্ট ঘটানোর টার্গেট থেকে ঘাতক হায়েনার দল হামলার পরিকল্পনা করেছিল। স্থান ছিল, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামি লিগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সমাবেশস্থল। টার্গেট ছিল এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা-সহ আওয়ামি লিগকে সম্পূর্ণ নেতৃত্বশূন্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করতেই ঘাতকরা এই দানবীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। আহত হওয়া পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর অনেকেই ঘাতক গ্রেনেডের স্‌প্লিন্টারের দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়েই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর দিকে। হাত-পা-চোখ-সহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে অসংখ্য নেতাকর্মী পঙ্গুত্ববরণ করে জীবনধারণ করছেন। সর্বাঙ্গে বিঁধে থাকা স্‌প্লিন্টারের জীবনযন্ত্রণা ভোগ করেই মারা গেছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক আবদুর রজ্জাক, ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র ও আওয়ামি লিগের কেন্দ্রীয় নেতা মহম্মদ হানিফ-সহ অনেকেই।

পঁচাত্তরের ১৫ অগস্টের আদলে ব্লুপ্রিন্ট

একুশ অগস্টের গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের পেছনে ছিলেন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা, কয়েক জন শীর্ষ জঙ্গি আর পাকিস্তান। পঁচাত্তরের ১৫ অগস্টের মতোই ২১ অগস্টের হামলার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করা হয়েছিল। তৎকালীন সরকারের কয়েক জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আর জঙ্গি নেতাদের নিয়ে হাওয়া ভবনে বসে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সব কিছু চূড়ান্ত করেন। হামলায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের পাকিস্তানে ট্রেনিং দেওয়া হয়। ট্রেনিংয়ের পর তাঁদের আর্জেস গ্রেনেডও সরবরাহ করে পাকিস্তান। আর হামলা শেষে ঘাতকদের আশ্রয়ও দেয় পাকিস্তান। মূলত আওয়ামি লিগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই ২১ অগস্টের গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।

২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট ভয়াল ও বীভৎস গ্রেনেড হামলা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, আদালতে একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্য এবং আসামিদের জবানবন্দীতে এ সব কথা উঠে আসে। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, গুরুত্বপূর্ণ নথি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং আসামিদের জবানবন্দী বিশ্লেষণ করেও দেখা গেছে, দেশের একাধিক রাজনৈতিক দল, জঙ্গি সংগঠন ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে এবং পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার মদতে ২১ অগস্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা-সহ পুরো আওয়ামি লিগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই এই হামলা চালানো হয়েছিল।

অগস্ট যেন বাঙালির কাঁদার মাস

স্বাধীন বাংলাদেশের ট্র্যাজেডির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অগস্ট যেন বাঙালি জাতির জীবনে বিয়োগান্তক মাস। হত্যা, অপমৃত্যু, স্বজন হারানোর মাস। জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার মাস। একাত্তরের পরাজিত শত্রু ও তাদের দোসররা বার বার বেছে নিয়েছে অভিশপ্ত অগস্টকে। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘাতক চক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট সপরিবারে হত্যা করে। তারই ধারাবাহিকতায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২১ অগস্ট ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল জাতির জনকের কন্যা-সহ স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামি লিগের শীর্ষ নেতাদের।

বিহ্বল শেখ হাসিনা।

গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করতে সে দিন শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল ঘাতক চক্র। গ্রেনেড হামলায় রীতিমতো রক্তগঙ্গা বইয়ে গিয়েছিল আওয়ামি লিগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের প্রাঙ্গণ। সন্ত্রাসবিরোধী আওয়ামি লিগের জনসভাকে ঘিরে কোলাহলপূর্ণ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিল বীভৎস মৃত্যুপুরীতে। সুপরিকল্পিত ও ঘৃণ্য এই গ্রেনেড হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত ও শোকাবহ অগস্টে আরেকটি ১৫ আগস্ট সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছিল পরাজিত ঘাতক চক্র। তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে হামলার ধরনও ছিল রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের মতোই।

হত্যাকাণ্ডের পরে জজ মিয়া নাটক

বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে ২১ অগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় শুরু থেকেই হোতাদের আড়াল করতে তদন্তের গতি ভিন্নখাতে বইয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তদন্তের নামে বিভিন্ন সময় নানা ‘আষাঢ়ে গল্প’ হাজির করে প্রথম থেকে বিষয়টিকে বিতর্কিত করার কাজ শুরু হয় সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর-সহ তৎকালীন জোট সরকারের হাইকম্যান্ডের নির্দেশে হামলার শিকার আওয়ামি লিগের দিকেই আঙ্গুল তুলে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার হেন চেষ্টা নেই যা করা হয়নি।

প্রথমে একটি ইমেলকে কেন্দ্র করে শৈবাল সাহা পার্থ নামের এক যুবককে ধরে এনে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ভারতে পড়াশোনার কারণে পার্থকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার চর বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিএনপি-জামাত জোট সরকার দেশবাসীকে এটা বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিল, যে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছে। আর এ কাজে ভারতে পলাতক থাকা শীর্ষস্থানীয় ১৪ সন্ত্রাসবাদী অংশ নেয়। এ বিষয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ে পার্থর ওপর ব্যাপক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এর পর ঢাকার মগবাজার এলাকা থেকে সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার ও স্থানীয় আওয়ামি লিগ নেতা মোখলেছুর রহমানকে গ্রেফতার করে শুরু হয় আর এক নাটক।

পার্থ ও মোখলেছুর রহমানকে ধরেও হামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর দৃশ্যপটে হাজির করা হয় জজ মিয়া উপাখ্যান। ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালি জেলার সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের বাড়ি থেকে জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে সিআইডি আটক করে। ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে জজ মিয়ার কাছ থেকে সিআইডি সাজানো জবানবন্দি আদায় করে। একই ভাবে ওই বছরের নভেম্বরে আবুল হাসেম রানা ও শফিক নামের আরও দুই যুবকের কাছ থেকে প্রায় একই রকম সাজানো জবানবন্দি আদায় করা হয়। তৎকালীন সরকার সমর্থক পত্রিকা ও তাদের বুদ্ধিজীবীরা সেই সাজানো জবানবন্দি ফলাও করে প্রচার করে হামলার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার প্রাণপণ চেষ্টাও করে। বিভাগীয় তদন্তের নামে বিচারপতি জয়নুল আবেদিনের প্রতিবেদনেও ওই একই কথা বলা হয়। পরে প্রকাশ হয়ে পড়ে জজ মিয়ার পরিবারকে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন প্রতি মাসে মাসোহারা প্রদানের শর্তে এই সাজানো জবানবন্দি আদায় করে।

তত্ত্বাবধায়ক আমলে বেরিয়ে পড়ে ঝুলির বিড়াল

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর গোটা পরিস্থিতি পাল্টে যায়। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসেই ২১ অগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্ত শুরু করলে ঝুলির বিড়াল বেরিয়ে পড়ে। গ্রেনেড হামলার নেপথ্যের অনেক তথ্যই দেশবাসীর সামনে বেরিয়ে আসে। দেশবাসীর সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইডি ও পুলিশের তখনকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ২১ অগস্ট গ্রেনেড হামলার ব্যাপারে অবহিত ছিল এবং অনেকেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভাবে জড়িতও ছিলেন।

তদন্তে বেরিয়ে আসে বিএনপি-র উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর বাসভবনে বৈঠক করেই এ হামলার পরিকল্পনা করা হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা-সহ আওয়ামি লিগের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করার। এর পর আব্দুল সালাম পিন্টু ও তার ভাই তাজউদ্দিন মৌলানা তাহের হামলার জন্য ১৫টি গ্রেনেড ঘাতকদের হাতে হস্তান্তর করে। শীর্ষ জঙ্গি মুফতি হান্নানের জবানবন্দিতেও হামলার ঘটনা অনেক আগে থেকে তারেক জিয়া জানত এবং হামলার ব্যাপারে তার সমর্থন ছিল— এটিও প্রকাশ পেয়ে যায়। আসামিদের জবানবন্দিতেই হামলার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিসদ দফতরের ওই সময়ের পরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার এবং এনএসআইয়ের মহাপরিচালক আবদুর রহিম, জামাতে ইসলামির সেক্রেটারি জেনারেল আলি আহসান মহম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গিনেতা তাইজউদ্দিন, মৌলানা ফরিদ, মুফতি আব্দুল হান্নান, হুজির সাবেক আমির মৌলানা আব্দুল সালাম এবং কাশ্মীরি জঙ্গি আব্দুল মাজেদ বাটের নাম উঠে আসে।

১২ বছর পেরিয়েও শেষ হয়নি বিচার

তবে এত কিছুর পরও গত ১১ বছরে গ্রেনেড হামলার ঘাতকদের এখনও বিচার হয়নি। তবে মামলাটি এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। দু’এক মাসের মধ্যেই রায় আসবে বলেই আশা ব্যক্ত করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলার পৃথক চার্জশিটে মোট ৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে উল্লেখ করে সরকারি কৌঁসুলি আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল মামলা সম্পর্কে বলেন, ‘অভিযুক্তদের মধ্যে ১৯ জন পলাতক রয়েছে।’

অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যতম সাবেক মন্ত্রী এবং জামাতে ইসলামি সেক্রেটারি জেনারেল আলি আহসান মহম্মদ মুজাহিদের ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে এবং ৮ জন জামিনে রয়েছে ও অন্যরা বর্তমানে বিভিন্ন জেলে বন্দি রয়েছে।

অপর ১৯ জন আসামী বিভিন্ন দেশে পলাতক রয়েছে, তাদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। পলাতক ১৯ আসামী হল— লন্ডনে তারেক রহমান, ব্যাঙ্ককে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ, কলকাতায় হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক হানিফ, আমেরিকায় মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন, কানাডায় লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার, ভারতের কারাগারে বাবু ওরফে রাতুল বাবু, আনিসুল মোর্সালীন এবং তার ভাই মুহিবুল মুক্তাকীন এবং মাওলানা তাজুল ইসলাম দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়েছে।

জঙ্গিনেতা শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, মৌলানা আবু বকর, ইকবাল, খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গির আলম ওরফে বদর, মৌলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (পূর্ব) এবং উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) ওবায়দুর রহমান এবং খান সঈদ হাসান বিদেশে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে উল্লেখ করে সূত্র জানায়, তাদের বেশির ভাগই পাকিস্তানে রয়েছে।

তবে অপর অভিযুক্ত পলাতক হারিস চৌধুরীর অবস্থান জানা যায়নি। পলাতকদের মধ্যে মৌলানা তাজউদ্দিন ও বাবু কারাবন্দি বিএনপি সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই। পিন্টুও ২১ অগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত।

দিনটি উপলক্ষ্যে নানা কর্মসূচি

এই কালো দিনে নিহতদের স্মরণে আজ বিকেল ৪টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত অস্থায়ী শহিদ বেদিতে আওয়ামি লিগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের জাতীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন।

এ সময় আওয়ামি লিগ, ১৪টি দল এবং এর সহযোগী ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী দল এবং সংগঠনের নেতারাও অনুরূপ কর্মসূচিতে যোগ দেবেন। পরে একই স্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দেশবাসীর সঙ্গে ২১ অগস্ট গ্রেনেড হামলা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীরপূর্ণ পরিবেশে পালন করার জন্য তাঁর দল ও সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মী-সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন

মুজিব হত্যার চক্রান্ত আগেই

(প্রতিবেদনটির তথ্য গবেষণা সহায়তা করেছেন সন্দীপন বসু।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement