ঝন...ঝন...ঝন...! ক্ষীণ আওয়াজ শুনে উঠে বসেন জটিলা। কেমন একটা ভোঁতা আওয়াজ, কীসের এ আওয়াজ!মাটিতে কান পাতলেন৷ আরও খানিকক্ষণ শোনার পর বুঝতে পারলেন, আরে এ তো নূপুরের নিক্কণ! কিন্তু এমন মৃদু, শ্বাসরুদ্ধকর আওয়াজ কেন নূপুরের?
পরক্ষণেই মনে পড়ল কুটিলার কথা। কুটিলা বলেছিল বটে, ‘‘রাধা নুপুরের তীব্র ধ্বনিকে মৃদু ও ক্ষীণ করতে নূপুরের উপর কাপড় জড়িয়ে নেয়।’’এ তা হলে সত্যি! রধার এ ছলনা? এত স্পর্ধা এই রাধার, স্বামী থাকতে অভিসারে যাবে ওই কানাইয়ের সঙ্গে!
ক্যাঁচ করে একটা মৃদু আওয়াজ পেলেন এবার। পিছনের দরজাটা আলতো আর্তনাদ করে উঠল যেন। আর দেরি করলেন না জটিলা। বোন কুটিলার ঘরে এসে ডেকে তুললেন তাঁকে।
তার পর ডেকে তুললেন স্বামী আয়ান ঘোষকে। সদ্য ঘুমভাঙা আয়ানের মনে ভরে দিলেন বিষ। তরোয়াল হাতে চললেন আয়ান। আজ হাতেনাতে ধরবেন শ্রীরাধিকা ও কানাইকে! এত দূর স্পর্ধা!
কিন্তু মুশকিল হল, আঁধার রাত। আগামীকাল অমাবস্যা তাই চাঁদের আলো নেই, উপরন্তু ঘন কুয়াশা। সামান্য প্রদীপের আলোয় কিছুই ঠাহর হয় না। কুটিলা উপায় দিলেন। দুর্জনের ছলের অভাব নেই। তাই তিনিও পরিকল্পনা করেই রেখেছিলেন। দুপুরে জম্পেশ করে নাপিত বউকে দিয়ে আলতা পরিয়েছিলেন রাধার পায়ে। কুয়াশায় ভেজা মাঠ পথে লাল পদচিহ্ন আঁকা হয়ে রয়েছে।
সেই দিকে ছুটে চললেন সকলে। ওই যে কুঞ্জবনের মাঝে দেখা যায় আলো। তারপর? আয়ান এ কী দেখলেন? আয়ানের হাত থেকে খসে পড়ল অস্ত্র। চোখ দিয়ে অঝোরে নেমে এল অশ্রুধারা। পশ্চাতে জটিলা এবং কুটিলা তখনও কথা বলে চলেছে। কিন্তু সে চিত্রার্পিতের ন্যায় স্থির। ভক্তির আবেশে চোখ বুজে আসে আয়ানের, তার ইষ্ট দেবী, পরমা শক্তি 'মা কালিকা', তাঁর সামনে!
কিন্তু মায়ের এ কেমন রূপ, বরাভয় মুদ্রা, অথচ হাতে বংশী ও খর্পর বা খড়্গ! এ কী আশ্চর্য রূপ তাকে দেখালেন মা! শ্রী রাধা বনফুলে মালা গেঁথে মায়ের সেবায় মগ্ন। থরথর করে কেঁপে ওঠে আয়ান, লুটিয়ে পড়লেন মায়ের পদতলে। মাতৃকায়া~ কৃষ্ণকালী চতুর্ভুজা কৃষ্ণবর্ণা চূড়ামুকুট মণ্ডিতা। দক্ষিণহস্তে শঙ্খ ও খর্পর ধারিণী এবং নবযৌবনসম্পন্না। বাম হস্তে খড়্গ ও চক্র ধারণ করে আছেন এবং মুণ্ডমালা বিভূষিতা। গোপিনীদের দ্বারা অর্চিতা এবং নানালঙ্কার ভূষিতা।
কৃষ্ণকালীপূজা, মাঘমাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মা কালী হওয়ার দিন। এককথায় কৃষ্ণকালী পূজা এক সন্ধিক্ষণ। যে সন্ধিক্ষণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরমা প্রকৃতি অর্থাৎ শক্তিতে লীন হয়ে যাচ্ছেন এবং তার সাথেই দুই মতবাদা, একই ধারা এসে মিশেছে। সে ধারা হল বিশ্বাস এবং সমর্পণ।
কিংবদন্তি মতে, এই দিন মা এবং শ্রীকৃষ্ণ যুগপৎ শ্রীরাধা কে রটনাহেতু উত্থাপিত কলঙ্ক থেকে উদ্ধার করেছিলেন। তাই এই পূজার অপর নাম, রটন্তী কালীপূজা। এই কালীপূজা অমাবস্যায় হয়না বরং চতুর্দশীর সেই মহান সন্ধিক্ষণকে স্মরণ করে।
তত্ত্ব- জটিলা এবং কুটিলা হলেন মনের কুপ্রবৃত্তি এবং তমোগুণ। যারা প্রতিনিয়ত মানুষকে প্ররোচনা দেয়।কৃষ্ণকালী রূপটি হল ঈশ্বরের অভিন্নতা অর্থাৎ পরম ব্রহ্ম নিরাকার এবং অখন্ড।