Durga Puja 2019

আমার পাঁচমেশালি পুজো পরিক্রমায় কত মায়াময় মন্তাজ

হ্যাজাকের আলোয় রাত্রি হারিয়ে গেছে। ঢাক বাজছে। সারি সারি প্রতিমার ভিড়ে হঠাৎ দেখলাম দীপ্তিবৌদিকে।

Advertisement

শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৯ ২০:১৬
Share:

আমার বন্ধু গোপাল। মোটেই সুবোধ বালক ছিল না সে, আমি বলতাম, ‘গোপাল অতি দুর্বোধ বালক’! আমি যখন ওর ‘সহপাঠী’ হলাম, তখন তার সেই ক্লাসে দুই বছর পার! আমি যখন সেই ক্লাস থেকে পাশ করে বেরিয়ে যাচ্ছি, গোপাল তখন আমাকে বলল, ‘তুই এগো, আমি আর একটু থেকে যাই’! আমি তো এগিয়ে একেবারে স্কুল পেরিয়ে কলেজে চলে গেলাম, কিন্তু গোপাল আর স্কুল ছাড়ে না। স্কুলও ওকে ছাড়ে না। আমাদের ওই আগমার্কা স্কুলে যে গোপালের অমন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়েছিল, সেটা অবশ্য ওর মাথার জন্য নয়, ওর পায়ের জন্য। সেই সময়ে মাঝমাঠের ফুটবলার হিসাবে জেলায় সেরা ছিল সে। ওর বাবা ছিল সম্পন্ন ব্যবসায়ী। কিন্তু গোপালের ‘ব্যবসা’ বলতে ময়দানের ফুটবল খেলা। আর তা দেখেই আমাদের পাড়ার পরমা প্রেমে পড়ল গোপালের।

Advertisement

সে বার মহালয়ার মাঝরাতে, ‘বীরেন ভদ্দর’ যখন শুরু হব হব করছে, তখন গোপাল আমাকে বলল, ‘মেরে দে’! বলেই ‘গেলাসে দিল ঢেলে, দশরথের বড় ছেলে’! গোপাল বলত, ‘ভগবান আর মদকে এক নামে ডাকলে পাপ হবে’! তাই সে তরল রামের নাম দিয়েছিল ‘দশরথের বড় ছেলে’! তা সেই রামনাম জপতে জপতে আমি এক পাত্তর চড়িয়েছি কি চড়াইনি, গোপাল ঘোষণা করল, ‘পরমাকে বিয়ে করব! পুজোয় চাই নতুন বউ’! পরদিন সকালে ‘মহালয়ার প্রভাতফেরিতে যাচ্ছি’ বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরমা বৃন্দাবনী মাঠে চলে এল। গোপাল ওকে বুড়োকালীর মন্দিরে নিয়ে গিয়ে সিঁদুর পরিয়ে, রেখে এল সামসি গ্রামে, নিজের মাসির বাড়িতে। ফিরতি বাসে শহরে এসে গোপাল আমার বাড়িতে হাজির। আর ঠিক তখনই পরমার বাবা-দাদা আমার বাড়ি বয়ে এসে জানতে চাইল, ‘মেয়েটা কোথায় যেতে পারে বল তো বাবা’! আমি আর গোপাল চিন্তিত মুখে ওদের সঙ্গে পরমাকে খুঁজতে বেরলাম, ‘সত্যিই তো, পাড়ার মেয়ে যাবেটা কোথায়’!

পুজো চুকল। বিজয়ার সকালে আমি সামসি গেলাম পরমা-গোপাল কেমন আছে দেখতে। পরমার মুখটা খুব মলিন লাগল। আমার হাত ধরে সে বলল, ‘বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে রে! মেয়েদের কাছে বাপের বাড়িটা যে কী, সেটা এখন বুঝছি’! সেই প্রথম দেখলাম, দাপুটে খেলোয়াড় গোপালের মুখটা কেমন যেন কাঁদো কাঁদো। বাড়ি ফিরে পরদিন সকালে ‘বিজয়া’ করতে গেলাম পরমাদের বাড়িতে, মাসিমা বেরিয়ে এলেন, প্রণাম করলাম। মাসিমা বললেন, ‘এ বার আমাদের আর পুজো নেই রে বাবা। ঘরের দুগগাটাই নেই’! মাসিমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মাইকেলের সেই কবিতাটা মনে পড়ল, ‘নবমীর নিশা শেষে গিরীশের রানি’! আমার মাথাটা আপনা আপনি নিচু হয়ে এল। এই বিসর্জনের গল্পের কিছুটা দায় আমারও। মাসিমা, ক্ষমা চাইছি!

Advertisement

পরমাদের বাড়ির পরের বাড়িটাই ছিল আমার বন্ধু বাবনের। আমরা দুইজনেই তখন দ্বাদশশ্রেণি। বাবনদের পাশের বাড়িটাই দীপ্তিবৌদিদের। এই দুই বাড়ির দুই জানলা ছিল মুখোমুখি। আর ছিল আমাদের দুই বন্ধুর স্কুলছুটির কয়েকটা দুপুর। ঠিক তখন ওপারের জানলায় এসে দাঁড়াত দীপ্তিবৌদি। আর অমনি আমরা যেন শীতের বেলার রোদপোহানোর আরাম পেতাম। কত শত গল্প হত আমাদের। এমন গানের মতো করে কথা বলত দীপ্তিবৌদি যে, শুনে মনে হত স্মৃতির সেতারে কোমলগান্ধার বাজছে! কখনও দীপ্তিবৌদির মুখে খেলা করত সোনারোদ্দুর। কখনও বাবনদের বাড়ির জামরুল গাছটার ছায়া পড়ত দীপ্তিবৌদির চিবুকে। কখনও দীপ্তিবৌদির সিঁথিতে থমকে যেত সিঁদুরেমেঘ। সেই মেঘে বৃষ্টি হত। দুই গাল বেয়ে নামার আগেই সেই বর্ষা মুছে নিত দীপ্তিবৌদির শাড়ির আঁচল।

দীপ্তিবৌদির ছেলেমেয়ে ছিল না। তা নিয়ে হতাশার অন্ত ছিল না ওর বর বিলুদার। কাজেই তার ছিল দুই নেশা, অন্দরে মদ আর বাহিরে তাস। এবং অবধারিত ভাবে, তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, ছেলেমেয়ে না হওয়াটা দীপ্তিবৌদির দোষ। কারও কোনও দিন সাহসই হল না বিলুদাকে এটা বলতে যে, ‘এই, চল দেখি ডাক্তারের কাছে, দেখা যাক দোষটা আসলে কার’! দীপ্তিবৌদি আর কী করে! ওই জানলাটুকু ছাড়া তার তো আর কিছুই ছিল না। ওই দুই জানলায় আমাদের বেশির ভাগ গল্পই হত সিনেমা নিয়ে। দীপ্তিবৌদি আমাকে বলত, ‘সিনেমা তোর খুব প্রিয়, তাই না’? আমি বলতাম, ‘হ্যাঁ, আর তোমার কী প্রিয়’? দীপ্তিবৌদি বলত, ‘মুক্তি, এই আকাশে আমার মুক্তি’! সেই কৈশোরে আমার খুব সিনেমা বানানোর শখ ছিল। ভেবেছিলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অতসীমামি’ নিয়ে একটা ছবি বানাবো, নামভূমিকায় দীপ্তিবৌদি।

হল না। একটা বিজয়া দশমী সব কিছু ওলটপালট করে দিল। সে দিন বিসর্জন, মহনন্দার ঘাটে। হ্যাজাকের আলোয় রাত্রি হারিয়ে গেছে। ঢাক বাজছে। সারি সারি প্রতিমার ভিড়ে হঠাৎ দেখলাম দীপ্তিবৌদিকে। ওকে কেমন ঝাপসা লাগছে। ধূপের ধোঁয়ায় আবছা চারিদিক। সেই শেষ। আমাদের স্কুলছুটির দুপুর শেষ। দুই জানলার গল্প শেষ। দীপ্তিবৌদিকে আর কোনওদিনও খুঁজে পাওয়া গেল না, কোথাও না। চিলেকোঠার কড়িবরগায় না, রেললাইনের ধারে না, লাশকাটা ঘরে না, মহনন্দার অশ্রুনদীর জলে না! দীপ্তিবৌদি মুক্তি চেয়েছিল! বিসর্জন কি মুক্তিরই নামান্তর!

সেই বিসর্জনের রাতের পর থেকে বেশ কয়েক দিন দীপ্তিবৌদিদের বাড়ির রাস্তার দিকের বারান্দা থেকে সরানো যায়নি টুনিপিসিকে। আমার মায়ের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব ছিল তার। মা গিয়ে কত বার বলল, ‘এইবারটি নিজের বাড়ি ফিরে যাও তো দিদি!’ জবাবে টুনিপিসি বলেছিল, ‘কী যে বল ভাই, ঘরের বউটা যদি রাতেবিরেতে বাড়ি ফেরে তা হলে দুয়ারটা খুলে দেবে কে!’ টুনিপিসিরা থাকত আমাদের পাড়ার দুর্গাবাড়ির পাশে। টুনিপিসির দুই ছেলে, শিমূল আর পলাশ। দুইজনেই নামকরা ছাত্র ছিল। শিমূলদা প্রেসিডেন্সিতে পড়তে গিয়েছিল। এক রাতে হিন্দু হস্টেলে হানা দিয়েছিল পুলিশ। ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’ বলতে বলতে একটা কালো প্রিজন ভ্যানে উঠেছিল শিমূলদা। সেই থেকে সে দীপ্তিবৌদির মতো ‘নিরুদ্দেশ’! এর পর থেকে টুনিপিসি এলোচুলে, অগোছালো শাড়িতে, খালি পায়ে পাড়ার এ গলি সে গলিতে ঘুরে বেড়াত সারাদিন, আর সদ্য যুবক কাউকে দেখলেই তার কাছে গিয়ে বলত, ‘মা বলে ডাকবি, মা বলে ডাকবি!’

পলাশদাকে চোখে হারাতো টুনিপিসি। বুঝদার ছেলে ছিল পলাশদা। শিবপুর বি ই কলেজে চান্স পেল সে। গেল না। মালদা কলেজে কেমিস্ট্রি নিয়ে ভর্তি হল নাম-কা-ওয়াস্তে। তুখোড় অল রাউন্ডার ছিল পলাশদা। ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিল। তার ওই এক কথা, মাকে কে দেখবে। টুনিপিসিকে সময় দেওয়ার জন্য গিটার বাজানোও ছেড়ে দিল পলাশদা। অথচ বাবনদের বাড়ির ছাদে কনে দেখা আলোয় বসে পলাশদা মাঝেমধ্যে মহীনের ঘোড়াগুলি গাইত, ‘তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে, আরও দূরে, তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে!’ বাবনের ছোড়দি, বানীদি, মোটেও সরত না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো কার্নিশে জড়ানো সেই পুষ্পিতা অপরাজিতা গাছের আড়ালে।

এ ভাবে কত মাস, কত বর্ষ, কত মন্বন্তর! অবশেষে ‘হাজার কথার মরণ হলে হৃদয় কথা বলে’! সে দিন মহাদশমী, বৃষ্টির বিকেল, চিলেকোঠার শেডের নীচে দাঁড়িয়ে, পলাশদার মুখপানে অপলক চেয়ে বাণীদি বলল, ‘তুমি কিছু বোঝো না’! প্রেম এমনই মহত্তর যে, তার সামনে মাথা নত হয়ে আসে। বাণীদির প্রশ্নের জবাবে মাথা নিচু করে, পলাশদা বিড়বিড় করে বলল, ‘মাকে কে দেখবে’! এর পর সব চুপচাপ। ছাদ জুড়ে শুধু বৃষ্টির টাপুর টুপুর। বাণীদি আর পলাশদা কি খুব কেঁদেছিল সে দিন! কে জানে! বৃষ্টি হলে অশ্রুকে আর আলাদা করে চেনাই যায় না। যেমন কখনও কখনও আলাদা করে বোঝাই যায় না যে, কোনটা আবাহন আর কোনটা বিসর্জন।

পলাশদাই তো বোঝেনি। বাণীদি বুঝেছিল। বাণীদি বুঝেছিল, প্রেমিকের চেয়ে অনেক অনেক ঊর্ধ্বে হল অবদর্শ প্রেম। পলাশদার জন্য এই আহত প্রেমটুকু বাণীদির অন্তরের অথৈ সাগরে মুক্তোগর্ভা ঝিনুক হয়ে শুয়ে রইল চিরকাল। ছেঁড়া তমসুকের মতো পরিত্যক্ত হয়ে গেল বাবনদের বাড়ির ছাদটা। পলাশদা চলে গেল। আর ফিরবে না কোনও দিন। এই সময় রবি ঠাকুরের গান গাইতে হয়। বাণীদি গাইল, ‘এই করেছ ভাল, নিঠুর হে...’!

এই আমার পাঁচমেশালি পুজো পরিক্রমা। তার আবাহনের অন্তরালে লুকিয়ে থাকে কত বিরহবিধুর ‘শুভ বিজয়া’। আবার তার বিসর্জনের অবগুণ্ঠনে ঢাকা থাকে কত মিলনের মধুরিমা। আমাদের পাড়ার রঘুজেঠুর মনিহারি দোকানের মতো, মৃন্ময়ী মাতৃমূর্তির দশভূজে সাজানো থাকে কত দুঃখ, কত সুখ, কত প্রেম, কত প্রত্যাখ্যান, কত করুণ কোলাজ, কত মায়াময় মন্তাজ। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি।

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement