দেবদেবীদের রূপ বদল নিয়ে আছে নানা পৌরাণিক কাহিনি। কিছু জানা, কিছু অজানা। কিন্তু স্বয়ং কৃষ্ণ যে এক বার কালীর রূপ ধারণ করেছিলেন, সে গল্প শুনেছেন আগে? কালীপুজোর প্রাক্কালে জেনে নেওয়া যাক সেই প্রাচীন লোককাহিনি।
জটিলা এবং কুটিলা ছিলেন রাধারানির স্বামী আয়ান ঘোষের মা ও বোন। তাঁরা সর্বদা রাধার থেকে কৃষ্ণকে দূরে রাখার চেষ্টা করতেন। কখনও কৃষ্ণকে শাস্তি দিতেন, কখনও বা নানা খারাপ নামে ডাকতেন তাঁকে।
এক দিন আয়ান ঘোষ হাটে গেলেন গরু কিনতে। একটি সুন্দর গরু বাছাই করে বিকেলের মধ্যে তা কেনার জন্য কিছু মুদ্রা নিতে ঘরে ফিরে এলেন। ইতিমধ্যে তাঁর অনুপস্থিতিতে কৃষ্ণ গুজব ছড়িয়েছিলেন যে, তিনি রাধারানিকে দেখতে আয়ান ঘোষের ছদ্মবেশে আসতে চলেছেন। জটিলা ও কুটিলা এ কথা শুনে গ্রামের প্রবেশপথে লাঠি নিয়ে প্রস্তুত হয়ে রইলেন। তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে ছদ্মবেশী কৃষ্ণ যেন রাধার দিকে এক মুহূর্তও তাকাতে না পারেন।
তাই আয়ান ঘোষ আসার সঙ্গে সঙ্গে জটিলা এবং কুটিলা তাঁকে ছদ্মবেশী কৃষ্ণ ভেবে বার করে দিতে উদ্যত হন। আয়ান ঘোষ যতই বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, তিনি গরু কেনার জন্য কিছু টাকা নিতে এসেছেন, তাঁরা কোনও কথা শুনতে নারাজ। অগত্যা আয়ান ঘোষ পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
অন্য দিক থেকে শ্রীকৃষ্ণ এ বার সত্যিই আয়ান ঘোষের ছদ্মবেশে আসেন। তাঁকে দেখে জটিলা ও কুটিলার হৃদয় স্নেহে অভিভূত হয়। তাঁরা কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে সকল ঘটনা বর্ণনা করেন। কৃষ্ণ কী ভাবে আয়ান ঘোষের ছদ্মবেশে এসেছিলেন এবং কী ভাবে তাঁরা তাঁকে বিতাড়িত করেছেন, সেই ঘটনার বিবরণ দেন দু’জনে।
আয়ান ঘোষের ছদ্মবেশধারী কৃষ্ণ তাঁদের বলেন, রাধারানির মঙ্গলদেবীর পুজো করা প্রয়োজন। তাই তাঁর উপবাস করে রাতে মন্দিরে যাওয়া উচিত এবং সারা রাত পুজো করা উচিত। জটিলা-কুটিলা সেই মতো রাধারানিকে রাতভর প্রার্থনা করার জন্য মঙ্গলদেবী মন্দিরে পাঠান। এ দিকে, আয়ান ঘোষ ঘরে ফিরে আসতেই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়। জটিলা-কুটিলা বুঝতে পারেন, যাঁকে তাঁরা কৃষ্ণ ভেবেছিলেন, তিনি প্রকৃতই আয়ান ঘোষ। আর যাঁর নির্দেশে তাঁরা রাধাকে মন্দিরে পাঠিয়েছেন, তিনি ছদ্মবেশধারী কৃষ্ণ।
সমস্ত বুঝতে পেরে জটিলা-কুটিলা আয়ান ঘোষকে জঙ্গলে গিয়ে দেখার নির্দেশ দেন। আয়ান ঘোষ রাধার পবিত্রতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ ছিলেন, কারণ তিনি জানতেন রাধা সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মীর প্রতিভূ। গত জন্মে কঠোর সাধনায় তিনি শ্রীলক্ষ্মীকে পেয়েছেন পত্নী রূপে। কিন্তু, জটিলা-কুটিলার প্ররোচনায় তিনি রাধাকে জঙ্গলে অনুসরণ করেন। পিছনে পিছনে যান জটিলা, কুটিলাও।
রাধারানি স্বয়ং এ সব কিছুই জানতে না পারলেও কৃষ্ণ সবই জানতেন। তিনি রাধাকে বলেন, কিছু ফুল এনে তাঁকে নিবেদন করতে। রাধা যখন ফুল এনে কৃষ্ণের পায়ে অর্পণ করেন, সেই মুহূর্তে এসে পৌঁছন আয়ান ঘোষ।
কিন্তু, আয়ান ঘোষ দেখতে পান এক অনন্য দৃশ্য। তিনি কৃষ্ণকে দেখতে পাননি।বরং দেখেন, রাধা সত্যিই দেবী আরাধনায় ব্যস্ত। আর তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎ মহামায়া, মা কালী। স্বয়ং আদ্যাশক্তি তাঁর সামনে আবির্ভূতা। আর তাঁর পায়ে ফুলের অর্ঘ্য অর্পণ করছেন স্ত্রী রাধিকা।
শ্রী কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর শক্তি-স্বরূপ সর্বদা বিরাজ করেন যোগমায়া, মায়া দেবী। সেই মায়ার খেলাতেই কৃষ্ণ নেন কালী রূপ। কৃষ্ণ কালীতে বিলীন হয়ে এক অনন্য রূপ সৃষ্টি হয়। এই কৃষ্ণকালী শাক্ত এবং বৈষ্ণব উভয় সম্প্রদায়েরই উপাস্য। ইয়াভাটে জটিলা-কুটিলার বাড়ির কাছে এই ঘটনার স্মরণে এক কৃষ্ণকালী মন্দির আছে। তা ছাড়া, সারা দেশে ছড়িয়ে আছে কৃষ্ণকালীর অজস্র মন্দির।
দেবীর বাৎসরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয় মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী বা রটন্তী চতুর্দশী তিথিতে। এ ছাড়াও যে সমস্ত স্থানে তাঁর মন্দির আছে, সেখানে নিত্য পুজো হয়। কৃষ্ণকালীর ধ্যান মন্ত্র অনুযায়ী, কৃষ্ণকালী চতুর্ভুজা, কৃষ্ণবর্ণা, চূড়ামুকুট মণ্ডিতা।
দক্ষিণহস্তে শঙ্খ ও খর্পর ধারিণী এবং নবযৌবনসম্পন্না। বাম হস্তে খড়্গ ও চক্র ধারণ করে আছেন, গলায় মুণ্ডমালা। গোপিনীদের দ্বারা অর্চিত এবং নানা অলঙ্কারে সজ্জিতা। চতুর্বর্গ প্রদানকারিণী সেই দেবী ব্রহ্মরূপা সনাতনী। দারিদ্র্য, শোক নাশকারিণী এবং মোক্ষদায়িনী। দেবীর পুজোয় সকল বিপদ-দুঃখ-দৈন্য দূরে চলে যায় বলে ভক্তদের বিশ্বাস। এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।