Kali Puja Myths and Facts

মা সেখানে অর্ধকালী নামে পরিচিত! তাঁর পুজোয় উপবাস প্রথা নেই

অর্ধ কালীর গল্প শুনলে শিহরণ লাগে! তাঁর পুজোয় উপবাস করা চলে না।

Advertisement

তমোঘ্ন নস্কর

শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:৩৪
Share:

সে এক অপূর্ব দৃশ্য! সম্মুখের দু হাতে পরমান্নের থালা, পিছনের দু'টি হাত তুলে দিচ্ছে ঘোমটা।

Advertisement

ঘোমটা সরে যাওয়ায় মায়ের মুখমণ্ডল আরক্ত, জিভ কেটেছেন দাঁতে!

সমবেত জনগণ যারা কৌতুক করছিলেন, তাঁরাই নতজানু হয়ে বসে পড়লেন তাঁর পদপ্রান্তে। এ কী দেখালে মা তুমি! মা তুমি সত্যিই অর্ধ কালী।

Advertisement

সে প্রায় ছ'শো বছরের কথা। ময়মনসিংহের কালীসাধক দ্বিজদেব ঠাকুর মায়ের নাম করেন আর আকুল হয়ে সন্তান যাচনা করেন।

দীর্ঘদিন হয়ে গেল বিবাহের, অথচ সন্তান আশীর্বাদ হতে দ্বিজ ঠাকুর বঞ্চিত। তাঁর কাতর, আকুল ডাকে মা সাড়া দিলেন।

এক রাতে ঠাকুর স্বপ্ন দেখলেন, তাঁর পরমারাধ্যার শক্তি অংশ তাঁর কাছে কন্যারূপে আসবেন। অবশেষে মাঘী পূর্ণিমার দিন সেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। অদ্ভুত তাঁর রূপ, সে না তো গৌরাঙ্গী না শ্যামাঙ্গী। সিঁথি হতে অর্ধ বিপ্রবর্ণা গৌর আর বাকি অর্ধ ঘন শ্যাম বর্ণ। গ্রামের লোক ভয়ঙ্কর কোনও ইঙ্গিত ভেবে বুঝল। কিন্তু দ্বিজ ঠাকুর একটি বারের জন্যেও সেই স্বপ্নের কথা প্রকাশ করলেন না।

কন্যার নাম দিলেন জয়দুর্গা। কিন্তু মনে তিনি তাকে ডাকতেন অর্ধকালী বলে।

কন্যা বড় হয়, ঠাকুর পড়েন চিন্তায়। তাঁর এমনতর কন্যাকে কে বিবাহ করবে? এমন দুশ্চিন্তাঘন, বিনিদ্র রাতে তিনি আবার স্বপ্নাদিষ্ট হন। মা কন্যার স্বামীকে নির্দিষ্ট করলেন। তিনি দ্বিজ ঠাকুরের টোলের শিষ্য রাঘবরাম ভট্টাচার্য।

বঙ্গদেশে তখন শেরশাহ মসনদে। তার অত্যাচারে বৈদিক চর্চা প্রায় বন্ধ।

এমন সময় তন্ত্র ও জীবনমুখী বিদ্যার চর্চা এবং টোল চর্চা অনেক প্রসার লাভ করেছিল। কারণ এই চর্চা মূলত গুরুমুখী এবং গুপ্ত। মিতরা গ্রামের রাঘবরাম ভট্টাচার্য তেমনই একজন। তিনি গুরু দ্বিজ ঠাকুরের টোলে তন্ত্র জ্যোতিষ চর্চা করতেন।

দ্বিজ ঠাকুর সেই বালকের বেশ কিছু কথাই অবগত ছিলেন।

যেমন, সে বালক গাছে থেকে ফল পাড়তে গিয়ে নিজের গলায় সাপ জড়িয়ে ধ্যানে বসে থাকে। খেলাধূলার সময় মাটিতে শিব-শবের অবস্থান ভারী পছন্দ, সে ভাবে সে ঘুমিয়েও পড়ে। এসবই মায়ের ইঙ্গিতকে আরও স্পষ্ট করে দিচ্ছিল । অতএব, আট বৎসর বয়সে অর্ধকালী তথা জয়দুর্গা সঙ্গে রাঘবরামের বিবাহ হয়।

শুরুতে বলা ঘটনা পাকস্পর্শ বা বউভাতের দিনের। নতুন বউ পরমান্নের থালা হাতে খাদ্য পরিবেশনে ব্যস্ত।

ঘোমটা দিয়ে ঢেকে রেখেছেন আপন মুখশ্রী। অপরদিকে সমবেত আত্মীয়-স্বজন গুঞ্জন তুলে চলেছেন, বধুর এহেন অদ্ভুত মুখশ্রী নিয়ে। সহসা দমকা বাতাস ওঠে খোলা প্রাঙ্গণে। নববধূর ঘোমটা সরে যায়। লজ্জায় জিভ কাটেন। হাত জোড়া অবস্থায় কী প্রকারে ঘোমটা দেবেন সমবেত গুরুজনের সম্মুখে। পিছন থেকে দুটি হাত এসে, তুলে দেয় ঘোমটা।

সমবেত জনগণ স্বাক্ষী হন, এক অপূর্ব, স্বর্গীয় দৃশ্যের!

সেই রূপই অর্ধকালী।

রাঘবরাম ও অর্ধকালীর চারটি সন্তান হয়। রাঘবরামের ইচ্ছায় তাঁর বংশ অর্ধকালীর বংশ হিসাবে পরিচয় পায়।

রাঘবরাম দুর্গাপুজো করতেন স্বহস্তে।

একবার রাঘবরাম তাঁর চার পুত্রকে নিয়ে পুজোয় বসেছেন। প্রতিমা দক্ষিণমুখী। রাঘবরাম উত্তরমুখী হয়ে চণ্ডীপাঠ ও পুজো করছেন। পুত্রগণ পূর্বমুখী হয়ে বসেছেন।

চণ্ডীপাঠ কালে এক স্থানে তাঁর উচ্চারণ ভুল হয়ে যায়। জ্যেষ্ঠ পুত্র্য রামদেব পিতার ত্রুটি ধরিয়ে দিলে, রাঘবরাম অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। নিজে চণ্ডীপাঠ বন্ধ করে পুত্রকে চণ্ডীপাঠ করতে বলেন।

পিতৃআজ্ঞা পালন করে জ্যেষ্ঠপুত্র রামদেব চণ্ডীপাঠে বসেন এবং বিশুদ্ধ উচ্চারণ করে সুললিত কণ্ঠে অতীব সুন্দরভাবে চণ্ডীপাঠ করতে থাকেন।

আজও লৌকিক কিংবদন্তি আছে যে, তাঁর উচ্চারণ এবং পাঠের ধরন সঠিক ছিল কিন্তু পিতৃবাক্য খণ্ডন হেতু দেবী দুর্গা দক্ষিণমুখী থেকে ঘুরে পশ্চিমমুখী হন আর কাঁচা হলুদ বর্ণা দেবী ক্রুদ্ধ রক্তবর্ণা রূপ ধারণ করেন।

অর্থাৎ, রামদেবের

দিকে ঘুরে যান। উক্ত ঘটনার পর থেকে এই অর্ধকালী বংশের দুর্গাপূজোয় চণ্ডীপাঠ বন্ধ হয়ে যায় এবং দেবী রক্তবর্ণা দুর্গা বা লাল দুর্গা রূপে পুজা পেতে থাকেন।

সেই বংশের শাখা আজ ছড়িয়ে পড়েছে (নবদ্বীপ, ধূপগুড়ির ভট্টাচার্য পরিবারের লালদুর্গা পূজা, বরানগরের ভট্টাচার্য বাড়ির পূজা)।

অনেকের গৃহেই লালবর্ণ মৃন্ময়ী দুর্গাপূজা হয় শারদীয়া দুর্গা পুজোয় আর মাতা অর্ধকালীকে স্মরণ করা হয় গৃহদেবী রূপে। সেই বৃহৎ ভট্টাচার্য ও রাঘবরাম পরিবার তথা মাতা কর্ত্রী হিসাবে।

কথিত, মা অর্ধকালী দুর্গা বা কালীপুজোর সময় মায়ের ভোগ নিজে হাতে চেখে দেখতেন তাই আজও এই বংশের দুর্গা বা কালীপুজোয় উপোস করে থাকার নিয়ম নেই।

অদ্ভুত এ বঙ্গ আর অদ্ভুত এর কালী ক্ষেত্র মা যে কতভাবে, কতরূপে ধরা দেন, তার ইয়ত্তা নেই।

তথ্যসূত্র ~

মা অর্ধকালীর একাদশতম বংশধর স্বর্গীয় যতীশচন্দ্র ভট্টাচার্য এর নাতনি সঞ্চালী চক্রবর্ত্তী।

বিভিন্ন প্রতিবেদন।

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement