আর কিছু দিনেই অমাবস্যার প্রহরে শহর জুড়ে হবে মা কালীর আরাধনা। শক্তি রূপে দেবীর মৃন্ময়ী রূপেরই পুজো চলে রাতভর।
তাঁর ভক্তেরা শুধুমাত্র তাঁর মৃন্ময়ী রূপেরই কল্পনা করতে পারে। তাঁর দর্শন পাওয়া সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। তবে এমন কিছু মানুষ আছেন, বলা ভাল, কিছু মহাসাধক রয়েছেন যাঁরা তাঁদের কঠিন সাধনার দ্বারা মায়ের দর্শন পেয়েছিলেন বলে দাবি করেছিলেন।
সেই মহাসাধকদের নাম জানালেন ভারততত্ত্ববিদ অজয় ভট্টাচার্য। রইল সেই তালিকা।
মনে করা হয়, পঞ্চদশ শতাব্দীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহাসাধক ঠাকুর সর্ব্বানন্দ দেব কঠিন সাধনার পর মাতৃদর্শন করেন। তাঁর সিদ্ধিলাভের জায়গা ঘিরে গড়ে উঠেছে মেহের কালীবাড়ি। বলা হয়, স্বয়ং মা কালী এখানে সর্বদা উপস্থিত থাকেন, তাই মায়ের কোনও মূর্তি এখানে স্থাপন করা হয় না। তাঁর লেখা বইয়ের নাম ‘সর্বোল্লাস তন্ত্র’।
তন্ত্রশাস্ত্রে সুপণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ জন্মগ্রহণ করেন নদীয়া জেলার নবদ্বীপ শহরে। প্রচলিত মত অনুসারে, তিনি মায়ের কাছে প্রার্থনা করেন সাকার রূপে তাঁকে দেখা দিতে। যাতে তিনি দেবীর মূর্তি গড়ে তাঁর পূজার্চনা করতে পারেন।
দেবী তাঁকে বিধান দেন মহানিশার অবসানে প্রাতঃমুহূর্তে কৃষ্ণানন্দ প্রথম যে নারীমূর্তি দর্শন করবেন, সেই মূর্তিই হবে দেবীর সাকার মূর্তি। কৃষ্ণানন্দ মায়ের শান্ত রূপ অর্থাৎ দক্ষিণাকালী রূপ দর্শন করেন এবং বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মা কালীর রূপেই বাংলা তথা সমগ্র বিশ্বে কালীপুজো হয়। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তন্ত্রসার’।
তন্ত্রসাধক বহ্মানন্দ গিরি ষোড়শ শতাব্দীতে মাতৃদর্শন করেন। তাঁর রচিত বই ‘শাক্তানন্দ তরঙ্গিণী’ এবং ‘তারা রহস্য’। তিনিই সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের কূলদেবী মা ভুবনেশ্বরীর অনুকরণে কালীঘাটে কষ্টিপাথরের দক্ষিণাকালীর মূর্তি বানিয়েছিলেন।
মহান সাধক পূর্ণানন্দ ষোড়শ শতাব্দীতে মায়ের দর্শন পান। তাঁর লেখা বই ‘শ্যামা রহস্য’।
সপ্তাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সাধক গৌড়ীয় শংকর দেবীদর্শন করেন।
এই সপ্তাদশ শতাব্দীতেই রাম তোষণ বিদ্যালঙ্কার মায়ের দেখা পান। তাঁর লেখা বই ‘প্রাণ তোশনি তন্ত্র’।
নাটোরের রানী ভবানীর দত্তক পুত্র ছিলেন রাজা রামকৃষ্ণ। রানী ভবানীর মৃত্যুর পর রাজ্যপাটের দায়িত্ব তাঁর উপর আসে। কিন্তু আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সন্ধানে তাঁর উপাধি এবং সমস্ত সম্পদ ত্যাগ করেছিলেন। তিনিও মায়ের দর্শন পেয়েছিলেন।
কালীসাধকদের মধ্যে রামপ্রসাদ সেনের নাম শোনেননি এমন ভক্ত খুব কমই আছেন। হালিশহরে জন্ম রামপ্রসাদ সেনের। বেশিরভাগ সময়ে তিনি সাধনাতেই মগ্ন থাকতেন এবং মায়ের গান রচনা করতেন। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের শিষ্য ছিলেন তিনি। শোনা যায়, পঞ্চমুণ্ডি আসনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি ধ্যানমগ্ন থাকতেন। আদ্যাশক্তি মহামায়া রূপে তিনি দেবীর দর্শন পান।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মা কালীর মহান ভক্ত কমলাকান্ত ভট্টাচার্য বর্ধমান শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভাষা, কবিতা ও সঙ্গীতে তাঁর পারদর্শিতার কারণে, বর্ধমানের মহারাজা, তেজচন্দ্র তাঁকে তাঁর দরবারের উপদেষ্টা করেন এবং পরে তাঁকে গুরু হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি মা কালীকে কখনও মূর্তি হিসাবে দেখেননি। তাঁর কাছে মায়ের মূর্তি ছিল সব সময়ই জীবন্ত।
কথিত, কোনও এক রাতে এক শ্মশানে আত্মমগ্ন হয়ে গান গাইছিলেন কমলাকান্ত। সেই সময়ে এক অশরীরী তান্ত্রিক কাপালিক তাঁকে কালীনামে দীক্ষা দেন এবং সেই মন্ত্র জপ করতে করতে তিনি আনন্দময়ী নৃত্যরতা শ্যামা মায়ের দর্শন পান।
অষ্টাদশ অথবা ঊনবিংশ শতাব্দীতে ময়মনসিংহের কালী সাধিকা অর্ধকালীর কথাও জানা যায়, যিনি মাতৃদর্শন করেছিলেন।
কালী সাধকদের মধ্যে যাঁর নাম সবার আগে আসে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। শ্রীরামকৃষ্ণের বয়স যখন ১৬, তখন তাঁর ভাই রামকুমার তাঁকে তাঁর পুরোহিত পেশায় সহায়তা করার জন্য কলকাতায় নিয়ে আসেন। ১৮৫৫ সালে রানি রাসমণি দ্বারা নির্মিত দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরে রামকুমার প্রধান পুরোহিত হিসাবে যুক্ত হন। কয়েক মাস পরে তিনি মারা গেলে রামকৃষ্ণকে পুরোহিত নিযুক্ত করা হয়।
রামকৃষ্ণর মা কালীর প্রতি গভীর ভক্তির কারণে তিনি তাঁর আরাধনায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন। এক বার নয় বহুবার তিনি মায়ের দর্শন পেয়েছেন বলে দাবি। এমনকি শোনা যায়, দেবীর সঙ্গে তিনি কথাও বলতেন।
বামাখ্যাপার প্রকৃত নাম ছিল বামা, কিন্তু যৌবনকাল থেকেই তিনি পার্থিব বিষয়ে একেবারেই আগ্রহ দেখাননি, তাই লোকেরা তাঁকে পাগল বলে ডাকত এবং তাঁর নামের সঙ্গে খ্যাপা যোগ করত। তিনি দেবী তারার প্রবল ভক্ত ছিলেন। মন্দিরের কাছেই থাকতেন এবং শ্মশানে ধ্যান করতেন। জনশ্রুতি রয়েছে, মা তারার আগে বামাখ্যাপাকে ভোগ নিবেদন করা হত। শ্মশানেই দেবী তারা তাঁর উগ্র রূপের দর্শন দিয়েছিলেন বামাখ্যাপাকে।
শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণবের কাছে মায়ের দর্শন এক স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। তিনি মাকে কালীর বদলে তারা এবং সর্বমঙ্গলা বলে ডাকতেন। তিনি ইংরেজি জানতেন না, কিন্তু তাঁর মহিমা এমন ছিল যে তৎকালীন হাই কোর্টের বিচারক ‘স্যার জন উডরফ’ সংস্কৃত শিখে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি নিজেই তাঁর শিষ্য হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে উডরফ, আর্থার অ্যাভালোন নাম নিয়ে কালির মহিমার বিষয়ে ইংরেজিতে একটি বই রচনা করেন।
কালীসাধক সত্য দেবের কথাও জানা যায় যিনি মাতৃদর্শন করেছিলেন। তাঁর চণ্ডীর ব্যাখ্যা আজও আলোচ্য বিষয়।
আন্দুলের প্রেমিক ঠাকুর মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও দর্শন পেয়েছিলেন মায়ের।
বিংশ শতাব্দীতে যাঁরা কালী দর্শন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম স্বামী বিবেকানন্দ। প্রথমে তিনি কালীকে অপছন্দ করতেন। কিন্তু তাঁর পিতার মৃত্যুর পর আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়তে হয় তাঁর পরিবারকে।
আর্থিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনি গুরু শ্রীরামকৃষ্ণকে তাঁর জন্য দেবী কালীর সঙ্গে কথা বলার জন্য অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, যেন সেই রাতে তিনি নিজেই দেবীর কাছে প্রার্থনা করেন।
কিন্তু তিনি যখন মায়ের দর্শন করলেন তখন সারা বিশ্ব তাঁর চোখের সামনে থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সামনে ছিলেন শুধুই মা কালী। তখন প্রথমবার তিনি মায়ের দর্শন পেয়েছিলেন। এমনকি তাঁর পরিবারের আর্থিক সংকটের প্রার্থনাও মাকে করতে ভুলে যান।
বিংশ শতাব্দীর আরও একজন সাধক হলেন শ্রী অরবিন্দ। তিনি কৃষ্ণ ও কালীর দর্শন একসঙ্গে করেছিলেন। এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।