Anada Utsav 2019

হারিয়ে গেল শহরের সেই পুজোর দর্জিরা

খদ্দের হারাতে হারাতে দর্জির দোকানগুলো নিজেরাই হারিয়ে যেতে শুরু করল।

Advertisement

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৪:৪৬
Share:

ছোটবেলায় দেখতাম, স্বাধীনতা দিবস পেরিয়ে গেলেই টেলারিং শপ-এর সেলাইদাদা/সেলাইকাকুদের বডি ল্যাঙ্গোয়েজ বদলে যেত। যিনি এমনি সময় শার্ট বা হাফপ্যান্ট করতে দিতে গেলে মাপ নিতে নিতে, ‘কী খোকা, কোন ক্লাসে পড়?’ গোছের প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন, তিনিই যখন সেপ্টেম্বরের দু’তারিখে কাঁধের ওপর গোলাপি টেপফিতেটি ফেলছেন, তখন আর চিনতেই পারছেন না! এটার কারণ আর কিছুই নয়, পুজোর জামা তৈরির ব্যস্ততা।

Advertisement

একটু সাব্যস্ত হওয়ার পর কোনও বার যখন সেপ্টেম্বরের শেষ বা অক্টোবরের একদম শুরুর দিকে জামা বানাতে গিয়েছি, তখন শুনেছি, না, এখন আর হাত খালি নেই। এই শুনে প্রচুর ঘ্যানঘ্যান, প্রচুর অনুনয়-বিনয়ের পর মুখটা চিরতা চিবনোর মতো করে তিনিই হয়তো বলেছেন, বেশ। করে দেব। ডেলিভারি পাবে অষ্টমীর দিন বিকেলবেলায়! চলবে? আমিও তখন আর উপায় না দেখে তাতেই রাজি হয়ে গিয়েছি। কারণ অষ্টমীর দিন সন্ধেবেলাতেই তো পুজোর সেরা জামাপ্যান্টটা পরার নিয়ম। সেটা তো অন্তত হচ্ছে!

পুজোর আগে এই দোকানগুলোর আরও একটা বৈশিষ্ট্য আমার চোখে পড়ত। সেটা হল, দোকানে লাগানো আলোর উজ্জ্বলতা ধাঁ করে বেড়ে যাওয়া। তখন ডিসি কারেন্ট। টিউবলাইটেরও তেমন চল হয়নি। ষাট ওয়াটের একখানা করে বাল্বই ছিল দোকানগুলোর ভরসা। পুজোর সিজনে ওই বাল্বের পাওয়ার হুস করে ষাট থেকে একশোয় উঠে যেত। যে দোকানটা গেল হপ্তাতেও সন্ধে সাড়ে সাতটায় টিমটিম করছিল, সেটাই হঠাৎ এ-হপ্তায় ঝকঝক করছে, এটা কিন্তু সবারই চোখে পড়ত।

Advertisement

আরও পড়ুন:রামধনু-গরিমায় ভরা আদি বালিগঞ্জ সর্বজনীনের পুজো মণ্ডপ​

আমাদের ছেলেবেলায় কলকাতার পাড়াগুলোয় মোটামুটি তিন ধরনের দর্জির দোকান দেখা যেত। কিছু দোকান ছিল একদম ছোটখাটো। কোনওমতে এক জন মানুষই সেখানে বসতে পারত। পায়ে-চালানো একটা সেলাইমেশিন আর তার পিছনে একখানা কালচে কাঠের চেয়ার, এই ছিল তার সম্বল। এমন দোকানের কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে ভবানীপুরে হরিশ পার্কের ঠিক উল্টো ফুটে বটগাছ লাগোয়া একফালি দোকানটির কথা। সেখানে যিনি বসতেন তাঁর নাম ছিল অতীশবাবু। ছোটখাটো অল্টার, বোতাম বসানো, লুঙ্গি বা পর্দা সেলাই— এমন সব কাজ ওখানে হত। দেখা হলে, আমার বাবার সঙ্গে উনি গান নিয়ে একটি-দু’টি কথা বলতেন। স্কুলে যাওয়ার পথে অতীশবাবুর দোকানে মারফি রেডিয়ো চলতে দেখেছি।

অতীশবাবুর দোকানের চেয়ে সামান্য বড় মাপের দোকান যেগুলো, তাতে পা-মেশিন এবং চেয়ারের সঙ্গে, দোকানের সামনের দিকে একখানা কাঠের টেবিল দেখতে পাওয়া যেত। টেবিলের ওপরের কাঠটির এক দিকের প্রস্থ বরাবর, কব্জা দিয়ে একটি সমান মাপের তক্তা ফিট করা থাকত, যার দেয়ালের দিকের শেষ প্রান্তটি তুলে ধরলে দোকানের ভেতরের মানুষ বাইরে বেরিয়ে যেতে পারত। আবার কেউ জামার মাপ দিতে এলে ওই তক্তাটি তুলে, তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে মাপটাপ নিয়ে, আবার একই ভাবে বাইরে বের করে দেওয়া হত। আমার কাছে এই তক্তা তুলে ঢোকা-বেরনোটা ছিল বেশ রোমহর্ষক একটা ব্যাপার।

সাবার্বান স্কুল রোডের ওপর, ‘সংঘমিত্র’ ক্লাবের পাশে ওই একই ফুটপাতে, এই রকমই একটি দোকানের নাম ছিল ‘দাস টেলরস্‌’। একবার, মাপ দেব বলে দোকানের ভেতরে ঢুকে দেখি, টেবিলের পিছনে একটা ছাইরঙা বেড়াল চুপ করে ঘুমিয়ে রয়েছে। আর এক বার আবিষ্কার করেছিলাম পেতলের একটা বিশাল কাঁচি। আমার মায়ের কাছে আইবুড়োবেলার একটা বড়সড় সেলাইয়ের কাঁচি আছে, কিন্তু সেটা এই পেতলের কাঁচিটার কাছে কিস্যু না। ‘দাস টেলার্স’-এর আসল দর্জি ছিলেন ধুতি, হাফহাতা সাদা গেঞ্জি আর গলায় তুলসীকাঠের মালা জড়ানো এক জন ছিপছিপে লম্বা ষাট-পেরনো মানুষ, যাঁর গলায় আর কপালে চন্দনের ফোঁটাও কাটা থাকত। মনে আছে, উনি খুব নিচু গলায় কথা বলতেন। অনেক পরে জেনেছিলাম উনিই ছিলেন দোকানটির মালিক। ওঁর হেল্পার ছিল বড় ঘেরের পায়জামা আর ঢোলা হাফশার্ট পরা একটি ছেলে, যাকে দেখে আমার কেন জানি না মনে হত, এর নাম নিশ্চয়ই তকাই! তকাই মাঝে মাঝে একটা মাটির কুঁজো নিয়ে পাশের টিউবওয়েলে জল আনতে যেত। দাস টেলার্স কাপড় জমা নিয়ে যে গোলাপি কাগজটি ফেরত দিত, তাতে যে ডেলিভারি ডেট লেখা থাকত সেটা যে জীবনেও মিলবে না, এটা আমাদের পাড়ার সকলেই কমবেশি জানত। তাই আসা যাওয়ার পথে সবাই টুকটাক তাগাদাও দিত। ‘দাস টেলার্স’-এ জামা করতে দিয়ে হয়তো বলেছি দু’পাশে দুটো ফ্ল্যাপওয়ালা বুকপকেট করে দিতে হবে, অমনি তকাই একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলত, ‘পুজোর সময় এগুলো বললে কিন্তু ভারি মুশকিল হয়! যখন ফাঁকা থাকি, তখন এই বায়নাগুলো করলে দুটোর জায়গায় পাঁচটা পকেট বানিয়ে দেওয়াটাও কোনও ব্যাপার নয়! তারপর আমার করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে একটু পজ দিয়ে বলত, আচ্ছা দেখি, কতটা কী করতে পারি!’

আরও পড়ুন:উমার প্রতীক্ষায় সেজে উঠছে গোটা শহর

‘দাস টেলার্স’-এর থেকে একটু বড় মাপের দোকান যেগুলো, সেখানে একের বেশি সেলাই মেশিন থাকত। কর্মচারীও থাকত একাধিক। আর দোকানের পিছন দিকে আড়াআড়ি খাটিয়ে রাখা দড়িতে, পাশাপাশি হ্যাঙারে তৈরি হওয়া শার্ট-প্যান্ট পরপর ঝুলিয়ে রাখা থাকত। এমন দোকানের কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে গঙ্গাপ্রসাদ মুখার্জি রোড আর গিরিশ মুখার্জি রোডের ক্রসিং-এ ‘গিরীন স্টোর্স’। আমাদের বেশিরভাগ জামাকাপড় তখন এই গিরীন স্টোর্স থেকেই বানানো হত। ‘দাস টেলার্স’-এর ওই তুলসীকাঠের মালা পরা ভদ্রলোকই যে আসলে দাসবাবু, এটা বোঝার মতো বুদ্ধি তখনও আমার তৈরি হয়নি। কিন্তু দোকানের ওপরের হোর্ডিংয়ে লেখা ‘গিরীন স্টোর্স’, আর সবাই ওই ভদ্রলোককে ‘গিরীনদা’ বলে ডাকছে, এটা আমার কাছে একটা দুর্দান্ত ব্যাপার ছিল।

পরে, বুদ্ধি পাকলে এক বার এর চেয়েও বেশি চমকেছিলাম নিজের নামাঙ্কিত মঞ্চ ‘যোগেশ মাইম’-এ শ্রদ্ধেয় যোগেশ দত্তকে মূকাভিনয় পরিবেশন করতে দেখে। তো সে যাই হোক, গিরীনবাবু ছিলেন বেঁটেখাটো, গাট্টাগোট্টা, ব্যাকব্রাশ করা চুল এবং পরিষ্কার করে কামানো মুখের এক জন মানুষ। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের প্রথম দিকের ছাত্র তবলিয়া কানাই দত্তের সঙ্গে তাঁর মুখের আশ্চর্য মিল ছিল। ইনি সবসময় নিজের হাফহাতা শার্টটি প্যান্টের ভেতর গুঁজে পরতেন এবং মাঝে মাঝে নস্যি নিতেন। কারও মাপ নেওয়ার হলে, ভেতরে নয়, দোকানের বাইরে বেরিয়ে এসে মাপ নিতেন। তাঁর দোকানে বানানো যে কোনও শার্টের কলার এবং প্যান্টের কোমরের ভেতর দিকে ইংরিজিতে ‘গিরীন’ কথাটি মনোগ্রাম করা থাকত। পুজোর সময় জামাকাপড় বানাতে দিতে গিয়ে আমি ওঁর মুখেই প্রথম ‘হেব্বি-চাপ’, এই আশ্চর্য শব্দবন্ধটি শুনি এবং বাড়ির গুরুজনদের কাছে এর মানে জেনে নিতে আগ্রহী হই।

গিরীন স্টোর্সের খুব কাছে আরও দুটি পুরনো টেলারিং শপ ছিল পূর্ণ সিনেমার এপারে আর ওপারে। ওপারেরটি ছিল ‘ঘড়ি মোড়’-এ যে গাড়িবারান্দাটি আছে, তার গায়ে। নাম ছিল ‘দত্ত ব্রাদার্স’। এর মালিক ছিলেন আকাশি বাংলাশার্ট আর মালকোঁচা মেরে ধুতি-পরা মাখন দত্ত। বাড়িতে গল্প শুনেছি, আমার বাবার বিয়ের পাঞ্জাবি এই দোকানটি থেকেই বানানো হয়েছিল। আর মাখনবাবু, পাঞ্জাবির টেরিকট কাপড়কে পপলিন বলে ভুল করে একটি ছোটখাটো হ্যাঙ্গাম বাঁধিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয়টি, মানে পূর্ণ সিনেমার দিকের দোকানটি ছিল তার একই ফুটপাতে, হাজরা মোড়ের দিকে যেতে ঠিক দুটি বাড়ি পরে। এর নাম ছিল ‘ইন্দিরা’।

এখানেই সাতের দশকের শুরুতে কর্মচারী হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন মহম্মদ হানিফ ওরফে মাস্টারদা নামের সেই অসামান্য টেলর-মাস্টার, যিনি পরে চক্রবেড়িয়ায় ‘থিয়েটার সেন্টার’-এর ঠিক উল্টো দিকে ‘এ-ওয়ান-টেলর’ নাম দিয়ে একটি নিজস্ব দোকান খুলেছিলেন। মাস্টারদা শার্ট-প্যান্ট তো বটেই, থ্রি-পিস স্যুট এবং সাফারি স্যুট বানাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আমার ছোড়দার বিয়ের স্যুট ওঁরই হাতে বানানো। নিজে খুব টিপটপ থাকতেন। স্টিল গ্রে কালারের সাফারিতেই ওঁকে বেশি দেখা যেত। কাজ করার সময় যার ওপরের অংশটি খুলে, দোকানের দেওয়ালে গাঁথা একটি পেরেকে ঝুলিয়ে রাখতেন। আর কাপড় কাটবার সময় ঠোঁটে ঝুলত সিগারেট। শেষের দিকে অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে মাস্টারদার ডান হাতটি থিরথির করে কাঁপত। কাটিং-এর মাপও ভুল হয়ে যেত। এই নিয়ে টুকটাক সমস্যাও তৈরি হত খদ্দেরের সঙ্গে। তবু উনি কাজ পেতেন। কিন্তু নয়ের দশকের মাঝামাঝি এসে ‘এ-ওয়ান টেলর’ও বন্ধ হয়ে গেল। এই দোকানটির আভিজাত্য ছিল কাচের তৈরি টানা শো-কেস। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই শো-কেসের মধ্যে তৈরি হওয়া স্যুটগুলো গা ঘেঁষাঘেষি করে ঝুলছে। কথা বলছে নিজেদের মধ্যে।

কলকাতার পাড়াগুলো থেকে যে সব পুরনো দর্জির দোকান উঠে গিয়েছে, তাদের জায়গায় নতুন কোনও টেলারিং শপ আর কিন্তু তৈরি হতে দেখিনি। এর কারণ হয়তো নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে রেডিমেড ড্রেসের রমরমা এবং গেরস্ত বাঙালির শপিং মল-এ গিয়ে জামাকাপড় কেনার নতুন স্বাদ পাওয়া। মধ্যবিত্ত মানুষের হাতে আগে কম টাকা থাকত। ফলে তারা পুজোয়, ঈদে বা পয়লা বৈশাখে উপহার পাওয়া কাপড়ের পিস দর্জির দোকানে দিয়ে, শুধু মজুরিটুকু খরচ করেই একটা আস্ত জামা বা প্যান্ট পেয়ে যেত। কিন্তু উপহার হিসেবে পাওয়া বলে, সেখানে কাপড় পছন্দ করার বিষয়টা বেশির ভাগ সময়েই তার নিজের হাতে থাকত না।

মুক্ত অর্থনীতির ফলে মধ্যবিত্ত গেরস্তর হাতেও যখন বেশি বেশি অর্থ আসা শুরু হল, তখন সে দেখল, দর্জির মজুরির চেয়ে সামান্য বেশি টাকা খরচ করলেই এক লহমায় মনের মতো তৈরি-পোশাক পেয়ে যাচ্ছে। ঝলমলে বিজ্ঞাপন তাকে একটি জামার সঙ্গে আর একটি জামা বিনামূল্যে পাওয়ার টোপ যত্ন করে গেলাল। বিশ্বায়নের ছক তাকে বোঝাল, টেলর-মেড জামা কোনও দিনই ব্র্যান্ডেড রেডিমেড জামার ফিনিশের ধারেকাছে আসতে পারবে না। ফলে খুচরো মেরামতির দরকার ছাড়া সে পাড়ার দর্জির দোকানে ঢোকা বন্ধই করে দিল। স্কুলের ইউনিফর্ম তৈরি করার কনট্র্যাক্ট নিতে শুরু করল কাপড় সাপ্লাই করার বড় বড় দোকান। বাচ্চার গার্জেনরা বইপত্রের সঙ্গে সন্তানের ইউনিফর্মও স্কুল থেকেই কিনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেল।

একটা সময় দেখা গেল, দর্জির দোকানগুলিতে প্রধানত নিম্নবিত্তরাই যাচ্ছে। কিন্তু সেই যাওয়াটাও আর খুব নিয়মিত রইল না। বছরের পর বছর এই ভাবে একটি একটি করে খদ্দের হারাতে হারাতে পুরনো দর্জির দোকানগুলো নিজেরাই একসময় হারিয়ে যেতে শুরু করল। রিটেল কাপড়ের দোকানে জামাকাপড়ের থানের গায়ে জমতে শুরু করল ধূসররঙা ধুলো। সেগুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করার হাসিমুখের কর্মচারীরাও হারিয়ে যেতে শুরু করল এই আশ্চর্য শহরের বুক থেকে। অথচ প্রতি বছর নীল আকাশ আসে, সাদা মেঘ আসে, কাশফুল আসে, দুর্গাপুজো আসে...।

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement