Mythological Stories of Kali Puja

কালীর পাশে বিকট দর্শনা ডাকিনী, যোগিনী কীসের প্রতীক?

কালীপুজোর সময় মায়ের দুই পাশে সহচরী হিসেবে থাকেন ডাকিনী, যোগিনী। তাঁরা ভয়াল দর্শন। এঁরা আসলে কারা?

Advertisement

তমোঘ্ন নস্কর

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৩১
Share:

মন্দাকিনী সরোবরে স্নান করতে নেমেছেন দেবী পার্বতী। সখীদের সঙ্গে জলকেলি করতে করতে কখন যে সময় পেরিয়ে গিয়েছে তার হিসাব নেই। এক সময় জলকেলি করতে করতে ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ক্লান্ত ও কাতর হয়ে পড়লেন সখীরা।

Advertisement

মায়ের কাছে বারবার খাদ্যের অনুরোধ করতে লাগলেন তাঁরা। মা’ও এ দিকে ক্ষুধায় গৌরী থেকে কৃষ্ণাঙ্গী হয়ে পড়েছেন। কিন্তু কৈলাশ না পৌঁছানো অবধি এ বন ভূমে খাদ্যের জোগাড় করা বড় মুশকিল। এ দিকে এঁরাও তাঁর সন্তানসম, তিনি কী প্রকারে তাঁদেরকে ক্ষুধার্ত রাখতে পারেন!

আর কে না জানে, ক্ষুধা অগ্নির ন্যায় ভীষণ। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে জঠর থেকে মস্তিষ্ক অবধি জ্বালিয়ে দেয়। তাই তো ভীষণ ক্ষুধায় কাতর হয় জয়া-বিজয়া-র মতো সুদর্শনা সখীরাও বিকট ‘ডাকিনী- বর্ণিনী’ রূপ পরিগ্রহণ করলেন।

Advertisement

অতএব নখের আঁচড়ে নিজের মুণ্ডছিন্ন করলেন মাতা পার্বতী। নিদের রক্ত দিয়ে তৃষ্ণা মেটালেন দুই সহচরীর, সেই সঙ্গে এর একটি ধারা তৃষ্ণা মেটাল ও তার কর্তিত মুণ্ডেরও।

হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, আজকের আমাদের আলোচ্য বিষয় ডাকনী ও বর্ণিনী।

কালীপুজোর সময় আমরা প্রায়ই মায়ের দুই পাশে সহচরী বা আবরণ হিসেবে তাঁদের উপস্থিতি দেখতে পাই। সেখানে তাঁরা ভয়াল দর্শন। কিন্তু, জানবেন দক্ষিণাকালিকার মাতৃকল্পে এঁরা নেই, এঁদের ভিত্তি সম্পূর্ণ তাত্ত্বিক দার্শনিক। কেবল মাত্র বিশেষ কিছু ধ্যানে রয়েছে এদের উল্লেখ। তাহলে, এঁরা কারা?

প্রথম ব্যাখ্যা

দর্শন তত্ত্বে, এঁরা হলেন মাতৃসহ ত্রিগুণ অর্থাৎ স্বতঃ, রজঃ এবং তমঃ। রজঃ হল সেই গুণ, যে গুণ মানুষকে দিয়ে কর্ম করায়, তাকে কাজে প্রবৃত্ত করে। আর তমঃ হল জাগতিক সমস্ত অন্ধকার, অলসতা, ষড়রিপু যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। আর মা হলেন স্বতঃগুণ যিনি এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে মানুষকে সুস্থির রাখেন।

অর্থাৎ মানুষ যেমন এই দুই গুণের অধীন, এর থেকে বেরোতে পারে না ঠিক, তেমন ভাবে মাতৃ নাম জপে নিজেকে একাগ্রতার দ্বারা সুস্থির রাখতে হবে।

সাধকের সাধন ত্রিকোণে ইরা, পিঙ্গলা এবং সুষুম্না। ডাকিনী ও বর্ণিনী হলেন ইরা ও পিঙ্গলা আর মা হলেন খোদ সুষুম্না। এই সুষুম্নাকাণ্ড ধরেই মানুষের বোধ ক্রমশ উত্তরণের পথ আরোহণ করে। ষষ্ঠ চক্র আরোহন করে, মানুষের সাধনায় সিদ্ধি দেয়।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যা

আরেকটি প্রামাণ্য সূত্র বলে, ডাকিনী এসেছে ডাক কথা থেকে। ডাকের অর্থ হল জ্ঞান। অর্থাৎ ডাকিনি বা ডাক সিদ্ধ জ্ঞানের অধিকারিনী, অর্থাৎ প্রাজ্ঞ। (সূত্র: চর্যাপদ ব্যাখ্যা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী)

যোগিনী হলেন, যিনি যোগ সিদ্ধা। তিনি মায়ের নিত্য সহচরী, শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের মুহূর্তে মায়ের সঙ্গে রণক্ষেত্রে তাঁরা অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যোগ শব্দটির অর্থও তো "চিত্তবৃত্তিনিরোধ" অর্থাৎ চিত্তের চঞ্চল প্রবণতাগুলিকে সংযত করা। তাই যোগ সিদ্ধা অর্থ, যিনি সাধনার দ্বারা ‘আমি’র ঊর্ধ্বে উঠেছেন। (সূত্র: যোগদর্শন, পতঞ্জলি)

তাহলে দুটি ব্যাখ্যাই পরস্পরকে সমর্থন করে — জ্ঞান এবং যোগ দ্বারা একজন মানুষ সাধারণ মানুষ হতে সিদ্ধ, জ্ঞানতপ্ত মানুষে পরিণত হন।

তাহলে এই ভয়াল দর্শন ডাকিনী- বর্ণিনী / ডাকিনী - যোগিনী আদতে আমাদের নিত্য জীবনের এক চরম দার্শনিক তত্ত্বের সন্ধান দেয়। যে চক্রে আমরা নিত্য ঘুরে চলেছি। সেই সূক্ষ্ম ভাবটিরই স্থূলরূপে মূর্তির পাশে কল্পনা করা হয়েছে।

ঋণ: কালিকাপুরাণ কালীকথা (শিবশংকর ভারতী), নবকল্লোল দীপান্বিতা অমাবস্যা সংখ্যা(১৪২৯), জ্যোতিষার্ণব (অরিজিৎ মজুমদার, সপ্তর্ষিনারায়ণ বিশ্বাস)

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement