বাঁকুড়া! ইতিহাস, বৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, লোকসংস্কৃতি, লোকদেবদেবী, পাহাড়, অরণ্য, বিরল প্রজাতির গাছগাছালি, বন্য জীবজন্তুর এক আশ্চর্য মেলবন্ধনের জেলা। পশ্চিমবঙ্গের এক আদিম ভূখন্ড!
আর সেখানে রয়েছে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য যেন এক রত্নভাঁড়ার! তাই-ই তো। এখানকার এক-একটা পর্যটন স্থান যেন এ বলে আমায় দেখো, ও বলে আমায়! বাঁকুড়ার সে রকমই একটা লা-জবাব ট্যুর গাইডের সন্ধান দিচ্ছে প্রতিবেদন।
দুর্গাপুজোর ছুটির আমেজ মন থেকে এখনও পুরোপুরি যায়নি। সামনেই লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, ভাইফোঁটা। সপ্তাহান্তের ছুটির সঙ্গে যদি আরও দুটো-একটা দিন অফিসের বস-কে 'ম্যানেজ' করে ছুটি বাগাতে পারেন, এখনই বেরিয়ে পড়ুন বিহারীনাথ ভ্রমণে।
সঙ্গে ওর কাছাকাছি ঘুরে আসুন গড়পঞ্চকোট, জয়চন্ডী পাহাড়, পাঞ্চেত বাঁধ, শুশুনিয়া পাহাড় এবং কল্যাণেশ্বরী মন্দির ও মাইথন বাঁধ দর্শনের সঙ্গেই দুই লোকদেবীর অধিষ্ঠানের অদ্ভুত গ্রাম ভূতাবুড়ি আর ঘাঘরাবুড়ি।
বাঁকুড়ার সবচেয়ে উঁচু পাহাড় বিহারীনাথ। ১৪৫০ ফুট। পূর্বঘাট পর্বতমালার অংশ। পুরাতাত্ত্বিক মহলে বিহারীনাথ ধামের গুরুত্ব খুব বেশি। পাহাড়ের নীচেই বিখ্যাত বিহারীনাথ মন্দির। কথিত আছে, এই মন্দিরের শিবলিঙ্গ তৎকালীন রাজা স্বপ্নাদেশে পেয়েছিলেন। শিবের আরেক নাম বিহারীনাথ।
বিহারীনাথ পাহাড়ের নীচের অংশটা এখানকার মূল পর্যটন কেন্দ্র। শিবরাত্রিতে বিশাল মেলা বসে, পাহাড়ের কোলে মন্দির চত্বরকে কেন্দ্র করে। অসংখ্য ভক্তসমাগম হয়। মন্দির সংলগ্ন একটা পুকুর আছে। যার জল স্থানীয় মানুষের কাছে অত্যন্ত পবিত্র গণ্য হয়ে আসছে যুগ-যুগান্ত ধরে।
প্রকৃতিও এখানে উপুড় করে দিয়েছে অপার সৌন্দর্যকে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিহারীনাথ পাহাড়ের রং পাল্টায়। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে লালে লাল। সে সময় পাহাড়ের গায়ে থরে থরে লাল পলাশ ফুলের শোভা দেখবার মতো। বর্ষায় আবার বিহারীনাথ পাহাড় সবুজে সবুজ। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ তখন আরও সতেজ সবুজ, আরও ঘন। এখানকার পাহাড় পথে চলার মাঝে দেখা পেতে পারেন শেয়াল, খরগোশ, গিরগিটি থেকে শুরু করে বুনো শুয়োর, বনরুই এমনকি হায়নাও!
তবে পাহাড়ের পথ সুগম নয়। পদে পদে বিপদ ঘটে যেতে পারে। যে জন্য সাধারণ মানুষ বেশি উচ্চতায় ওঠা উচিত নয়। আর পাহাড় পথে হাঁটলেও সকাল-সকাল হাঁটুন। সূর্যাস্তের পর মোটেও যাবেন না।
ঘন জঙ্গল আর সবুজে ঘেরা এখনও আদিম রূপের পাহাড় বিহারীনাথের কোলে কাছাকাছিই পড়বে আদিবাসী গ্রাম পাহাড়বেড়া। গ্রামের প্রতিটি মাটির বাড়ির দেওয়াল জুড়ে আলপনার বাহার। গ্রামীণ লোকশিল্প-সংস্কৃতির উজ্জ্বল নিদর্শন। আরেকটু গেলেই রয়েছে এক সাঁওতাল গ্রামও।
বিহারীনাথ ভ্রমণে ট্রেন ও সরাসরি গাড়িতে, দু'ভাবেই যাওয়া রায়। ট্রেনে আসানলোল লাইনে মধুকুন্ডা স্টেশনে নেমে গাড়িতে আরও ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে বিহারীনাথ। রানিগঞ্জ স্টেশনে নেমেও গাড়িতে পৌঁছনো যায় বিহারীনাথে। অথবা ছাতনা থেকে সরকারি বা বেসরকারি বাসেও যাওয়া যায়। সরাসরি গাড়িতে গেলে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস সড়কপথে দামোদর নদী পেরিয়ে মধুকুন্ডার রেল ক্রসিং থেকে আরও ১৬ কিলোমিটার।
বিহারীনাথ ভ্রমণ সেরে কাছাকাছি পর্যটন কেন্দ্রগুলো বেড়াতে গিয়ে কল্যাণেশ্বরী মন্দির ও মাইথন বাঁধ দেখার সঙ্গেই ভূতাবুড়ি এবং ঘাঘরাবুড়ি ঘুরে নেওয়া সবচেয়ে ভাল।
দুটোই প্রত্যন্ত গ্রাম। আধুনিক যুগেও এখনও সহজ সরল লৌকিক বিশ্বাস আর লৌকিক দেবীতে ভরসার এক নির্মল স্থান ভূতাবুড়ি। ভূত মানে ‘প্রেতাত্মা’। ভূতের চলতি ভাষায় স্ত্রী-লিঙ্গ থেকে ভূতি শব্দের উৎপত্তি স্থানীয় গ্রামবাসীদের।
কিন্তু কথিত আছে আসানসোল-বার্নপুর শিল্পাঞ্চল হয়ে ওঠার বহু আগে প্রাচীন যুগে কৃষিপ্রধান অঞ্চল ছিল। আর তখন এখানকার মানুষের দুঃখকষ্ট, রোগভোগ নিবারণ করতেন লোকদেবী ভূতাবুড়ি-ই।
বার্নপুর শিল্পাঞ্চল থেকে বাসে হীরাপুর ধর্মতলা স্টপেজে নেমে দক্ষিণে শ্যামডিহ গ্রামের ভেতর ভূতাবুড়ির মন্দির। ঠিক আর পাঁচটা সাধারণ মন্দিরের মতো নয়। মা ভূতাবুড়ি চণ্ডীর রূপে পূজিত হন। কিন্তু আদতে লোকদেবী।
দামোদর নদীর অনাবিল সুন্দর প্রকৃতির তীরে নিস্তব্ধ পশ্চিম বর্ধমানের একদম সীমান্ত এলাকায় দেবীর থান। ওপারেই বাঁকুড়া, আরও দক্ষিণে বিহারীনাথ পাহাড়। ভূতাবুড়ির কোনও মূর্তি নেই। কয়েকটি পাথরের ঘোটক দেবীর প্রতিভূ। পাশেই বাঘরায়ের থান। স্থানীয় মানুষজনের কাছে যা ভূতাবুড়ির ভৈরব হিসেবে পরিচিত।
লোকগাথা অনুসারে ভূতাবুড়ির ছয় বোন, এক ভাই। সবচেয়ে বড় বোন ঘাঘরাবুড়ি। আসানসোলে কালীপাহাড়ের কাছে ঘাঘরাবুড়ির থান। দেবীকে ঘাঘরা পরানো হয়, সেই থেকে নাম ঘাঘরাবুড়ি। নুনিয়া নদীর ধারে তিনটে শিলাকে দেবী চন্ডীর প্রতিভূ মনে করে ঘাঘরাবুড়ির পুজোর্চনা হয়ে আসছে যুগ-যুগান্ত যাবত। এখানে পয়লা মাঘ এবং শ্যামাপুজোয় বড় উৎসব হয়। বিরাট মেলা বসে। সেখানে কাঠের উনুনের আগুনে মাটির বিশাল মালসায় জাল দিয়ে-দিয়ে ফোটানো ঘন দুধ একবার খেলে তার আস্বাদ জীবনে ভোলার নয়!
ঘাঘরাবুড়িতে যাওয়ার জন্য বার্নপুর থেকে অটো বা টোটো পাওয়া যায়। সরাসরি গাড়িতে গেলে কালীপাহাড় হয়ে পৌঁছতে হবে। বাসও আছে।
থাকার জায়গা-বিহারীনাথ ভ্রমণ সহ এই সব ক'টা বেড়ানোর জায়গায় গেস্ট হাউস আছে। আসানসোল-বার্নপুরে রয়েছে ছোট-বড় অজস্র হোটেল। সব মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যেও। এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।