নতুনত্ব: সরশুনায় তৈরি হচ্ছে দড়ি ও কাপড়ের দুর্গা। নিজস্বচিত্র।
করোনা-কালে দুর্গা পুজোয় মণ্ডপ নয়, শহরের পুজো কমিটি গুলির সেরা বাজি অভিনব প্রতিমা। কেউ মৃন্ময়ী প্রতিমার বদলে দোলনার কারিগর দের দিয়ে কাপড়ও দড়ির প্রতিমা তৈরি করাচ্ছেন।কেউ আবার খবরের কাগজ আর ম্যাগাজ়িনের পাতার কোলাজে তৈরি করছেন ত্রিমাত্রিক দুর্গা! বাজেটের ঘাটতি মেটাতে মাটির প্রতিমায় আবার রংই বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেউ।
সুরুচি সঙ্ঘের উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, এবার তাঁরা ‘মানুষেরপুজো’ করছেন। শিল্পী ভবতোষ সুতার তাই মহিলাদের দিয়ে দেবী মূর্তি তৈরি করতে উদ্যোগী। ভাবনা ভবতোষের স্ত্রী মল্লিকা দাস সুতারের। ভবতোষের কথায়,“দুর্গার হাতেই এবার আমাদের দুর্গা রূপ পাচ্ছে।সরশুনার কাছে শিল্পীদের আবাসস্থল ‘চাঁদেরহাট’-এর আশপাশে থাকা মহিলারাই দড়ি, কাপড়ের টুকরো দিয়ে প্রতিমা গড়ছেন।মুখ, হাত-পা ছাড়া প্রতিমার কিছুই মাটির নয়।”
‘চাঁদেরহাট’- এগিয়ে দেখা গেলন মিতা ঘড়াই, শিউলি দাস, অন্নপূর্ণা মণ্ডল, অণিমা দলুইয়ের মতো দোলনার কারিগরেরা একের পর এক দড়িতে গিঁট দিয়ে চলেছেন।প্রতিমা তৈরির কাঁচামাল হিসেবে দড়ি ছাড়া ও রয়েছে সাদা কাপড়, লাল শালুর ব্লাউজ আর গামছা। আশপাশের দর্জির দোকান থেকে আনা হয়েছে কাপড়ের টুকরোও, যা দিয়ে তৈরি ছোট ছোট পুতুল লাগানো হবে চালচিত্রের নীচে।কাজ করতে করতেই এক মহিলা বললেন, “চালচিত্র কী দিয়ে হয়েছে জানেন? শিউলি একদিন একটা শাড়ি পরে এসেছিল।দাদা পরের দিনও ই শাড়িটাই ধুয়ে রাখা আছে কিনা জানতে চাইলেন। এরপরে সেটা দিয়েই তৈরি হল চালচিত্র।” ভবতোষ বল ছিলেন, “এই মেয়েরা অন্য সময়ে বাড়িতে বসে দড়ি বা পাটের দোলনা তৈরি করেন। এঁরা দড়িতে ভাল গিঁট দিতে পারেন। তাই এভাবে প্রতিমা বানানোর ভাবনা মাথায় এসেছিল। মানুষের পুজো এরকমই হওয়া উচিত।”
আরও পড়ুন: পড়ার ফাঁকে পাড়ার ঠাকুর গড়ছে হেতমপুরের শুভম
প্রতিকূলতার পুজোয় হাতিবাগান সর্বজনীনের প্রতিমা হচ্ছে খবরের কাগজ আর ম্যাগাজ়িনের পাতা দিয়ে। শিল্পী সঞ্জীব সাহা বললেন, “এবার কম খরচের পুজো। তবে টাকা নেই বলে তো শিল্পের সঙ্গে আপস করা যায় না। তাই কম দামের পুরনো ম্যাগাজ়িন আর খবরের কাগজ দিয়েই তৈরি করছি ত্রিমাত্রিক দুর্গা। দেখে মাটির প্রতিমা বলে মনে হলেও তাতে একটুও মাটি নেই।”
উত্তর কলকাতার টালা বারোয়ারির এবছর শতবর্ষের পুজো। শিল্পী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “উপর থেকে নীচে ধাপে ধাপে প্রতিমার অংশ নেমে আসবে।১২ ফুট প্রতিমার নীচে সিংহ, অসুর মিলিয়ে আরও চার ফুটের কাজ থাকছে।শেষে গোটা ব্যাপারটা দু’ফুটের কাঠামোয় এমন ভাবে ধরা থাকবে যে, দেখে মনে হবে, ১৮ ফুটের প্রতিমা শূন্যে ঝুলছে।” বড়িশা সর্বজনীনের শিল্পী দেবাশিস বাড়ুই বললেন, “আমাদের এবারের বিশেষত্ব অসুর। মাটি ফুঁড়ে তার উঠে আসা এবং দেবীর তাকে দমনের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে।”
কাগজের দুর্গা। নিজস্বচিত্র।
কুমোরটুলি সর্বজনীনে অবশ্য এবার থাকছে না অসুর, মহিষ, অস্ত্রের মতো কোনও কিছুই। দশ নয়, দুর্গার সেখানে দু’টি হাত। সেই পুজোর উদ্যোক্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য বললেন, “এবছর অভয়া মূর্তি করেছি। এই প্রথমবার আমাদের প্রতিমার দু’টি হাত হবে। অসুর রাখিনি কারণ মানুষ নাকি করোনা— কাকে অসুর দেখাব ভেবে পাইনি!” জগৎ মুখার্জি পার্কে আবার থাকছে করোনাসুর। তার গায়ে রাখা হচ্ছে করোনা ভাইরাসের গায়ের প্রোটিনের আস্তরণ।
আরও পড়ুন: প্রকৃতির কোলে পশু পাখি চেনাই মানুষকে, সেই তো আমার পুজোর আনন্দ
আর বাগবাজারের প্রতিমা? পুজোর উদ্যোক্তা গৌতম নিয়োগী বললেন, “করোনার জন্য কোনও বদল হচ্ছেনা। সেই চোখ জুড়ানো সাবেক প্রতিমা এবারও।” উদ্যোক্তা দের দাবি, এই করোনা পরিস্থিতিতেও পুরনো প্রতিমায় যে কোনও বদল হচ্ছেনা, সেটাও কি কম অভিনব!
তবে অভিনবত্বের বিচারে হয়তো শেষ পর্যন্ত সকলকে টেক্কা দেবে উত্তর কলকাতার নলিন সরকার স্ট্রিটের প্রতিমা। সাত ফুটের প্রতিমায় রং না করার সিদ্ধান্তই নিয়েছে এই পুজো কমিটি। অন্যতম উদ্যোক্তা সঞ্জু সাহা বললেন, “পরিস্থিতি বোঝাতেই এই সিদ্ধান্ত। অর্থা ভাবে আমাদের মূর্তি রং করারও টাকা নেই।”