প্রতীকী ছবি
"দেখো! ছোটোপিসির ছেলে আর ছেলের বউ, বিয়ের তিনমাসের মাথায় প্যারিস ঘুরতে চলে গেলো। আর আমরা? এই পাইকপাড়ার বাইরে কোথাও যেতে পারলাম না আজ অবধি।"— আপনাকেও কি বাড়িতে এমন সাড়ে চুয়াত্তর ডেসিবেলের মুখ ঝামটা শুনতে হয় নিয়মিত? আপনিও কি অফিস থেকে একটা ছুটি ম্যানেজ করে মন্দারমনি ঘুরতে যাবেন বলে, নিজের জলজ্যান্ত রাঙাদিদাকে ইতিমধ্যেই ক্যাওড়াতলায় পাঠিয়ে দিয়েছেন? তাহলে এই প্রতিবেদনটি শুধুমাত্র আপনার মতো মানুষদের জন্য।
এবছর রোমের ভ্যাটিকান সিটি থেকে ঘামতে ঘামতে বেরিয়ে, মাত্র ৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই আপনি সপরিবারে পৌঁছে যাবেন বৃন্দাবনের প্রেম মন্দিরে। আবার এই প্রেম মন্দির থেকে বেরিয়ে একটা এগ-চিকেন রোল খেতে খেতে কিছুটা হাঁটলেই আপনি পৌঁছে যাবেন রাজস্থানের শীশ মহলে। না, আমি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা নই যে ভোটের আগে আপনাদের সামনে প্রতিশ্রুতির গবাদি পশু (ইদানিং নাম নিতে নেই)-কে নারকেল গাছে তুলে দেবো। আমি সামান্য লেখক, তাই পুজোর আগে আপনাদের একটু দেশ বিদেশের নানান জায়গায় ঘোরানোর চেষ্টা করছিলাম আর কী।
গত কয়েকবছর ধরে থিমপুজোর ব্যালকনিতে সৌরভ গাঙ্গুলির মতন জামা ঘুরিয়ে চলেছে হলিডে ডেস্টিনেশন নামক একটি থিম। মানে ধরুন আপনার বুর্জ খলিফায় ঘুরতে যাওয়া বহুদিনের শখ, কিন্তু বর্তমানে আপনার যা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স তাতে দার্জিলিং ঘুরতে গেলেও ফেরার সময় আত্মীয়দের জন্য সোয়েটার কিনবেন কী না সেই নিয়ে দশবার ভাবতে হয়। তাই আপনি যদি জানতে পারেন যে বুর্জ খলিফা পৌঁছতে আপনাকে ফ্লাইটের নয় মেট্রো কিংবা বাসের টিকিট কাটলেই হবে, আপনি দৌড়বেন না? আর ঠিক এখানেই বাজিমাত করছে সমস্ত সর্বজনীন পুজো কমিটি।
এবছর শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের থিম হলো রোমের ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা গির্জা। ১০০ জনেরও বেশি কারিগর টানা আড়াই মাস ধরে পরিশ্রম করে, তিলেতিলে গড়ে তুলেছেন এই মণ্ডপটি। গতবছর এই শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবই কলকাতা শহরের বুকে বুর্জ খলিফা বানিয়ে চমকে দিয়েছিলো বঙ্গবাসীকে। বৃন্দাবনের প্রেম মন্দিরের আদলে গড়ে উঠছে এবছর কলেজ স্কোয়ারের পুজো মণ্ডপ। ওদিকে মহম্মদ আলি পার্কে তৈরি হচ্ছে রাজস্থানের শীশ মহল। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই স্বল্প খরচার ট্যুর প্যাকেজে অংশগ্রহণ করতে প্রথমা কিংবা দ্বিতীয়া থেকেই মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে এই মণ্ডপগুলোতে।
তবে শুধুমাত্র শহর কলকাতাই নয়, রাজ্যের অন্যান্য জেলাগুলিতেও এই হলিডে ডেস্টিনেশন থিমের হাওয়া ঢুকে পড়েছে। কোথাও তৈরি হচ্ছে আইফেল টাওয়ার, কোথাও তৈরি হচ্ছে আমেরিকার হোয়াইট হাউজ কোথাও বা আবার ফ্রান্সের একটা আস্ত জাদুঘরকেই নিখুঁত ভাবে গড়ে তুলছেন স্থানীয় শিল্পীরা। শিলিগুড়ির জাতীয় শক্তি সংঘ ও পাঠাগারের শিল্পীরা যেমন এবার ইউক্রেনের মেরিন স্কাই প্যালেসের আদলে তাঁদের মণ্ডপটিকে সাজিয়ে তুলছেন। কিছুদিন আগে মুক্তি পাওয়া আর.আর.আর ছায়াছবির "নাচো নাচো" গানটা মনে আছে? ওই গানে জুনিয়র এন.টি.আর ও রামচরণ যে প্রাসাদটির সামনে নাচছিলেন, সেটিও এই ইউক্রেনের স্কাই প্যালেসের অনুকরণেই তৈরি।
শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের শিল্পীরা না হয় গতবছর বুর্জ খলিফায় গিয়ে, সেখানে নিজেদের চোখে সবটা দেখে এসে তারপর মণ্ডপটা বানিয়েছিলেন। কিন্তু জেলার শিল্পীরা কীভাবে দেশে বসে বিদেশী স্থাপত্যের হুবহু অনুকরণ করছেন? কথা বলে জানতে পারলাম তাদের কাছে ভরসা বলতে একটাই। ইউটিউব। তারা ইউটিউবে ঘন্টার পর ঘন্টা বিভিন্ন ট্রাভেল ভ্লগারদের ভিডিও দেখেন। এই ভিডিওগুলোই তাঁদের ম্যাজিকের একমাত্র সরঞ্জাম।
তবে হঠাৎ কেন এতটা জনপ্রিয়তা লাভ করলো এই ধরণের থিম পুজোগুলো? বহরমপুরের রাধারঘাট বাবুজি ক্লাব পুজো কমিটির এক সদস্যের কথায়— "আমাদের এবছরের পুজোর থিম আমেরিকার ক্যাপিটাল হাউজ। এই এলাকার বড়জোর ১-২ শতাংশ মানুষের ক্যাপিটাল হাউজ সামনে থেকে দেখার সামর্থ্য রয়েছে। আমাদের ভাবনা বাকি ৯৮ শতাংশ মানুষের জন্য। তাঁরা যখন এই মণ্ডপে ঢুকবে, কিছুক্ষণের জন্য হলেও তাঁরা বিদেশ ভ্রমণের স্বাদ পাবে।"
ঠিক এই কারণেই এই ধরণের থিমপুজোর আজ এত রমরমা। অধিকাংশ বাঙালিরই সাধ থাকে দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর। কিন্তু অফিসের ছুটি ম্যানেজ করে, বাবার সুগারের ওষুধ কিনে, মায়ের ফিজিও থেরাপিস্টের সাম্মানিক দিয়ে, সন্তানের পড়াশোনার খরচ সামলে কখন যে সুইজারল্যান্ডের ট্রেনটা সিকিমের শেয়ার কারে বদলে যায়, তা বাঙালি নিজেই টের পায় না। আর ফ্লিপকার্ট কিংবা আমাজনে মাছের পাখনা পরিস্কার করার ব্রাশ থেকে সূর্যমুখী ফুলের পাপড় পাওয়া গেলেও, গুপী বাঘার জুতোটা তো আর পাওয়া যায় না। তাই যতই এই ধরণের থিম পুজোগুলোতে মহালয়ার পরের দিন থেকে উপচে পড়া ভিড় নিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় মিম, ট্রোল হোক না কেন, যতই সদ্য ইউরোপ ট্রিপ সেরে আসা ট্যাঁশ আত্মীয় এটাকে দুধের স্বাদ মিল্ক পাউডারে মেটানো বলুক না কেন, বাঙালি তো ভিড় জমাবেই। আর সেই ভিড়েই হয়তো নোয়াপাড়ার রিয়ার সাথে দেখা হয়ে যাবে বেহালার সঞ্জয়ের। ভিড় থেকে আলাদা হয়ে তারা একে অপরের ফোন নাম্বার নেবে। হোয়াটসঅ্যাপে লেট নাইট চ্যাট করতে করতে তারা একে অপরের প্রেমে পড়বে। বিয়ে করবে। আর বিয়ের কয়েকবছর পর এই রিয়াই সঞ্জয়ের উপর চিৎকার করতে করতে বলবে— "দেখো! মেজোমাসির ছেলে আর ছেলের বউ, বিয়ের ছ'মাসের মাথায় বার্লিন ঘুরতে চলে গেলো। আর আমরা? এই বেহালার বাইরে কোত্থাও যেতে পারলাম না আজ অবধি।" জীবন আসলে একটা বৃত্ত। কী বুঝলেন?
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।