আপনার হাঁটু থেকে ছাদ অবধি চারদিক স্বচ্ছ কাঁচে মোড়া একটা বাক্সবন্দি। নাম তার কেবল্ কার। গোদা বাংলায় যাকে বলে রোপওয়ে। ভিতরে বসার কোনও ব্যবস্থা নেই। বাকি ১৯ জন সহযাত্রীর (আজ্ঞে হ্যাঁ, একেকবারে এখানকার কেবল কারে ২০ জনকে তোলা হয়) মতো আপনাকেও পাক্কা পৌনে চার কিলোমিটার দীর্ঘ আকাশপথ স্রেফ দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে হবে।
ওহ্, বলতে ভুলে গিয়েছি, এটাই এশিয়ার দীর্ঘতম এবং উচ্চতম রোপওয়ে। গোটা পৃথিবীতে উচ্চতার দিক দিয়ে দ্বিতীয়। এবং গর্বের সঙ্গে লিখছি, এ হেন অত্যাশ্চর্য রোপওয়ে ব্যবস্থাটি আমাদের দেশেই। ভারতবর্ষের উত্তরাখন্ডে। আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে আউলি-তে।
আউলি! দেবভূমি উত্তরাখন্ডের সত্যি সত্যিই যেন এক স্বর্গস্থান। প্রকৃতি যেন তার যাবতীয় সৌন্দর্য, রোমাঞ্চ, রোম্যান্টিসিজম, অ্যাডভেঞ্চার, উপভোগ্যতার পাশাপাশি বিপদসকূল্যতা— সব সব এখানে দু’হাত উপুড় করে দিয়েছে ভ্রমণপিপাসু মানুষজনের জন্য! ভারতীয় পর্যটনের অন্যতম সেরা আকর্ষণ আউলি ভ্রমণ।
কী রকম? জোশীমঠের অদূরে আউলি-র রোমহর্ষক রোপওয়ে যাত্রার কথা ছেড়েই দিন। ওটা ছাড়াও আউলিতে এমন অনেক কিছু আছে যা বোধহয় এ দেশের অন্য কোনও ট্যুরিস্ট স্পটে নেই বা, খুব সামান্য জায়গায় আছে। আউলি শুধু নিছক একটি হিল স্টেশন অর্থাৎ শৈলশহরে নয়।
এখান থেকে একের পর এক তুষারাবৃত শৃঙ্গ দেখা, বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্ট করার সুবর্ণ সুযোগ, এমনকি শীতকালে গোটা বরফে মোড়া আউলির নির্দিষ্ট জায়গায় স্কিইইং করার বিরল বন্দোবস্ত— মিলেমিশে আপনাকে এক অপার্থিব আনন্দে বুঁদ করে রাখবে।
তাছাড়া সকাল-বিকেল অলস পায়ে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা, ভোরে লজের বারান্দা থেকে দিনের প্রথম আলোয় পাহাড়চুড়োর রংবদল, সন্ধেয় সোনাঝরা সূর্যাস্তের মায়া ধরা আলোয় নানা অচেনা পাখিদের ঘরে ফেরার অপরূপ দৃশ্য তো আর সব শৈলশহরের মতো আউলিতেও দেখতে পাবেন, তুলনায় একটু বেশিই দেখবেন! এখানকার জিএমভিএন লজের পাশেই আছে হনুমানজির একটা চমকপ্রদ মন্দির। যার প্রায় ঠাকুরদালান থেকে দেখা যায় কামেট, গৌরি, নীলকান্ত।, হাতি পর্বত ‘পিক’ বা শৃঙ্গ।
যদিও আউলির আসল আকর্ষণ হল রোপওয়ে— কেবল কার যাত্রা। জাস্ট ম্যাজিক! খাঁটি জাদু! ন’হাজার ফুটেরও বেশি উঁচুতে শূন্যে পৌনে চার কিলোমিটার আকাশ পথ স্রেফ একটা লোহার দড়িতে ঝোলানো কাঁচের বাক্সে চেপে যেতে যেতে আপনার চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে হিমালয়! পরপর চোখের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে নন্দাদেবী, দ্রোণাগিরি, ত্রিশূল, নন্দাকোট, পঞ্চমুখ ‘পিক’ অর্থাৎ শৃঙ্গ। স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর, রূপকথার চেয়েও বাস্তব এ এক অভিজ্ঞতা যেন!
সেই অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আচ্ছন্ন থাকতে থাকতেই অনুভব করবেন আউলির গোটা রোপওয়ে যাত্রায় মোট দশটা টাওয়ার আছে। এরকম ৫ নম্বর টাওয়ারের পর থেকে শুরু হয় আসল ম্যাজিক! শূন্যে হিমালয় উন্মুক্ত হওয়া! ৯ ও ১০ নম্বর টাওয়ার পেরোলে আউলির বিখ্যাত ‘গরসনবুগিয়াল’। এটাই শীতকালে ভারতবর্ষের স্কিইইংয়ের সেরা ও একমাত্র আদর্শ গন্তব্যস্থল। এখানে একটি স্কেটিং স্কুল আছে পর্যন্ত। রোপওয়ের ১০ নম্বর টাওয়ার শেষে ‘আউলি টপ’। শীতকালে বরফে ঢাকা। যেতে গেলে ১০ নম্বর টাওয়ারেই ভাড়া পাওয়া যায় বরফে হাঁটার বিশেষ জুতো ও লাঠি।
আউলির রোপওয়ে সার্ভিস চলে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধে ৬.৩০ পর্যন্ত। আধ ঘন্টা অন্তর ছাড়ে। ২৫ মিনিটের যাত্রাপথ। ভাড়া মাথাপিছু ৭৫০ থেকে ১০০০ টাকা। পাঁচ বছরের কম বয়সি বাচ্চাদের টিকিট লাগে না। পর্যটকদের শুধু খেয়াল রাখতে হবে যে, বেশি মালপত্র নিয়ে কেবল কারে ওঠা বিপজ্জনক। হয় যে গাড়িতে আউলি এসেছেন, তাতে ব্যাগ রাখুন, নিদেনপক্ষে জোশীমঠের হোটেলের ক্লকরুমেও ব্যাগেজ রেখে আউলি বেড়াতে আসতে পারেন।
বদ্রীনাথ অথবা হেমকুন্ড যাওয়ার পথে আউলি ঘুরে নেওয়া যায়। জোশীমঠ থেকে রোপওয়ে চেপে আউলি পৌঁছনো যায়। সময় লাগে ২৫ মিনিট। আউলিতে যাঁরা রাত্রিবাস করতে চান, তাঁদের রোপওয়ের ৮ নম্বর টাওয়ারে নামতে হবে। এখানেই আউলির দুটি মাত্র রিসর্ট রয়েছে। জিএমভিএন স্কাই রিসর্ট এবং আউলি রিসর্ট। দুটো রিসর্টেই পৌঁছতে প্রথমে রোপওয়ের ৮ নম্বর টাওয়ারের ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে নেমে, ফের একদফা 'চেয়ার লিফটে' চেপে পাঁচ মিনিট গেলেই গন্তব্যস্থল। অনেকে চেয়ার লিফট না নিয়ে হাঁটা পথে দেড় কিলোমিটার ট্রেক করে রিসর্টে যান।
কী ভাবে যাবেন: আউলির কাছাকাছি বিমানবন্দর দেরাদুন। ২৯৮ কিলোমিটার দূরত্বে। কাছাকাছি রেল স্টেশন হৃষিকেশ। ২৩৫ কিলোমিটার দূরে। সড়ক পথে যোশিমঠ থেকে স্থানীয় বাস ছাড়ে আধঘন্টা অন্তর।
কোথায় থাকবেন: আউলিতে দুটি মাত্র রিসর্ট ছাড়াও জোশীমঠে রোপওয়ে পয়েন্টের কাছে ৩-৪টে হোটেল আছে। ঘরভাড়া ১১০০ টাকা থেকে শুরু। তবে কোনও হোটেলে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। হোটেল থেকে বেরোলেই রাস্তার ওপর দুটো রেস্তরাঁ আছে। একটায় নিরামিষ, আরেকটায় আমিষ খাবার পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।