নুর চৌধুরী।
পঁচাত্তরের পনেরো অগস্টের সেই কালো রাতের কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বত্রিশ নম্বরের বাসায় ততক্ষণে হামলা করেছে কুচক্রী সেনার দল। দোতলা বাড়ির নিচতলায় বঙ্গবন্ধুর ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালকে হত্যার পর দোতলায় বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ঘাতকরা।
ভয়ঙ্কর সেই গোলাগুলির শব্দে বঙ্গবন্ধুর ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজি জামাল। একটা সময়ে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই ঘাতকরা তাঁকে ঘিরে ধরে। মেজর মহিউদ্দিন ও তাঁর সঙ্গে থাকা সেনারা বঙ্গবন্ধুকে নীচে নিয়ে যেতে থাকে। ঘাতকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?”
বঙ্গবন্ধুর সেই ব্যক্তিত্ব দেখে ঘাবড়ে যান মহিউদ্দিন। বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি, কী করবি, বেয়াদবি করছিস কেন?” এ সময় নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝি অবস্থান নেন বজলুল হুদা ও নূর। বঙ্গবন্ধুকে নীচে নিয়ে আসার সময় নূর কিছু একটা বললে মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ায়। সিঁড়ির দুই তিনটি ধাপ নামতেই বঙ্গবন্ধুকে স্টেনগান দিয়ে গুলি করে বজলুল হুদা ও নূর চৌধুরী।
বঙ্গবন্ধুর বুকে ও পেটে ১৮টি গুলি লাগে। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে বত্রিশ নম্বরের সিঁড়িতে পড়ে থাকেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সারা সিঁড়ি ভেসে যায় রক্তে।
জাতির জনককে নির্মমভাবে হত্যার ঠিক ৩৫ বছর পর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় খুনি বজলুল হুদার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। কিন্তু এর পরের ছয় বছরেও শেখ মুজিবুর রহমানের অপর আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকর সম্ভব হয়নি। কারণ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৬ সালে হংকং হয়ে যুক্তরাষ্ট্র তারপর কানাডায় আশ্রয় নিয়েছিলেন নূর চৌধুরী। তারপর থেকে উত্তর আমেরিকার দেশটিতেই আছেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী।
এর পর থেকে নানাভাবেই বঙ্গবন্ধুর অপর খুনি নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের চেষ্টা করেছিল বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিপক্ষে থাকায় নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে দেয়নি কানাডা। তবে হাল ছাড়েনি বাংলাদেশ। নানা ভাবে কানাডাকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের এই রায় কার্যকরের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করা হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
আরও পড়ুন: দুর্গা পূজার আগাম শুভেচ্ছা আনন্দ উৎসবে
আরও পড়ুন: বিচার বিলম্বিত হলেও অবশেষে ফাঁসি কার্যকর মুজিবের পাঁচ হত্যাকারীর
সেই চেষ্টার ফল মিলল আজ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীকে প্রত্যর্পণের বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও কানাডা।
শনিবার বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকাল শুক্রবার মন্ট্রিলের হায়াত রিজেন্সি হোটেলে কানাডা সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে দু’দেশ নূর চৌধুরীর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছয়। বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, “কানাডা থেকে নূর চৌধুরীকে প্রত্যর্পণের বিষয়ে দুই দেশের কর্মকর্তারা বৈঠকে বসবেন এবং এর উপায় খুঁজে বের করবেন।” তিনি আরও বলেন, “এই আলোচনার লক্ষ্য হচ্ছে নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর করা।”