অনেক রাবীন্দ্রিক বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্ভবত শ্রেষ্ঠ প্রেমোপন্যাস হিসেবে যেটি বিবেচিত হয়, সেই ‘শেষের কবিতা’র পটভূমি ছিল শিলং। উত্তর-পূর্ব ভারতের যে শৈলশহরে বেড়াতে গিয়ে উপন্যাসের নায়ক অমিত রে এক পথ দুর্ঘটনার জেরে প্রেমে পড়ে লাবণ্যর।
কিন্তু এক দিন সেখানে হাজির হয় কেটি ওরফে কেতকী। এবং তাঁর আঙুলে পরা আংটি দেখিয়ে বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার অমিতকে নিজের বলে দাবি করেন। ভেঙে যায় অমিত-লাবণ্যের বিয়ের তোড়জোড়।
জানা যায়নি, কিম্বা বিশ্বকবি কোথাও কোনও ভাবে প্রমাণ রেখে যাননি যে, শিলংয়ের পটভূমিতে সৃষ্ট তাঁর এই অমর ত্রিকোণ প্রেমের উপন্যাস ওই শৈল শহরেরই সুপ্রাচীন তিন প্রস্তরশিলার প্রেমের লোকগাঁথা থেকে অনুপ্রাণিত কিনা? যদিও অবশ্য সেই প্রাকৃতিক বস্তুর ত্রিকোণ প্রেমের পরিণতি রক্তাক্ত!
শিলং থেকে মাত্র ৪৮ কিলোমিটার দূরে মেঘালয় পূর্ব খাসি পার্বত্য জেলা পাইনুরস্লা তফসিলের অন্তর্গত একটি গ্রাম ওয়াহখেন। সেখানে খাড়াই পাহাড়ের পাশে আর কোথাও কোথাও চারদিক জঙ্গলে ঘেরা ওয়াহরিউ নদীর উপরে সম্পূর্ণ বাঁশের বানানো দীর্ঘ ৭ কিলোমিটার ব্যাপি ‘ট্রেল’ বিখ্যাত, দেশবিদেশের ট্রেকারদের কাছে, অতুলনীয় ট্রেকিংয়ের জন্য।
যে রোমাঞ্চকর বাঁশের ট্রেকিং পথে পড়ে তিনটি বিশালাকায় রাক্ষুসে সাইজের প্রস্তরশিলা। কথিত আছে, এর একটা, যার নাম, ইউ মাওরিংথাং, মেঘালয়ের একক বৃহত্তম শিলা। যাকে ওয়াহখেন গ্রামে বলা হয়, ‘শিলার রাজা’!
লোকগাথা অনুসারে আবার অন্য এক জায়গায় থাকা দ্বিতীয় বিশালাকায় শিলাটি নাকি মহিলা শিলা! নাম কেথিওয়াং। মাওরিংথাং এবং কেথিওয়াংয়ের মধ্যে প্রেম হয়। কিন্তু তার ভেতর তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে ঢুকে পড়ে তিন নম্বর বিশালাকায় শিলা, যার নাম মওপাটোর। কেথিওয়াংয়ের প্রেমে মাওরিংথাং এবং মওপাটোর, দুজনেই হাবুডুবু খায়। শেষমেশ দুজনের লড়াইয়ে মওপাটোরের শিরশ্ছেদ করে মাওরিংথাং।
বলা হয়, মওপাটোরের কাটা মাথাটাই এই বাঁশের ‘ট্রেল’-এ ট্রেকিংয়ের পথে দেখতে পাওয়া তিন বিশাল রাক্ষুসে সাইজের শিলার তৃতীয়টি। এ তো গেল মাওরিংথাং ট্রেকের প্রাচীন লোকগাঁথা। কিন্তু এর আধুনিক কর্মযজ্ঞের কথা ভাবলেও অবাক লাগবে।
এই রোমহর্ষক ট্রেক মাত্র ২০১৬ সালে সাধারণ ট্রেকার-পর্যটকদের জন্য খুলে দেয় মেঘালয় সরকার। কিন্তু বানিয়েছেন স্থানীয় ওয়াহখেন গ্রামের লোকজন। এবং সেটাও কোনও রকম সরকারি সাহায্য ছাড়াই। বানানোর পরে এখন যদিও এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাজ্যের পর্যটনের অধীনস্থ ট্যুরিজম প্রমোটার্স ট্রেকিং সোসাইটির, কিন্তু আগাগোড়া নির্মাণের কৃতিত্ব গ্রামবাসীদের।
তা’ও কিনা যে ওয়াহখেন গ্রামে মোট মানুষের বাস সাকুল্যে ১০০০ জন! সেই ছোট্ট গ্রামের লোকজনেরাই একাধিক বাঁশের সাঁকো, কাঠের মই তৈরি করে সেগুলি সব বেতের দড়ি দিয়ে বেঁধে দীর্ঘ ৭ কিলোমিটার ‘ট্রেল’ নির্মাণ করেছেন। এমনকি এত ব্যাপক নির্মাণ কান্ডে পেরেকের ব্যবহার পর্যন্ত যৎসামান্য হয়েছে!
স্বভাবতই মাওরিংথাং ট্রেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনার অতীত! অনির্বচনীয় সুন্দর ট্র্যাকটি অবশ্য এ বছর মেঘালয়ের ভারী বৃষ্টিতে কিছু কিছু জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মাঝে দু’মাস বন্ধ ছিল। মেরামতের পর গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ফের খুলে দেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে এর রক্ষণাবেক্ষণে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মাওরিংথাং ট্রেকের দূষণ রোধে গোটা ৭ কিলোমিটার পথে কোথাও কোনও প্লাস্টিক, বোতল, অপচনশীল সামগ্রী ফেলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
কীভাবে যাবেন : শিলং থেকে ভাড়া ট্যাক্সি বা জিপে ওয়াহখেন গ্রামে পৌঁছে সেখান থেকে বাদবাকিটা ট্রেকিং। শিলং বিমানে অথবা গুয়াহাটি থেকে সড়কপথে যাওয়া যায়। সড়কপথে সরকারি-বেসরকারি বাস, গাড়ি, জিপ পাওয়া যায়। থাকার জায়গা : শিলং শহরে প্রচুর হোটেল। ওয়াহখেন গ্রামেও কয়েকটি হোম-স্টে আছে। এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।