শঙ্কা আছে। আছে ধর্মান্ধদের চাপাতি বা বোমা, গুলি। আছে ব্লগার থেকে আর্টিজান বেকারি আর শোলাকিয়ার লাশগুলো। আছে আনসারউল্লাহ, হিজবুত তাহরির, জেএমবি। আছে মাদ্রাসা থেকে নর্থ সাউথের তরুণ জঙ্গি। কিন্তু তারচেয়েও অনেক বেশি আছে বাংলাদেশ। মুক্তচিন্তা আর মুক্তিযুদ্ধের শক্তি।
বাংলাদেশ এই সময়ে দাঁড়িয়ে আছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সামনে। উগ্র ধর্মান্ধদের কাছে পরাজয় নাকি চলমান উন্নয়ন আর প্রগতি? কোন পথ হবে আগামীর? শাহবাগ আন্দোলনের শুরুতে রাজীব হায়দারকে খুন করে যে যাত্রা শুরু করেছিল উগ্রবাদীরা তার গতি কিন্তু খুবই বিপজ্জনক। খেয়াল করলে দেখা যায় প্রথম খুন হলেন যাঁরা, তাঁরা ব্লগে মুক্ত মতামত লিখছিলেন। এর পরে খুন হলেন মওলানা ফারুকি সহ কয়েকজন পির। পুরোহিত, যাজক বা সংখ্যালঘুরা নতুন বিশেষণ পেলেন 'সফট টার্গেট'। তাঁদের খুন হওয়াটা নিয়মিত হয়ে উঠেছে। মাত্র কয়েক মাসের পাল্লায় মাপলে লাশের ওজন অনেক ভারী। ভয়ংকর খেলা শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে বাংলাদেশের বহু বছরের পরিচয় পাল্টে দেওয়ার খেলা।
আর্টিজান বেকারির হামলা বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর জন্যও ছিল নতুন ধরনের ঘটনা। গত জোট সরকারের সময়ে ৬৩ জেলাতে যে বোমা বিস্ফোরণ বা টার্গট কিলিং চলছে, বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়েছে, তার সঙ্গেও এই হামলার ধরন মেলে না। সাধারণ মানুষ যেমন হতবাক তেমনই দিশেহারা হয়ে পড়েছিল আশেপাশের দায়িত্বরত পুলিশ। তবে তারা মাঠ না ছেড়ে পাল্টা প্রতিরোধ করেছেন। প্রথম প্রতিরোধে নিহত হয়েছেন দুই পুলিশ কর্তা, আহত হয়েছেন অনেকে। সেই শোক আর ক্ষত দগদগে থাকতেই হামলা হল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইদের জামাত শোলাকিয়াতে। সওয়া লক্ষ মানুষ এক সঙ্গে ইদের নমাজ পড়তে পারেন এই জামাতে। লাখো মানুষের এই ইদ নমাজের জামাতে ইমামের দায়িত্ব পালন করেন মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ। এই মানুষটি গত সপ্তাহে লক্ষাধিক ইসলামি নেতার একটি ফতোয়া সংগঠিত করেছেন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। রাজাকারদের বিচারের ক্ষেত্রেও শক্ত অবস্থানে থেকে লড়াই করছেন।
এ বারে দুটো সরল বিষয়ে সরলভাবে নজর দেয়া যায়। শেখ হাসিনা সরকার যে দুটো বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তার একটা হল উন্নয়ন। আর একটা হল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তাদের বিচার। ২০০৮ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় আসা হাসিনা সরকারের কাজে দুটোর ফলাফলই বেশ দৃশ্যমান। পরিকাঠামো ক্ষেত্রে, বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে, তথ্য ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়েছে দেশ। পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়েছে প্রায় ৩৫ ভাগ। একই সঙ্গে এগিয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচার। কার্যকর হয়েছে পালের গোদা বেশ কয়েকজনের ফাঁসি। সেই বিচারকাজ শুরুর পর থেকেই দেশে এল এক নতুন অধ্যায়। একাত্তরে জামাতের ভূমিকার কথা আমরা জানি। জানি খুন ধর্ষণ-সহ গণহত্যায় তাদের সরাসরি অংশগ্রহণের ইতিহাস। সেই জামাত খুব সানন্দে এই বিচারকাজ মেনে নেবে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। তাদের শেষ আঘাতটা তারা হানবে সেটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের একটা উদার, অসাম্প্রদায়িক চরিত্র যাতে গড়ে না ওঠে, ’৭৫ এর পর থেকেই তার জন্য একটা তৎপরতা চলেছে। সেটা এখনও চলছে। এক দিকে যুদ্ধাপরাধীদের দলের কাজকর্ম অন্যদিকে আইএস, আনসার আল ইসলাম বা জেএমবির নামে বেনামে যা হচ্ছে- তা হঠাৎ আরম্ভ হওয়া কিছু নয়।
মনে রাখতে হবে আফগান-যুদ্ধ ফেরত যোদ্ধাদের যে সময়ে বাংলাদেশে বরণ করে নেয়া হয়েছে, তখনই বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন সবচেয়ে বেশি অসম্মানে। সারা দেশে চলেছে উগ্র হয়ে ওঠার এবং হয়ে ওঠানোর চর্চা। জেএমবির সূচনায় রাষ্ট্রই হয়ে উঠেছে তার পৃষ্ঠপোষক। মতিউর রহমান নিজামি তখন মন্ত্রী। তিনি উচ্চকন্ঠে বলেছেন- বাংলা ভাই বলে কেউ নাই, মিডিয়ার সৃষ্টি। আমরা কিন্তু দেখেছি বাংলা ভাই, আব্দুর রহমানের তাণ্ডব। আজ সেই নিজামির মৃত্যুদণ্ড যখন কার্যকর হয়েছে- তখন অনেক অস্বাভাবিক ঘটনাই স্বাভাবিক। মতিউর রহমান নিজামিদের যখন বিচার শুরু হল তখন থেকেই রাজনীতিতে নতুন কিছু মাত্রা যোগ হল। আমরা দেশকে অস্তিতিশীল করার নানা তৎপরতা দেখতে পেলাম।
ব্লগার হত্যার সময়ে অনেকে, এমনকি সরকারেরও অনেকে, বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দায় এড়িয়েছেন। কেউ তুলেছেন আস্তিক নাস্তিকের প্রসঙ্গ। পুলিশ প্রধান মত প্রকাশের সীমানা খুঁজতে ব্যস্ত হলেন, সেও আমরা দেখলাম। আর এই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা মত প্রকাশের সীমানার তত্ত্ব আর পাল্টা তত্ত্বে যে সময়ের অপচয়- তা মোটেই সুফল আনেনি। চিরুনি অভিযানে ১২ হাজার আটক হলেও পুলিশ আটক করতে পারেনি আর্টিজানের বা শোলাকিয়ার খুনিদের। অন্য দিকে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি প্রতিটি ঘটনায় সরকারকে দায় চাপিয়েই দায়িত্ব সারছেন। অন্য দিকে যে জামাতকে নিয়ে এত আলোচনা, যে দলটি সরাসরি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত, সেই জামাতকে জোটে রাখার বিষয়ে বিএনপির অবস্থান অনড়। আর তার কারণেই জামাতের কর্মের দায় বিএনপির এড়ানোর সুযোগ থাকছে না।
এ কথা মানতেই হবে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংক্ষালঘুরা শঙ্কাতে আছেন। সাধারণ মানুষ থেকে এখানে কর্মরত বিদেশিরা আতঙ্কিত। আর ঠিক সেটাই চাইছে চাপাতিবাজ জঙ্গিরা। তারা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করতেই এই হামলাগুলো করছে। তবে এই ভয়ের মধ্যেও ভরসা হল- বাংলাদেশ মানে একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশ মানে মুক্তিযুদ্ধ, পয়লা বৈশাখ। সেই কারণেই আশাবাদ- শুধু প্রশাসন নয়, দেশের মানুষও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পাহারাদারের ভুমিকায় এসে দাঁড়াবে। এবং দাঁড়াচ্ছেও। তাই শেষ পর্যন্ত প্রগতির বাংলাদেশই থাকবে। চাপাতিবাজ সন্ত্রাসবাদ নয়।
(লেখক বাংলাদেশের সাংবাদিক)