দিল্লির মসনদে তখন মুঘল সম্রাট অওরঙ্গজেব। তাঁর বিভিন্ন গোঁড়া ধর্মীয় নীতির কারণে মুঘল রাজদরবার ছেড়ে বিষ্ণুপুরে হাজির হলেন তানসেনের বংশধর বাহাদুর খাঁ। বিষ্ণুপুরে তখন মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের শাসন। তানসেনের নাতির ছেলে এই বাহাদুর খাঁ-র হাত ধরে জন্ম নিল 'বিষ্ণুপুর ঘরানা'।
বাহাদুরের সঙ্গে সেই সময়ে বিষ্ণুপুরে পৌঁছেছিলেন বিখ্যাত পাখোয়াজ বাদক পীরবক্স। আর এ সবের সূত্রেই নাকি এসেছিলেন 'লালবাঈ'! দ্বিতীয় রঘুনাথ আর লালবাঈয়ের সেই ঐতিহাসিক প্রেম অন্য রূপ পেয়েছিল রমাপদ চৌধুরীর 'লালবাঈ' উপন্যাসে।
দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের আমলে বিষ্ণুপুর জুড়ে শুরু হয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চল। দুর্গা পুজোতেও সে কারণে সঙ্গীতের প্রভাব পড়তে শুরু করে। মল্ল রাজাদের পুজো হাজার বছর ছাড়িয়েছে। মল্ল রাজারা নিজেদের নামে বর্ষপঞ্জি চালু করেছিলেন। আদি মল্ল 'মল্লাব্দ'-এর প্রচলন করেন। ৩০৩ মল্লাব্দ নাগাদ বিষ্ণুপুরে দুর্গাপুজো শুরু করেন জগৎ মল্ল। ৩০৩ মল্লাব্দ মানে ৯৯৭ সাল। জগৎ মল্ল ছিলেন মল্ল বংশের ১৯তম রাজা। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন মৃণ্ময়ী মন্দির।
হাজার বছরেরও প্রাচীন মল্লরাজাদের পুজোয় রাজাদের খেয়ালে যেমন অনেক রেওয়াজের জন্ম হয়েছিল তেমনই বহু রেওয়াজ হারিয়েও গিয়েছিল। যেমন, শোনা যায় জগৎ মল্লের আমলে মা মৃণ্ময়ীকে তুষ্ট করতে রাজারা নরবলি দিতেন। পরে তার বদলে শুরু হয় 'পশুবলি'। তারও পরে চৈতন্য পার্ষদ শ্রীনিবাস আচার্যের প্রভাবে মল্লরাজ বীর হাম্বীর যখন বৈষ্ণব হয়ে গেলেন, তখন এই বলি প্রথাও চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক তেমনই রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের আমলে দেবী পুজোয় রাগ সঙ্গীতের এক বৈচিত্রময় ধারার সংযোজন ঘটে। যা কয়েক দশকের মধ্যেই হারিয়ে যায়।
মল্ল রাজবংশের বর্তমান রাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ ঠাকুর এ প্রসঙ্গে বলেন, " রাজবাড়ির ‘বলী নারায়ণী পুঁথি’ অনুসারে দেবীর পুজো হয়। মহাষ্টমীর দিন দেবী বিশালাক্ষীর পুজোর রেওয়াজ বহু প্রাচীন। অষ্টধাতুর প্রাচীন মূর্তিকে সে দিন স্নান করানো হয়। অনুষ্ঠিত হয় দেবীর মহাস্নান যাত্রা । এই স্নানযাত্রার অনুষ্ঠানেই রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের আমলে হয় সঙ্গীতময় সংযোজন। দেবীকে স্নান করানোর সময়ে আগে কেবল মন্ত্রপাঠ হত। দ্বিতীয় রঘুনাথের আমলে ১০৮ টি ঘটের জলে দেবীকে স্নান করানোর সময় বিভিন্ন রাগে গান গাওয়ার রেওয়াজ শুরু হল। ৮ টি ঘটে করে জল ঢালার সময়ে নির্দিষ্ট ৮টি রাগে গাওয়া শুরু হয়। যদিও এই রেওয়াজ কয়েক দশকের মধ্যে হারিয়েও যায়।
মৃন্ময়ী মন্দিরের দেওয়ালে পটে অঙ্কিত তিনটি দেবীমূর্তিও তিনটি রাগের প্রতীক বলে ধারণা অনেকের। অতীতে মল্লরাজারা সন্ধিপুজোর সময় রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত অষ্টধাতুর বিশালাক্ষী মূর্তিতে স্বর্ণচাঁপা ফুল দিয়ে রাজ-অঞ্জলি দিতেন। সেই অঞ্জলি সমাপ্ত হওয়ার পরে অন্যরা অঞ্জলি দিতে পারতেন। সেই পরম্পরা আজও চলে আসছে।"
দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহকে আজও অমর করে রেখেছে তাঁর আমলে জন্ম নেওয়া 'বিষ্ণুপুর ঘরানা'র সঙ্গীত। সঙ্গীতপ্রিয় মহারাজ তাঁদের শতাব্দীপ্রাচীন পুজোর অঙ্গ হিসেবে তাই সঙ্গীতের প্রভাবকে জুড়ে দিয়েছিলেন রীতির আকারে। পুজোর রেওয়াজে এই রাগসঙ্গীত প্রথা অবলুপ্ত হলেও বিষ্ণুপুর ঘরানা এবং এই ঘরানার সঙ্গীত আজও সারা বিশ্বে জনপ্রিয়।
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।