দেবী দুর্গা যেমন নিজেকে নয়টি অবতার বা নবদুর্গায় প্রকাশ করেন, দেবী লক্ষ্মী নিজেকে প্রকাশ করেন তাঁর আট অবতারের মাধ্যমে।
শাস্ত্রে যাঁদের বলা হয়েছে অষ্টলক্ষ্মী। তাঁরা হলেন আদিলক্ষ্মী, ধনলক্ষ্মী, ধান্যলক্ষ্মী, গজলক্ষ্মী, সন্তানলক্ষ্মী, বীরলক্ষ্মী, বিদ্যালক্ষ্মী ও বিজয়লক্ষ্মী।
আমাদের গৃহে সাধারণত দেবী লক্ষ্মীর একটি রূপের পূজা হলেও, প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মী মন্দিরগুলিতে অষ্টলক্ষ্মীই একযোগে পূজিতা হন।
আদি লক্ষ্মী
দেবী লক্ষ্মীর আদি ও প্রধান রূপ হলেন দেবী আদি লক্ষ্মী। এই দেবী মহালক্ষ্মী, শ্রী ও ভার্গবী নামেও পরিচিতা। বৈকুণ্ঠে নারায়ণের পাশে সর্বদা এই দেবীকেই বিরাজ করতে দেখা যায়। সমুদ্র মন্থনের সময় আবির্ভূতা হয়েছিলেন দেবী আদিলক্ষ্মী। দেবী চতুর্ভুজা, রক্তিম অথবা পীতবসনা কমলাসনা দেবীর দুই হাতে পদ্ম ও শ্বেত পতাকা। দেবীর অপর দুই হাত অভয় ও বরদা মুদ্রায়। পরিচ্ছন্ন ও কোলাহলহীন স্থানে থাকতে ভালোবাসেন দেবী আদিলক্ষ্মী।
দেবী ধনলক্ষ্মী
অর্থের গুরুত্ব নিয়ে একবার নারায়ণের সঙ্গে মতপার্থক্যের জেরে বৈকুণ্ঠ ছেড়ে মানুষের রূপ ধারণ করে মর্ত্যে চলে এসেছিলেন দেবী আদিলক্ষ্মী। দেবী লক্ষ্মী ছাড়া নারায়ণ অস্তিত্বহীন, তাই নারায়ণও বনবাসী কাঠুরের রূপ ধারণ করে চলে এসেছিলেন মর্ত্যে। কাঠুরেরূপী নারায়ণ ছিলেন হতদরিদ্র। অরণ্য থেকে সংগ্রহ করা কাঠ বাজারে বেচে যা আয় হত, তা দিয়ে তাঁর নিজেরই গ্রাসাচ্ছাদন হত না।
ঘটনাচক্রে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল মনুষ্যরূপ ধারণ করা দেবী লক্ষ্মীর। কিন্তু লক্ষ্মীকে বিবাহের মতো অর্থ নারায়ণের কাছে ছিল না। অগত্যা নারায়ণ অর্থ ধার করেছিলেন কুবেরের কাছ থেকে। বিবাহ হয়েছিল মনুষ্যরূপী নারায়ণ-লক্ষ্মীর। কিন্তু বিবাহের পর দীর্ঘকাল কেটে গেলেও কুবেরের ঋণ মেটাতে পারেননি নারায়ণ। ঋণে জর্জরিত নারায়ণ সেই দিন অনুধাবন করেছিলেন অর্থের গুরুত্ব।
দেবী লক্ষ্মীর স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন তিনি। দেবী উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁর অক্ষয় ধনভাণ্ডার। কুবেরের ঋণ মিটিয়ে বৈকুণ্ঠে ফিরে গিয়েছিলেন নারায়ণ, দেবী লক্ষ্মীকে নিয়ে। এই লক্ষ্মীই হলেন দেবী ধনলক্ষ্মী। ষড়ভুজা, রক্তবসনা দেবী ধনলক্ষ্মীর চারটি হাতে তাঁর শঙ্খ, চক্র, পবিত্র কলস ও তির-ধনুক। পঞ্চম হাত অভয় মুদ্রায়। ষষ্ঠ হাত থেকে ঝরে পরে সোনার মোহর। দেবী ধনলক্ষ্মী বৈষয়িক সুখ ও সমৃদ্ধির দেবী।
দেবী ধান্যলক্ষ্মী
অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন পাণ্ডবরা এক বার উপস্থিত হয়েছিলেন এক ঘন অরণ্যে। অনেক খুঁজেও আহার্য জোগাড় করতে পারেননি পঞ্চপাণ্ডব। শুরু হয়েছিল উপবাস। পাণ্ডবদের অসহায় অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে, দেখা দিয়ে পাণ্ডবদের হাতে আহার্য্য বস্তু দিয়ে পূর্ণ একটি পাত্র তুলে দিয়েছিলেন দেবী। ওই পাত্রের বিশেষত্ব ছিল, খালি হয়ে গেলে নিজে থেকেই আবার ভরে উঠত পাত্রটি। এই ভাবেই ক্ষুধার্ত ভক্তদের রক্ষা করেন দেবী ধান্যলক্ষ্মী।
দেবী কৃষিসম্পদদাত্রী। অষ্টভুজা এই দেবীর পরনে থাকে সবুজ বস্ত্র। দেবীর আটটি হাতের মধ্যে ছ'টি হাতে দুটি পদ্ম, গদা, ধানের শিষ, আখ ও কলা। বাকি দুটি হাত অভয় ও বরদা মুদ্রায়। নবান্ন উৎসবে বাংলার প্রতিটি কৃষকের গৃহে পূজিতা হন এই দেবী।
দেবী গজলক্ষ্মী
নারায়ণের নিত্য পুজো করত বিশালকায় এক হস্তি গজেন্দ্র। নারায়ণের নিত্যপুজো করতেন দেবী লক্ষ্মীও।
শ্রীবিষ্ণু এক দিন দেবীকে বলেন, গজেন্দ্রের সঙ্গেই নিত্য পূজা করতে। সেই দিন থেকে গজেন্দ্র ও দেবী লক্ষ্মী একত্রে নারায়ণের আরাধনা শুরু করেছিলেন। এই লক্ষ্মীর নাম গজলক্ষ্মী। দেবী গজলক্ষ্মী চতুর্ভুজা, পদ্মাসনা। তাঁর দুই হাতে থাকে দুটি পদ্ম। বাকি দুটি হাত থাকে অভয় ও বরদা মুদ্রায়। দেবীর দুইপাশে দাঁড়িয়ে থাকে একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী হস্তি। তাদের শুঁড় থেকে নির্গত হওয়া জল, বৃষ্টিধারার মতো ঝরে পড়ে দেবী গজলক্ষ্মীর দেহে। দেবী গজলক্ষ্মী প্রাণীসম্পদের রক্ষক। পশুকুলের ত্রাতা। তাই যাঁরা গবাদি পশুপালন করেন, দেবী গজলক্ষ্মী তাঁদের আরাধ্যা।
দেবী সন্তানলক্ষ্মী
দেবী সন্তানলক্ষ্মী সন্তানসুখপ্রদায়িনী। একটি শিশুকে কোলে নিয়ে ষড়ভুজা এই দেবী পদ্মাসনে বিরাজ করেন। রক্তিম বা পীত বস্ত্র পরিহিতা দেবীর চারটি হাতে দুটো কলসি, তরবারি ও ঢাল। বাকি হাত দুটি অভয় ও বরদা মুদ্রায়। মনে করা হয়, দেবী সন্তানলক্ষ্মী আমাদের সন্তানদের সার্বিক বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা দেখেন।
দেবী বীরলক্ষ্মী (ধৈর্যলক্ষ্মী)
প্রাচীনকালে ভোজ নামে একজন রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন দেবী লক্ষ্মীর একনিষ্ঠ ভক্ত। একদিন রাজা ভোজের স্বপ্নে দেখা দিয়ে দেবী লক্ষ্মী বলেন, অষ্টলক্ষ্মীর মধ্যে সাত লক্ষ্মীর ভোজরাজ্য ছেড়ে যাওয়ার সময় এসেছে। তাই রাজা যেন অষ্টলক্ষ্মীর মধ্যে এক লক্ষ্মীকে বেছে নেন। সেই লক্ষ্মীই থেকে যাবেন ভোজের রাজ্যে। রাজা চেয়েছিলেন দেবী বীরলক্ষ্মী বা ধৈর্যলক্ষ্মীকে। কারণ সাহস ও ধৈর্য থাকলে মানুষের পক্ষে অসাধ্য কিছু নেই। দেবী বীরলক্ষ্মী বা ধৈর্যলক্ষ্মী পূজিতা হন রণক্ষেত্রে শৌর্য, বীর্য ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য। আবার এই দেবীই পূজিতা হন সংসার-জীবনের সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্য। রক্তবস্ত্র পরিহিতা অষ্টভুজা দেবীর হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, ধনুক, তির, ত্রিশূল (মতান্তরে তরবারি) ও সোনার ফলক (মতান্তরে বই)। দেবীর বাকি দুটি হাতে বরদা ও অভয় মুদ্রা।
দেবী বিদ্যালক্ষ্মী
পদ্মাসনা, শুভ্রবস্ত্র পরিহিতা, শ্বেতবর্ণা দেবী বিদ্যালক্ষ্মী জ্ঞানরূপ ধনপ্রদায়িনী। চতুর্ভুজা দেবীর দুটি হাতে থাকে দুটি পদ্ম। অন্য দুই হাত অভয় ও বরদা মুদ্রায়। দেবী বিদ্যালক্ষ্মী বৈষয়িক সুখ ও সমৃদ্ধির দেবী নন। তিনি জ্ঞান, বুদ্ধি ও আত্মিক সমৃদ্ধির দেবী। তিনি ভক্তের সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত করেন।
দেবী বিজয়লক্ষ্মী
লোক কথা মতে, বহুদিন আগে মর্ত্যে এক দরিদ্র ব্যক্তি বাস করতেন। তিনিও ছিলেন দেবী লক্ষ্মীর একনিষ্ঠ ভক্ত। তাঁর নিষ্ঠা দেখে তুষ্ট দেবী দর্শন দিয়েছিলেন। কিন্তু ভক্তকে আরও একটু পরীক্ষা করার জন্য দেবী বলেছিলেন, তার জন্ম অশুভ মুহূর্তে তাই তিনি জীবনে সম্পদশালী হতে পারবেন না। এ কথা শুনেও দেবীর আরাধনা থেকে বিচ্যুত হননি ওই ভক্ত। বরং আরও কঠোরভাবে শুরু করেছিলেন লক্ষ্মীর তপস্যা। ত্যাগ করেছিলেন আহার ও নিদ্রা। বিচলিত লক্ষ্মী তখন ভক্তের কুটিরে উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁর ধনসম্পদ। কিন্তু সেই দরিদ্র ভক্ত ততদিনে অন্য সম্পদের সন্ধান পেয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জয় করেছিলেন নিজের কামনা ও বাসনা। তাঁর কাছে অর্থ সম্পদ হয়ে উঠেছিল মূল্যহীন। তাই দেবী লক্ষ্মীর দেওয়া সম্পদ দিয়ে তিনি নির্মাণ করেছিলেন বিজয়নগর রাজ্য। সমস্ত সম্পদ তিনি বিলিয়ে দিয়েছিলেন রাজ্যের জনসাধারণের মধ্যে। এই দেবীই হলেন বিজয়লক্ষ্মী। অষ্টভুজা এই দেবী রক্তবস্ত্র পরিহিতা। দেবীর ছ'টি হাতে থাকে চক্র, শঙ্খ, তরবারি, ঢাল, ফাঁস ও পদ্ম। দুটি হাত থাকে বরদা ও অভয় মুদ্রায়। রণক্ষেত্র সহ, জীবনের সকল বাধাবিপত্তি জয় করে সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে এই দেবীর করুণা একান্তই আবশ্যক। তাই দেবী জয়লক্ষ্মী নামেও পরিচিতা।
তবে যে রূপেই দেবীর আরাধনা করা হোক, কথিত আছে দেবী চঞ্চলা। লক্ষ্মীর ঝাঁপি যাতে পরিপূর্ণ থাকে, তাঁর কৃপা যাতে নিরন্তর বর্ষিত হয়, সে জন্য কী করা উচিত? মহাভারতের শান্তিপর্বে এর উল্লেখ রয়েছে। দেবী লক্ষ্মী বলেছেন, "সত্যে স্থিতাস্মি দানে চ ব্রতে তপসি চৈব হি। পরাক্রমে চ ধৰ্ম্মে চ পরাচীনস্ততো বলিঃ॥" অর্থাৎ, সত্য, দান, ব্রত, তপস্যা, পরাক্ৰম ও ধৰ্ম.... এই ছ-টি গুণ যার মধ্যে থাকবে, তার উপর দেবীর কৃপা থাকবে। যে ব্যক্তি সত্যবাদী, দানশীল, নিজকর্মে যথাযথ ব্রতী, কর্মতপস্যা -জ্ঞানতপস্যা- জগতের কল্যাণতপস্যায় রত, পরাক্রমী এবং কখনোই স্বধর্মচ্যুত হন না, দেবী লক্ষ্মী সর্বদা সেই ব্যক্তির সহায়। তাঁর গৃহের লক্ষ্মীর আসন বাঁধা।
শুধুমাত্র লক্ষ্মীপুজোর দিনে নয়, সারা বছরই এই ৬টি গুণ বজায় রেখে দেবী লক্ষ্মীকে প্রসন্ন করুন, অর্থ সম্পদে ভরে উঠবে ঘর।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।