সালটা ১৯৩৬। পরাধীন ভারতের উত্তর কলকাতাকে তখন বলা যায় সারা দেশের চিন্তন মননের কেন্দ্রভূমি। কলকাতার সার্বজনীন দুর্গাপুজো তখন বিদেশি শাসকের চোখে স্বদেশিদের আখড়া।
এমনই মাহেন্দ্রক্ষণে গুটিকয়েক যুবক আর স্থানীয় কিছু মানুষ মিলে রাজবল্লভ পাড়ার অখ্যাত গ্যারেজে শুরু করল দুর্গাপুজো। নাম ১ নম্বর ওয়ার্ড সর্বজনীন দুর্গোৎসব। প্রায় একই সময় ‘সাধারণ দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনী’ নামে আরও একটা দুর্গাপুজো হত জগৎ মুখার্জি পার্কে।
সামান্য কিছু চাঁদা আর অনুদানের উপর ভিত্তি করে অনাড়ম্বরভাবে ঘরোয়া পরিবেশে। এর পর স্বাধীনতার পরে ১৯৪৭-এ দুই পুজো এক হয়ে নাম হল ১ নং ওয়ার্ড সাধারণ দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনী। গ্যারেজ থেকে সরে এল জগৎ মুখার্জি পার্কে। শুরু থেকে ধরলে ৮৬ বছর পার করে এই পুজো চলে আসছে। গোটা কলকাতা যাকে চেনে জগৎ মুখার্জি পার্কের পুজো বলে।
আজকের শহর যাকে ‘থিম পুজো’ বলে চেনে জগৎ মুখার্জি পার্কের দুর্গাপুজো সেই '৫০-এর দশকে তার কারিগর। থিম নির্মাণের ‘ভগীরথ’ অশোক গুপ্ত সমগ্র প্রতিমা সজ্জায় সমকালীন প্রেক্ষাপটে শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব এবং পরিণামে শুভ শক্তির বিজয়গাথা চিত্রিত করেছিলেন বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে।
সেই পরম্পরার পথে এ বছর এদের পুজো এমন এক জন শিল্পীকে পেয়েছে যিনি এর মধ্যেই শহর কলকাতার দুর্গাপুজোর এক বিশিষ্ট নাম। সেই প্রথিতযশা শিল্পী পরিমল পাল জানাচ্ছেন, 'ফুলকুমারী' ওরফে সোমা দাস বা 'ফুলদি' জীবনের নানা বর্ণিল পথে হোঁচট খেতে খেতে মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রবেশ করেন আর্ট কলেজের চৌকাঠে। না, ছাত্রী হিসেবে নয়, বরং দারিদ্রের তাড়নায় তিনি হয়ে উঠলেন চারু শিল্পের মডেল। পরবর্তীকালে তাঁরই অনুপ্রেরণায় এই পেশাকে নির্দ্ধিধায় বেছে নিয়েছেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই। বলা যায়, কলকাতায় এ কাজের পথিকৃৎ তিনি।
যে দেশে মন্দিরের ভাস্কর্যের বিষয় ভাবনায় স্থান পায় অনাবৃত নারী-পুরুষের মিলনের গল্প, সেখানে এই এক বিংশ শতকেও এই পেশাকে মর্যাদা দেয় না আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। তাই 'ফুলদি'র মতো মানুষেরা নিজেদের কাজকে আজও পরিবার-পরিজন বা সমাজের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছেন।
এঁদের মনে বারবার প্রশ্ন জেগেছে, তাঁদের দেহ সৌষ্ঠবকে শৈল্পিক প্রয়োজনে অনাবৃত করার মধ্যে কি কোনও অন্যায় আছে?
বরং তাঁরা যদি এ কাজকে আপন করে না নিতেন তাহলে চারুশিল্পের একটা দিক অন্ধকারেই থেকে যেত। এই বারোয়ারি ক্লাবের দুর্গোৎসব এই প্রান্তিক মুখগুলোর গল্প শোনাচ্ছে, যা রয়ে গিয়েছে তথাকথিত নাগরিক জীবনের আড়ালে। এবার এঁরা দাঁড়াচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে। এঁদের মুখে এসে পড়ছে শারদ সূর্যের এক ফালি রোদ। আলোকিত হচ্ছে এঁদের যাপন!
থিম - ফুলকুমারী
রূপকল্প - পরিমল পাল
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।